লামিয়া ইসলাম নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, “একটা ক্রিমিনাল অফেন্সকে তারা কীভাবে জাস্টিফাই করে একটা গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে, সেটা আসলে আমাদের মাথায় আসে না।”
Published : 03 Mar 2025, 07:45 PM
ঢাকার লালমাটিয়ায় চায়ের দোকানে দুই তরুণীর ধূমপান করা নিয়ে ঘটনায় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার মন্তব্যকে ‘মবের উস্কানি’ আখ্যা দিয়ে তার ‘অবিলম্বে অপসারণ’ চেয়ে কুশপুতুল পোড়ানো হয়েছে।
সোমবার বিকালে ‘ধর্ষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ’ ব্যানারে একদল শিক্ষার্থী মানিক মিয়া এভিনিউর দক্ষিণ প্লাজায় তার স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার কুশপুতুল পোড়ান।
এর আগে বেলা সাড়ে তিনটার দিকে তারা আসাদগেট এলাকার আড়ং সংলগ্ন মাঠের পাশে জমায়েত হয়ে বিক্ষোভ দেখান। পরে মিছিল নিয়ে মানিক মিয়া এভিনিউয়ে যান।
বিক্ষোভকারীরা স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার অপসারণ এবং নারীর নিরাপত্তা চেয়ে’ বিভিন্ন লেখা স্লোগান লেখা প্ল্যাকার্ড বহন করেন।
গত শনিবার লালমাটিয়ায় দুই তরুণীর প্রকাশ্যে ধূমপান নিয়ে বয়স্ক একজনের ‘আপত্তি’ থেকে ‘বাকবিতণ্ডা’ ও মানুষ জড়ো হওয়া নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড ঘটে যায়।
পুলিশের ভাষ্য, লালমাটিয়ায় আড়ংয়ের পাশের একটি চায়ের দোকানে দুই তরুণী চা-সিগারেট খাচ্ছিলেন। তখন পাশ দিয়ে যাওয়া একজন বয়স্ক ব্যক্তি তাদের সিগারেট খাওয়া নিয়ে আপত্তি জানিয়ে তাদেরকে চলে যেতে বলেন। এ নিয়ে ওই ব্যক্তির সঙ্গে তরুণীদের কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে ওই ব্যক্তির গায়ে চা ছুড়ে মারেন একজন।
সেখানে লোকজন জড়ো হয়ে দুই তরুণীর ওপর চড়াও হলে পুলিশ গিয়ে তাদের উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায়। পরে রাত সাড়ে ১১টার দিকে দুই তরুণীকে পরিবারের জিম্মায় দেওয়া হয়।
এর পরদিন মিরপুরে সাংবাদিকদের করা এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, “দুই নারীর ওপর হামলার বিষয়ে আমি যতটুকু জানছি ওনারা না কি সিগারেট খাইতেছিল। ওই সময় কিছু লোক না কি নামাজ পড়তে যাইতেছিল। এসময় ওনারা (লোকেরা) বাঁধা দেওয়ায় তাদের ওপর চা ছুড়ে মারছে।
“তো আপনারা জানেন ওপেন জায়গায় সিগারেট খাওয়া কিন্তু নারী-পুরুষ সবার জন্যই নিষেধ। এটা কিন্তু একটা অফেন্স। এজন্য আমি অনুরোধ করব, ওপেন যেন কেউ সিগারেটটা না খায়। আর এখন যে রোজার সময় সবাইকে একটু সংযমী হতে হবে। বাইরে যেন কেউ খাবারটা না খায় এ বিষয়ে আমাদের ধর্ম উপদেষ্টাও কিন্তু রিকোয়েস্ট করছে। এটা যারা রোজা থাকতেছে তাদের জন্য একটা সম্মান প্রদর্শন করা।”
সোমবারের বিক্ষোভে অংশ নেওয়া লামিয়া ইসলাম নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, “এই ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্রে কী করে মেয়েদের গায়ে হাত তোলার মতো নেক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে মব করে? এটা যদি আপনারা বলে থাকেন, মেয়েটা যদি কোনো অন্যায় করেও থাকে সেটা একটা সিভিল অফেন্স। কিন্তু গায়ে হাত তোলা সরাসরি ক্রিমিনাল অফেন্স।”
“একটা ক্রিমিনাল অফেন্সকে তারা কীভাবে জাস্টিফাই করে একটা গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে, সেটা আসলে আমাদের মাথায় আসে না। এ ধরনের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এবং এ ধরনের গভর্নমেন্ট বডির কাছে আমরা নারীরা নিরাপদ বোধ করছি না।”
তিনি বলেন, “আমরা অবিলম্বে তার (স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার) পদত্যাগ চাচ্ছি। যদি এটার ব্যতিক্রম ঘটে, আমরা অবশ্যই সেই সচিবালয়ের ইট খুলে নিয়ে আসব। আমরা ঘরে বসে থাকার জন্য জন্মাইনি। আমরা রাষ্ট্র পরিবর্তন করেছি, আমরা আওয়ামী লীগের মতো সরকারের পতন ঘটিয়েছি। আমরা এ সরকারেরও পতন করিয়ে ছাড়ব। আমাদের জন্য নিরাপদ রাষ্ট্র বানিয়ে ছাড়ব।”
জুলাই অভ্যুত্থানে নারীদের অবদান তুলে ধরে তিনি আরও বলেন, “প্রতিটা সময়েই আন্দোলনে মেয়েরা ছিল ফ্রন্টে। অথচ অভ্যুত্থানের পরে আমরা কী চিত্রটা দেখতে পাচ্ছি? আমরা দেখতে পাচ্ছি মেয়েদেরকে কর্নার করে দেওয়া হচ্ছে। মেয়েদের কোনো অবদান কোথাও যেন নাই। উপদেষ্টা দুইজন নারী আছেন, তারা কি নিজেদের নিরাপত্তা পেয়ে দেশের আপামর নারীদের নিরাপত্তা দেওয়ার প্রয়োজন মনে করছেন না? তাহলে আমরা গভীরভাবে তাদেরকে ধিক্কার জানাচ্ছি।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সীমা আক্তার বলেন, “জুলাই অভ্যুত্থানের পরবর্তি সময়ে রাজনৈতিক টুল হিসেবে নারীদেরকে বিভিন্নভাবে নিপীড়নের শিকার হতে হচ্ছে। এই নিপীড়নের শিকার হওয়া এবং যে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ পুলিশের আইজিপি এবং স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে আমরা বার বার বলে যাচ্ছি, আমাদের নিরাপত্তা দেন। এইটুকু দিতেও তারা ব্যর্থ।”
“এই লালমাটিয়ার ঘটনায় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন ‘এটাতো সবার জন্যই সমান’। এর মাধ্যমে বোঝা যায়, সেদিন যে মবটা হয়েছে নারীদের বিরুদ্ধে, তিনি এই মবের আরেকটা উস্কানিদাতা। আমরা এটার বিরোধিতা করি, এই প্রতিবাদে আজকে জড়ো হয়েছি।”
তিনি বলেন, “স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ আমাদের এক দফায় পরিণত হয়েছে। তার কুশপুত্তলিকা দাহ করে আমরা তার আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।”
আদৃতা রায় নামে আরেক শিক্ষার্থী বলেন, “এখানে দুইদিন আগে আমাদের দুই বোন, দুই শিক্ষার্থী মবের শিকার হয়েছে। শুধু একটি ঘটনাই নয়, ৫ অগাস্টের পর থেকে, এমনকি অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করল যবে থেকে, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা একবার বদলানোর পর থেকেও সারা দেশজুড়ে ছিনতাই-ডাকাতি, খুন, ধর্ষণ, নিপীড়ন, মব জাস্টিসের মতো ঘটনাগুলি ঘটেই চলেছে।”
তিনি বলেন, “আমরা যে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে অংশ নিয়েছি, আমাদের কিছু স্বপ্ন ছিল, কিছু আশা ছিল। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি এ অভ্যুত্থানের পর আমরা যারা সম্মুখসারির অংশগ্রহণকারী ছিলাম, আমাদের যে বিন্দুমাত্র নিরাপত্তা নিশ্চিতের দায়িত্ব ছিল এই সমন্বয়কদের, এই রাষ্ট্রের, এই উপদেষ্টাদের। তারা তার এক ফোঁটাও করতে পারেনি।”
“সে জায়গা থেকে আমরা ‘ধর্ষক ও নিপীড়কের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ’ প্ল্যাটফর্ম থেকে এর আগে একটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অভিমুখে গণপদযাত্রার আয়োজন করি। পুলিশ ধর্ষকদের ধরতে পারে না, মব ঠেকাইতে পারে না, চোর ধরতে পারে না। কিন্তু ওই মিছিলে ঠিকই তারা বাধা দেয়। সেই বাধায় আমাদের বেশ কয়েকজন সহযোদ্ধা আহতও হন।”
আদৃতা বলেন, “আমরা একটি মশাল মিছিল করি আবারও। আমরা স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীরকে সময় বেঁধে দেই, আপনি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পদত্যাগ করেন, ক্ষমা চান আমাদের কাছে। তিনি তা করেননি। ফলে তার পদত্যাগের আর কোনো প্রশ্ন নাই। তাকে এখন অপসারণ করতেই হবে।”