২০১৯ সালে এরশাদের মৃত্যুর পর থেকেই বিদিশা সিদ্দিক এবং এরশাদের গঠিত ট্রাস্টি বোর্ডের মধ্যে টানাপড়েন চলছে।
Published : 22 Jan 2025, 10:18 PM
প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ছেলে শাহাতা জারাব এরিক এরশাদ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বরাবর চিঠি দিয়ে ‘এরশাদ ট্রাস্ট’ বেদখলের অভিযোগ তোলার পর সংবাদ সম্মেলন ডেকে এরশাদের রেখে যাওয়া সম্পত্তি বেদখলের পাল্টা অভিযোগ তুলেছে ট্রাস্টের সদস্য ও সাবেক চেয়ারম্যান কাজী মামুনুর রশীদ।
বুধবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে ওই সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ট্রাস্টের পক্ষ থেকে এরশাদ পুত্র এরিকের খরচ বাবদ প্রতিমাসে বনানীর কুয়েত মৈত্রী মার্কেটে একটি দোকান, গুলশান ও বনানীতে দুটি ফ্লাট থেকে পাওয়া ভাড়া মিলিয়ে প্রায় তিন লাক বিশ হাজার টাকা দেওয়া হয়।
“কিন্তু সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদের তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রী বিদিশা সিদ্দিক তার ছেলে এরিক এরশাদের ভরণ-পোষণের উসিলায় প্রতি মাসে মোটা অংকের অর্থ দাবি করে আসছেন আমাদের কাছে। বিদিশা সিদ্দিক এক প্রকার জিম্মি করে রেখেছেন এরিক এরশাদকে। ইতোপূর্বে এরিকের বন্দিদশার একটি অডিও বার্তা ও লিখিত পত্র আমরা গণমাধ্যমে প্রকাশ করেছি।”
জাতীয় পার্টি মহাসচিব (রওশন এরশাদপন্থি) কাজী মামুন বলেন, জীবিত থাকা অবস্থায় এরশাদ ও তার গঠিত অধিভুক্ত ট্রাস্ট সম্পদে সাবেক স্ত্রী বিদিশা সিদ্দিককে কোনো অধিকার দেওয়া হয়নি।
“তার মৃত্যুর পর বিদিশা সিদ্দিক আইনি জটিলতার কারণে ট্রাস্টি বোর্ডকে কব্জায় নিতে না পারলেও এর অধিকাংশ সম্পদ বর্তমানে দখলে রেখেছে।"
বিদিশা সিদ্দিকের হাত থেকে এরশাদ ট্রাস্টকে মুক্ত করতে প্রশাসনসহ জাতীয় পার্টির সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের সজাগ থাকতে ও সহযোগিতা করার আহ্বান জানান মামুন।
তিনি বলেন, ২০১৯ সালের ৭ এপ্রিল সম্পাদিত এক দলিলে ট্রাস্ট গঠন করে এরশাদ তার বিষয়-সম্পত্তির বড় অংশ সেখানে দান করেন। ট্রাস্টের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে, ছেলে শাহাতা জারাব এরিকের ভরণ-পোষণ ও জনহিতকর কাজে ব্যয় হবে সম্পত্তি থেকে অর্জিত আয়।
“বিদিশা ট্রাস্টের আয় ভোগ ও কর্মকাণ্ডে অংশীদার হতে পারবেন না। তিনি এমন দাবি করলে তা আইনের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য হবে না। কিন্তু এরশাদের মৃত্যুর চারমাস পরই পুত্র এরিককে খাওয়ানোর কথা বলে বারিধারা প্রেসিডেন্ট পার্কে ঢোকেন বিদিশা সিদ্দিক। নিকেতনে তার নিজস্ব ফ্ল্যাট থাকলেও তিনি আর প্রেসিডেন্ট পার্ক থেকে বের হননি। এরপর পর্যায়ক্রমে প্রেসিডেন্ট পার্কের পুরোনো সকল কর্মচারীকে তিনি বিদায় করে দেন।"
কাজী মামুনের পাশাপাশি এরশাদ ট্রাস্টি বোর্ডের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ফখরুজ্জামান জাহাঙ্গীর ও সদস্য মনিরুজ্জামান টিটুও সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।
লিখিত বক্তব্যে কাজী মামুন বলেন, বারিধারা প্রেসিডেন্ট পার্কের ৭ হাজার ৪২ বর্গফুটের ফ্ল্যাট ও পার্কিং, গুলশানের ৯৬ নম্বর সড়কের ৪/বি বাড়ির ২ হাজার ৭১ বর্গফুটের ফ্ল্যাট, বনানীতে আল নাহিয়ান ট্রাস্টের সংযুক্ত আরব আমিরাত মৈত্রী শপিং কমপ্লেক্সের এক হাজার ৬০ বর্গফুটের দোকান, রংপুরের ‘পল্লীনিবাস’, রংপুরের মিঠাপুকুরের ‘পল্লীবন্ধু কোল্ড স্টোরেজ, ১৫ কোটি ৯ লাখ টাকার স্থায়ী ব্যাংক আমানত, সঞ্চয়, শেয়ার এবং পাঁচটি গাড়ি ট্রাস্টে দান করেন এরশাদ। বাকি সম্পদ স্ত্রী রওশন এরশাদ এবং বড় ছেলে রাহগীর আল মাহী এরশাদ শাদকে দিয়ে গেছেন সাবেক এ রাষ্ট্রপতি।
“২০২২ সালের ১৪ অগাস্টের পর থেকে এরশাদের রেখে যাওয়া ব্যাংক থেকে আমরা কোনো অর্থ উত্তোলন করিনি। দুটি ব্যাংকে প্রায় তিন কোটি টাকা ইতোমধ্যে মূল টাকায় যোগ হয়েছে। এছাড়া ট্রাস্টের অসিয়তনামায় বিভিন্ন জনহিতকর কাজ ও সামাজিক কর্মকাণ্ডের কথা বলা হলেও তা আমি নিজ অর্থায়নে করেছি। এরশাদের রেখে যাওয়া একটি টাকাও উত্তোলন করিনি।
“এরিকের ভরণ-পোষণের জন্য শুধুমাত্র একটি ব্যাংক থেকে কিছু লভ্যাংশ উত্তোলন করা হয়েছে। আমরা ব্যাংকে চিঠি দিয়ে লেনদেন বন্ধ রেখেছি। যাতে অবৈধভাবে কেউ অর্থ উত্তোলন করতে না পারে।”
তিনি বলেন, “প্রেসিডেন্ট পার্ক দখলের মাধ্যমে এরশাদের রেখে যাওয়া অর্থের জন্য আমাদের একের পর এক হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন বিদিশা সিদ্দিক ও তার নিযুক্ত কিছু সন্ত্রাসী বাহিনী। এরশাদের মৃত্যুর পর থেকে তিনি অপ্রাপ্তবয়স্ক শারীরিক প্রতিবন্ধী ছেলেকে দেখভালের নাম করে ট্রাস্টকৃত সম্পদে নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও জোরপূর্বক বসবাস করছেন। এরপর থেকেই প্রেসিডেন্ট পার্কে শুরু হয়েছে অসামাজিক ও অনৈতিক কর্মকাণ্ড।”
বিদিশা সিদ্দিকের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কিনা জানতে চাইলে কাজী মামুন বলেন, “আমরা প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে অভিযোগ করেছি। এরিক এরশাদও অভিযোগ করেছেন। উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠিত হয়েছে। তাই তদন্তাধীন এ বিষয়ে আপাতত আমরা কোনো মন্তব্য করছি না। তবে এতটুকু বলতে পারি আমরা আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি।”
আরেক প্রশ্নের জবাবে মামুনুর রশিদ বলেন, “ট্রাস্ট পুনর্গঠনের স্বার্থে আমি ট্রাস্টের সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করেছি। আমরা চাই, এই হস্তক্ষেপ, জবরদখল বন্ধ হোক। ট্রাস্ট নিয়মমাফিক চলুক। পারিবারিকভাবে এটার সুরাহা হোক।”
কাজী মামুনের অভিযোগের বিষয়ে বিদিশা সিদ্দিকের বক্তব্য বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম জানতে পারেনি। তবে ২০১৯ সালের ১৪ জুলাই এরশাদের মৃত্যুর পর থেকেই বিদিশা সিদ্দিক এবং এরশাদের গঠিত ট্রাস্টি বোর্ডের মধ্যে টানাপড়েন চলছে।
বিদিশা সিদ্দিক বলছেন, তার প্রতিবন্ধী ছেলের দেখাশোনার ঘাটতির কারণে তিনি জেনারেল এরশাদের ভবন প্রেসিডেন্ট পার্কে অবস্থান করছেন। অন্যদিকে ট্রাস্টি বোর্ড থেকে বলা হচ্ছে, বিদিশা ‘অবৈধভাবে’ প্রেসিডেন্ট পার্কে অবস্থান করছেন।
কাজী মামুন ‘এরশাদ ট্রাস্ট’ জোর করে দখলে রেখেছেন-এমন অভিযোগ তুলে প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ চেয়ে মঙ্গলবার স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বরাবর চিঠি দেওয়া হয় এরিক এরশাদের নামে। ওই চিঠি সংবাদমাধ্যমে পাঠান বিদিশা সিদ্দিক।
সেখানে বলা হয়, “আমি শাহাতা জারাব এরিক এরশাদ, সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সন্তান। আমার ভবিষ্যৎ জীবনযাপনের নিরাপত্তার জন্য আমার পিতা ‘হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ট্রাস্ট’ গঠন করেন, যার একমাত্র সুবিধাভোগী আমি। অতি সম্প্রতি (১০ জানুয়ারি) অবগত হই, ট্রাস্টের অবৈধ ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ফখর-উজ-জামান জাহাঙ্গীর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জনপ্রশাসন বিভাগে আমার নিরাপত্তা ও ট্রাস্টের নীতিমালা রক্ষার্থে প্রশাসনিক হস্তক্ষেপের জন্য একটি আবেদন দাখিল করেছেন।
‘আপনাদের অবগতির জন্য জানাতে চাই, আমি সম্পূর্ণ নিরাপদ এবং কোনো ঝুঁকির মধ্যে নেই। ইতোমধ্যে আমি পুলিশ, সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন প্রশাসনিক দপ্তরে পত্রের মাধ্যমে ট্রাস্টের সাবেক চেয়ারম্যান কাজী মামুন ও বর্তমান অবৈধ ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ফখর-উজ-জামান জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে ট্রাস্ট-সংক্রান্ত অনিয়মের বিষয়ে অভিযোগ জানিয়েছি।”
চিঠিতে বলা হয়, “গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, ২০২৪ সালের ২ ডিসেম্বর বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে জানতে পারি, কাজী মামুন শারীরিক অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে ট্রাস্টের চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন এবং ফখর-উজ-জামান জাহাঙ্গীরকে অবৈধ ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে মনোনীত করেছেন; যা আমার অগোচরে এবং যথাযথ রেজুলেশন বা সদস্যদের মতামত গ্রহণ ছাড়াই সম্পন্ন হয়েছে।
“বর্তমানে ট্রাস্টের নির্ভরযোগ্য আয়ের অভাবে আমি কেবল দুটি অ্যাপার্টমেন্ট ও একটি দোকান ভাড়ার ওপর নির্ভরশীল, যা আমার দৈনন্দিন খরচ মেটানোর জন্য যথেষ্ট নয়। ফলে আমাকে নিয়মিতভাবে মায়ের কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা নিতে হচ্ছে। অথচ, কাজী মামুন ও ট্রাস্টের অন্যান্য সদস্যরা আমার মায়ের বিরুদ্ধে বিভ্রান্তিমূলক মন্তব্য ছড়িয়ে আমার ওপর মানসিক চাপ সৃষ্টি করছেন। আমার মায়ের কাছ থেকে আমাকে দূরে রাখার ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছেন। এমতাবস্থায়, আমার দৈনন্দিন জীবন পরিচালনা ও চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।”
এরিকের নামে পাঠানো ওই চিঠিতে বলা হয়, “যদি আমার শারীরিক বা মানসিক কোনো ক্ষতি হয়, তার সম্পূর্ণ দায়ভার কাজী মামুন ও সংশ্লিষ্ট ট্রাস্ট সদস্যদের ওপর বর্তাবে। আমি একাধিকবার কাজী মামুন এবং ফখর-উজ জামান জাহাঙ্গীরের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তারা সব সময় সময়ক্ষেপণ ও তালবাহানা করছেন। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ট্রাস্টের হিসাব বুঝিয়ে দিচ্ছেন না।”
ট্রাস্টের স্বচ্ছতা নিশ্চিতসহ এরিকের ভবিষ্যৎ সুরক্ষায় কাজী মামুনসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ট্রাস্টের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া এবং ট্রাস্টের ব্যাংক হিসাব স্বাভাবিক করতে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার হস্তক্ষেপ চাওয়া হয়েছে চিঠিতে।
সেখানে বলা হয়েছে, “ট্রাস্টের মেয়াদ ২০২১ সালের ডিসেম্বরে শেষ হয়েছে। ট্রাস্টের একমাত্র সুবিধাভোগী হওয়া সত্ত্বেও গত দুই বছর ধরে আমি ট্রাস্টের ব্যাংক হিসাব থেকে কোনো অর্থ উত্তোলন করতে পারিনি। বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও কাজী মামুন ট্রাস্টের আয়-ব্যয়ের হিসাব এবং সম্পদের সঠিক তথ্য প্রদান করেননি।”