তদন্তের কোনো কূল-কিনারা নেই; তদন্ত কর্মকর্তা কে, তাও জানেন না বাদী; আদালতে পুলিশের প্রতিবেদনেও নেই অগ্রগতির কোনো ইঙ্গিত- এই অবস্থায় ঝুলে আছে রাজধানীর গোপীবাগের ছয় খুনের মামলা।
Published : 13 May 2015, 07:25 PM
দেড় বছর আগে ঘরে ঢুকে কথিত পীর লুৎফর রহমান ফারুকসহ ছয়জনকে গলাকেটে হত্যার পর জঙ্গিদের দিকেই সন্দেহের ইঙ্গিত করেছিলেন মামলার তদন্তকারী ডিবি পুলিশের কর্মকর্তারা।
এরপর বিভিন্ন সময় জেএমবি সদস্য সন্দেহে আটক চারজনকে এই মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। কিন্তু তারপর আর কোনো অগ্রগতি নেই।
এর মধ্যে একই কায়দায় খুন করা হয় গত বছরের অগাস্টে ইসলামী ফ্রন্টের নেতা নুরুল ইসলাম ফারুকীকে। তার খুনের তদন্তেও কোনো অগ্রগতি দেখাতে পারেনি পুলিশ।
ব্লগারদের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ছয় খুন এবং ফারুকী হত্যাকাণ্ডে যোগসূত্র রয়েছে বলে দাবি করে আসছেন গোয়েন্দারা। কিন্তু ব্লগার আহমদ রাজীব হায়দার হত্যাকাণ্ডের মামলা বাদে অন্য কোনোটিই আদালতে গড়ায়নি এখনও।
ছয় খুনের মামলার বাদী আবদুল্লাহ আর ফারুকের কাছে মামলার অবস্থা জানতে চাইলে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “৬/৭ মাস আগে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আমার সঙ্গে দেখা করেছিলেন, তারপর আর যোগাযোগ নেই। কোনো অগ্রগতি হলে তো জানতাম।
“১২ থেকে ১৫ বার আমি গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে গিয়ে আমার জানা সমস্ত তথ্য তদন্ত কর্তৃপক্ষকে দিয়ে এসেছিলাম। তারপর সব নীরব।”
২০১৩ সালের ২১ ডিসেম্বর হত্যাকাণ্ডের পর লুৎফরের ছেলে ফারুক বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে মামলা করেন। মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব নেন মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পরিদর্শক আবুয়াল খায়ের মাতুব্বর।
কয়েকমাস আগে পদোন্নতি পেয়ে পুলিশের বিশেষ শাখায় (স্পেশাল ব্রাঞ্চ) বদলি হয়েছেন খায়ের। নতুন তদন্ত কর্মকর্তা কে, তা জানা নেই বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জিজ্ঞাসায় বলেছেন তিনি।
তদন্ত কোন পর্যায়ে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “কয়েকজন সাক্ষীর ১৬১ ধারার জবানবন্দি নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এখন মামলাটির তদন্ত কী পর্যায়ে রয়েছে, তা বলতে পারছি না।”
মামলার বাদী ফারুক বলেন, “পুরানো তদন্ত কর্মকর্তা বদল হয়ে নতুন কেউ এসেছে কি না, তা আমি বলতে পারব না।”
নতুন তদন্ত কর্মকর্তার বিষয়ে জানতে চাইলে গত সপ্তাহে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “বিষয়টি খোঁজ নিয়ে পরে জানাতে পারব।”
এরপর কয়েকদিনে কয়েকবার তাকে কল করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
গত বছরের অগাস্টে ফারুকী হত্যাকাণ্ডের পর মনিরুল সাংবাদিকদের বলেছিলেন, “দুটি হত্যাকাণ্ডই (ধর্মীয় মতাদর্শের কারণেই ঘটেছে। উগ্রপন্থি ধর্মীয় জঙ্গিগোষ্ঠীই দুটি ঘটনা ঘটিয়েছে।”
মামলার নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, এখন পর্যন্ত নোয়াখালীর হাতিয়ার চরকিন গ্রামের মো. আজমীর ওরফে অমিত (২৯), ঝালকাঠীর নলছিটির দেলদুয়ার গ্রামের মো. গোলাম সরোয়ার রাহাত (২৭), জয়পুরহাটের আক্কেলপুরের কানুপুর গ্রামের সৈয়দ জিয়াউল ইসলাম জিতু ওরফে নীরব ওরফে হিমু ওরফে লিয়ন (২৮), ময়মনসিংহের ত্রিশালের সাউথকান্দা গ্রামের মো. আল আমিনকে (২৮) গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এই চারজনকে দুই দফায় হেফাজতে (রিমান্ড) নিয়ে কয়েকদফা জিজ্ঞাসাবাদও করেছেন আগের তদন্ত কর্মকর্তা আবুয়াল খায়ের। কিন্তু রিমান্ড ফেরতের প্রতিবেদনে তদন্তে অগ্রগতির দিক-নির্দেশনামূলক কোনো বক্তব্য ছিল না তার।
গতানুগতিক ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, “জিজ্ঞাসাবাদে আসামিরা মামলা সংক্রান্ত বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদান করেছে, তাদের দেওয়া তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।”
তদন্তে কোনো অগ্রগতি না থাকায় মামলাটি আদালতে উঠছে, আর তারিখের পর তারিখ পার হচ্ছে।
মামলার বাদী ফারুখ মামলার এই অচলাবস্থা কাটার বিষয়ে সরকারের হস্তক্ষেপ প্রত্যাশা করেছেন।
লুৎফরের (৬০) বাড়িতে সেদিন সন্ধ্যায় তার ছেলে মনির হোসেন (৩০), খাদেম মঞ্জু (৩০) এবং তিন মুরিদ মজিবর রহমান (৩০), শাহীন (২৫) ও রাসেলকে (২৫) হত্যা করা হয়।
এজাহার অনুযায়ী, সেদিন সন্ধ্যায় রাজধানীর গোপীবাগের রামকৃষ্ণ মিশন রোডের ওই বাড়িতে ৮ ব্যক্তি মুরিদ সেজে ঢুকেছিল। লুৎফরের সঙ্গেই তারা মাগরিবের নামাজ পড়েছিলেন। এরপর তারা পরিবারের নারী সদস্য ও শিশুদের একটি ঘরে আটকে রেখে ছয়জনকে হত্যার পর ছুরির রক্ত বাথরুমে ধুয়ে-মুছে ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে যায়।
নুরুল ইসলাম ফারুকীর বাসায়ও একই কায়দায় ঢুকে হত্যা করা হয়েছিল। সিলেটে মঙ্গলবার অনন্ত বিজয় দাশ এবং তার আগে ব্লগারদের হত্যার সময়ও চাপাতিই ব্যবহার করেছিল দুর্বৃত্তরা।
গোয়েন্দারা বলছেন, লেখালেখির কারণে ব্লগারদের যেভাবে ‘ধর্মবিরোধী’ হিসেবে মনে করে উগ্রপন্থিরা। ধর্মবিষয়ক বিভিন্ন ব্যাখ্যার কারণে ফারুকী কিংবা লুৎফরকেও একই দৃষ্টিতে দেখছিল তারা।