যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় কার্যকরের ক্ষেত্রে রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ পর্যন্ত অপেক্ষা করার প্রয়োজন আছে বলে মনে করছেন না রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা।
Published : 05 Nov 2014, 05:18 PM
বুধবার নিজের কার্যালয়ে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, “এটা আমার ব্যক্তিগত অভিমত। জেল কর্তৃপক্ষ রায় কার্যকরের ক্ষেত্রে পূর্ণাঙ্গ রায় দেখবে না, দেখবে কী আদেশ দেওয়া হয়েছে। ট্রাইব্যুনালে একটি পূর্ণাঙ্গ রায় হয়েই আছে। আপিল বিভাগ সেটাকেই বহাল রেখেছে। সেক্ষেত্রে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের কী প্রয়োজন?”
একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে আপিল বিভাগের রায়েও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের সামনে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার সুযোগ থাকলেও রায় পর্যালোচনার (রিভিউ) কোনো সুযোগ নেই বলেও মত দেন তিনি।
এর আগে গতবছর ১৭ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগে যুদ্ধাপরাধ মামলার প্রথম রায়ে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার সাজা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড থেকে বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড দেয়। প্রায় আড়াই মাস পর পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ হয় এবং সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে সাজা কার্যকর হয় ১২ ডিসেম্বর রাতে।
কামারুজ্জামানের ক্ষেত্রে যেহেতু আপিলে সাজা পরিবর্তন হয়নি, সেহেতু পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশের জন্য অপেক্ষার প্রয়োজন আছে কি-না, সেই প্রশ্ন তুলেছেন মাহবুবে আলম।
কামারুজ্জামানের রায় ‘রিভিউয়ের’ আবেদন করা হবে জানিয়ে তার আইনজীবী ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন সংবাদ সম্মেলন করার ঘণ্টাখানেক পর সাংবাদিকদের সামনে আসেন অ্যাটর্নি জেনারেল।
হাই কোর্টে আইনজীবী সমিতির মিলনায়তনে ওই সংবাদ সম্মেলনে খন্দকার মাহবুব বলেন, কামারুজ্জামানের আপিলে দ্বিধাবিভক্ত রায়ে মৃত্যুদণ্ড বহাল থেকেছে। সংবিধানের ১০৫ ধারা অনুযায়ী এ রায় রিভিউয়ের সুযোগ রয়েছে।
“যদি ১০৫ ধারার ক্ষমতা এই বিচারের ক্ষেত্রে কার্যকর না-ও হয়, তবুও ন্যায় বিচারের স্বার্থে দেশের সর্বোচ্চ আদালত এ আবেদন শুনবেন বলে মনে করি।”
এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে অ্যাটর্নি জেনারেল তার কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সামনে সংবিধানের ৪৭(ক) ধারাটি পড়ে শোনান।
“পুরোটাই আমি পড়ছি। যে ব্যক্তির ক্ষেত্রে ৪৭ অনুচ্ছেদে তিন দফায় বর্ণিত কোনো আইন প্রযোজ্য হয় না, সেই ব্যক্তির ক্ষেত্রে সংবিধানের ২৯ অনুচ্ছেদ, ৩৫ অনুচ্ছেদের ১ ও ৩ দফা এবং ৪৪ অনুচ্ছেদে নিশ্চিতকৃত অধিকারসমূহ প্রযোজ্য হবে না। এখানে সংবিধানে বর্ণিত মৌলিক অধিকারগুলোর কথা বলা হয়েছে।
“২-তে বলা আছে, এছাড়াও এ সংবিধানে যা বলা হয়েছে তা সত্ত্বেও যে ব্যক্তির ক্ষেত্রে ৪৭ অনুচ্ছেদের ৩ দফায় বর্ণিত কোনো আইন প্রযোজ্য হয়, এই সংবিধানে বর্ণিত কোনো অধিকারের জন্য সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করার অধিকার তাদের থাকবে না। ৪৭ এর ৩ ধারা হলো- মানবতাবিরোধী অপরাধের ক্ষেত্রে যারা অভিযুক্ত তাদের জন্য।
“যেখানে এই ধারায় বলা আছে যে, এই অনুচ্ছেদ প্রযোজ্য হলে সংবিধানে বর্ণিত কোনো অধিকারের জন্য সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করার অধিকার তাদের থাকবে না, সেখানে কীভাবে বলা হয় যে আপিল রিভিউ করার ক্ষমতা তাদের রয়েছে?”
এরপরেও ‘শুধু সময়ক্ষেপণের জন্য’ রিভিউয়ের কথা বলা হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন অ্যাটর্নি জেনারেল।
“যারা বলছে ১৯৫ জন পাকিস্তানী সেনাকে ফিরিয়ে এনে বিচার করতে হবে তাদের কাছে জানতে চাই, এই আইনে কোথাও কি বলা আছে যে তাদের বিচার না করা হলে অন্যদের বিচার করা যাবে না?
“একটা সাধারণ ব্যাপার হলো, যদি কোনো অপরাধে ২০ জন জড়িত থাকে, তাদের মধ্যে তিনজন পালিয়ে যায়, তাহলে কি বাকি ১৭ জনের বিচার করা যাবে না?”
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মাহবুবে আলম বলেন, “আপিল বিভাগের ১০৪ ধারায় ন্যায়বিচারের কথা বলা হয়েছে। যারা শাস্তি পেয়েছেন তারা ন্যায় বিচারের সম্পূর্ণ সুযোগ পেয়েছেন, তাদের ধরেই শাস্তি দেওয়া হয়নি। তারা পূর্ণ বিচারের সুযোগ পেয়েছেন, আপিলের সুযোগ পেয়েছেন।
“যারা মা হারিয়েছে, বাবা হারিয়েছে, সন্তান হারিয়েছে তাদেরও তো ন্যায় বিচার পেতে হবে। ন্যায়বিচার একটি আপেক্ষিক বিষয়। যারা ৪৩ বছর ধরে এ বিচারের জন্য অপেক্ষা করে আছেন, তাদেরও তো ন্যায়বিচার দিতে হবে।”
ট্রাইব্যুনাল আইন অনুযায়ী কামারুজ্জামানের রায় কার্যকরের ক্ষেত্রে কারাবিধি প্রযোজ্য হবে না বলেও মত দেন অ্যাটর্নি জেনারেল।
“এক্ষেত্রে জেল কোড প্রযোজ্য হবে না। কীভাবে রায় কার্যকর করা হবে সে সিদ্ধান্ত সরকার নেবে। সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই রায় কার্যকর করা হবে।”
কাদের মোল্লার রায় বাস্তবায়নের সময়ই রিভিউ নিয়ে প্রথম জটিলতা দেখা দেয়। ওই রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউয়ের সুযোগ চান কাদের মোল্লা। পাশাপাশি রায় রিভিউ করে খালাসও চান তিনি।
এ নিয়ে দুই পক্ষের বক্তব্য শুনে আপিল বিভাগ কাদের মোল্লার পক্ষে করা দুটি আবেদনই একসঙ্গে খারিজ করে দেয়। ওই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি এখনো প্রকাশিত না হওয়ায় এ ধরনের মামলায় রিভিউ চলবে কি-না, সে অস্পষ্টতা এবারও কাটেনি।