হেরিটেজ হিসেবে সংরক্ষণের সরকারি নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ভয় দেখিয়ে পুরান ঢাকার শাঁখারী বাজারে একটি সম্পত্তিসহ মন্দির দখলের অভিযোগ উঠেছে সরকার সমর্থক সংগঠন স্বেচ্ছাসেবক লীগের স্থানীয় এক নেতার বিরুদ্ধে।
Published : 03 Jul 2014, 08:58 PM
এলাকাবাসীর অভিযোগ, দলীয় প্রভাব ও ভয় দেখিয়ে ইতিমধ্যে ওই ভবনটির ভাড়াটেদের উচ্ছেদ করেছেন ঢাকা মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগ (দক্ষিণ) এর সভাপতি দেবাশীষ বিশ্বাস।
শাঁখারী বাজার এলাকার ১৪ নম্বর ভবনটির ২য় তলায় ‘শ্রী শ্রী কালা চাঁদ দেবের’ একটি মন্দির রয়েছে। ভবনের অন্যান্য অংশে বাস করছেন অন্তত ১০টি পরিবার।
শাঁখারী বাজারের ১৪২ টি সংরক্ষিত (হেরিটেজ) ভবনের মধ্যে রয়েছে ১৪ নম্বর ভবনটিও, যেগুলো ইতিমধ্যে সরকারি গ্যাজেটভুক্ত হয়েছে।
মন্দিরের পুরোহিত বিজয় ভট্টাচার্য বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই মন্দিরটি দেবোত্তর সম্পত্তি। আমরা কয়েক পুরুষ ধরে এই মন্দিরে পূজা দিয়ে আসছি। আমার বাবা পুরোহিত ছিলেন, এরপর আমার দাদা (ভাই) আর এখন আমি পূজা দেই।
“দেবাশীষদা বেশ কয়েকদিন ধরে আমাকে নক করছেন। পরে আমাকে না পেয়ে আমার বড় ভাইকে গত সোমবার ডেকে নিয়ে যান। তাকে ভয় ভীতি দেখিয়ে বাড়ি ছাড়তে বলে এবং তার হাতে ৩ লাখ টাকা দেয়া হয়।”
বিজয় বলেন, “তিনি (দেবাশীষ) এলাকায় অনেক প্রভাবশালী, তার সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।”
যে পরিবারগুলো এতদিন ভবনটিতে থেকে আসছিলেন তাদের সবাইকে ভয় দেখিয়ে উচ্ছেদ করা হয়েছে বলে জানান বিজয়।
“এখন আমাদের পরিবার সহ ৩টি পরিবার এ ভবনটিতে থাকছে। কিন্তু আমরাও কতদিন থাকতে পারবো তা জানি না।”
শাঁখারী বাজারকে প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকা হিসেবে গড়ে তোলার জন্য ২০০৯ সালে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের ২০ কোটি টাকায় একটি প্রকল্প চালু হয়। এর আওতায় শাঁখারী বাজারের ঝুকিপূর্ণ ভবনগুলোর সংস্কার এবং পয়নিষ্কাশনসহ আধুনিক সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করার কথা ছিলো। কিন্তু তা আর হয়নি।
শাঁখারী বাজার এলাকার আরো কয়েকজনের সাথে কথা বললে তারাও অভিযোগ করেন দেবাশীষের বিরুদ্ধে।
তবে এদের কেউই ভয়ে নাম প্রকাশ করে কিছু বলতে চান নি।
এলাকার এক প্রবীণ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি যতটুকু জানি এটি একটি হেরিটেজ। প্রায় ৫ বছর আগে একবার এটি ভাঙ্গার কথা হয়েছিলো। কিছু অংশ ভেঙ্গেও ফেলা হয়, সেসময় সরকার পুরো এলাকাকে হেরিটেজ ঘোষণা করায় তা বন্ধ হয়ে যায়।
“গত কয়েকদিন ধরে আবারও এ ভবনটি ভাঙ্গার একটি চক্রান্ত হচ্ছে যার সাথে একজন সরকার সমর্থক নেতা জড়িত। ভবনের বাসিন্দাদের ইতিমধ্যে ভয় ভীতি দেখিয়ে বের করে দেয়া হয়েছে। এখন পুরোহিত সহ দুটি পরিবার রয়েছে। তাদেরকেও ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে।”
“তার পরিবারের কেউই এখানে থাকে না। জানকী দেবীর উইল অনুসারে এটি মন্দিরের সম্পত্তি। এটি সংস্কার করা যাবে, তবে ভাঙা যাবে না।”
শাঁখারী বাজারের পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি অজয় কুমান নন্দী বলেন, “আমরা যতোদূর জানি যারা ডেভেলপার তারা রাজউকের অনুমতি নিয়ে সেখানে বহুতল ভবন নির্মাণ করতে চাইছে।”
রাজউক কোন ভবন ভাঙার অনুমতি দিয়েছে কিনা জানতে চাইলে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শফিউল হান্নান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “না, এ ধরনের কোন অনুমতি রাজউক দেয় নি। শাঁখারী বাজার পুরো এলাকাটি হেরিটেজ ঘোষণা করা হয়েছে। আইন অনুসারে এ এলাকার কোন ভবন ভাঙা যাবে না। তবে রাজউকের অনুমতি নিয়ে মূল নকশা ঠিক রেখে সংস্কার করা যাবে।”
কোন ভবন ভাঙা হলে সেটি শাস্তিমুলক অপরাধ বলে জানান তিনি।
“ভবনটি ভাঙার একটি পরিকল্পনা করা হচ্ছে এটি শোনার পরে আমি লোক পাঠিয়েছিলাম কিন্তু তেমন কিছু চোখে পড়ে নি। এ ভবনগুলো এমনিতেই অনেক ঝুকিপূর্ণ। তারপরেও যেহতু সরকার এগুলোকে হেরিটেজ ঘোষণা করেছে আমরা আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করছি যেন কোন ভবন ভাঙা না হয়।”
ঢাকা মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি দেবাশীষ বিশ্বাস নিজের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
তিনি বলেন, “এটা কোন দেবোত্তর সম্পত্তি না। বিশ্বজীত দত্ত ভুলুর পারিবারিক সম্পত্তি সেটি তার পরিবার ডেভেলপারকে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে শুনেছি। এখানে অন্য কারো আপত্তি থাকার কথা না। আমার বিরুদ্ধে এ অভিযোগ সত্যি না। আমি কেন এগুলো করতে যাবো।”
শাঁখারী বাজার এলাকা হেরিটেজভুক্ত হওয়ার ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, “ভাই আমরা তো সমাজ নিয়ে চলি, সমাজের সকলে মিলে যে সিদ্ধান্ত নেয় তা পালনের চেষ্টা করি। আমরা এ এলাকায় কষ্টে মানবেতর জীবন যাপন করি, আমাদের সাংসদ কাজী ফিরোজ রশীদ আশ্বস্ত করেছেন সংস্কৃতি মন্ত্রীর সাথে আলোচনা করবেন।”
ইউএসজি এর প্রধান নির্বাহী তৈমুর আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দীর্ঘদিন ধরে আমরা সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আসছি তারা যেন এ এলাকাটিকে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়। প্রত্নতত্ব এবং স্থাপত্য বিষয়ে এলাকাটির একটি আলাদা গুরুত্ব রয়েছে, এজন্যই এটিকে সংরক্ষণ করা উচিত।”
“আমরা সরকারকে বলেছিলাম যেন লাইভলিহুড বজায় রেখে এ অঞ্চলে সংস্কার চালানো হয়। কিন্তু সরকারের দীর্ঘসূত্রতায় অনেক জটিলতার সৃষ্টি হচ্ছে।”
রাজধানী ঢাকার প্রায় ৪শ’ বছরের পুরনো এ এলাকার নামটি এসেছে শাঁখারীদের পেশা থেকে। শাঁখারীরা বংশগতভাবে শাঁখা তৈরির কাজে নিয়োজিত। শাঁখা, সিঁদুর থেকে শুরু করে পূজার যে কোনো সামগ্রী পাওয়া যায় এ বাজারে। বর্তমানে প্রায় ২০ হাজার হিন্দু বসবাস করছেন শাঁখারী বাজারে।