৭ খুন: গ্রেপ্তার সাবেক ২ র‌্যাব কর্মকর্তা রিমান্ডে

নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনায় হাই কোর্টের আদেশের ছয় দিন পর গ্রেপ্তার হওয়া র‌্যাবের সাবেক দুই কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হেফাজতে পেয়েছে পুলিশ।

মুজিবুল হক পলাশ বিডিনিউজ টোযেন্টিফোর ডটকমবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 May 2014, 09:09 AM
Updated : 17 May 2014, 05:37 PM

এদের একজন লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মারার জামাতা। অন্যজন হলেন মেজর আরিফ হোসেন। দুজনই নারায়ণগঞ্জে র‌্যাব-১১ এ ছিলেন।

শনিবার ভোররাতে ঢাকা সেনানিবাস থেকে গ্রেপ্তারের পর কড়া পাহারায় দুজনকে আনা হয় নারায়ণগঞ্জে। ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে দুপুরে তাদের আদালতে নেয়া হয়।

কড়া নিরাপত্তার মধ্যে সামরিক বাহিনী থেকে অবসরে পাঠানো এই দুই কর্মকর্তাকে হাতকড়া না পরিয়ে আদালতে আনা হলে ক্ষোভ জানান আইনজীবীরা। তখন আদালতের আদেশে হাতকড়া পরানো হয়।

জনাকীর্ণ আদালতে পুলিশি বেষ্টনির মধ্যে থাকা দুজনের দিকে থুথুও ছিটানোর পর আঘাত করতেও উদ্যত হয় জনতা। তবে পুলিশ তাদের হটিয়ে দেয়।

সাত হত্যাকাণ্ডে অভিযোগের মুখে থাকা দুজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিনের হেফাজতে চেয়েছিলেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নারায়ণগঞ্জ ডিবির ওসি মামুনুর রশীদ মণ্ডল।

তবে হাকিম চাঁদনী রূপম পাঁচ দিন রিমান্ডের আদেশ দিলে দুজনকে জেলা পুলিশ লাইনে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলে পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

নিহত কাউন্সিলর নজরুল ইসলামের স্বজনরা বলে আসছেন, র‌্যাবের এই কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করলেই এই হত্যাকাণ্ডের সব রহস্য উদ্ঘাটিত হবে।

নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার খন্দকার মহিদ উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা সর্ব্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে অত্যন্ত সর্তকভাবে এই মামলার তদন্ত কাজ করছি। তদন্ত কর্মকর্তা মামলার স্বার্থে যখন যা করার দরকার, তখন তা তা করবে।”

গত ২৭ এপ্রিল কাউন্সিলর নজরুল ও আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজন একসঙ্গে অপহৃত হলে তা নিয়ে সারাদেশে আলোচনা ওঠে।

তিন দিন বাদে শীতলক্ষ্যা নদীতে তাদের লাশ পাওয়ার পর নজরুলের শ্বশুর শহীদুল ইসলাম অভিযোগ তোলেন, কাউন্সিলর নূর হোসেনের কাছ থেকে ৬ কোটি টাকা নিয়ে র‌্যাব এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।

এরপর হাই কোর্টের একটি বেঞ্চ এই হত্যাকাণ্ডের তদন্তে কমিটি গঠনের নির্দেশ দেয়ার পাশাপাশি আরেকটি বেঞ্চ গত ১১ মে আরেকটি বেঞ্চ র‌্যাবের তিন কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেন।

ইতোমধ্যে র‌্যাব-১১ এর অধিনায়ক তারেক সাঈদ, আরিফ হোসেন ও এম এম রানাকে নারায়ণগঞ্জ থেকে সরিয়ে এনে সামরিক বাহিনীতে ফেরত পাঠানো হয়। সেনাবাহিনী তারেক ও আরিফকে অকালীন অবসরে পাঠায়, লেফটেন্যান্ট কমান্ডার রানাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠায় নৌবাহিনী।

এরপর কয়েকদিনের নানা নাটকীয়তার পর শনিবার ভোররাতে ঢাকা সেনানিবাস থেকে গ্রেপ্তার করে আনা হয় তারেক সাঈদ ও আরিফকে।

তবে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়ায় নৌবাহিনীর সঙ্গে সম্পর্ক পুরোপুরি ছিন্ন হয়ে যায় র‌্যাব-১১ এর নারায়ণগঞ্জ শহরের পুরনো জেলখানা ক্যাম্পের সাবেক প্রধান রানার।

রানাকে এখনো আটক করতে পারেনি পুলিশ। জেলা পুলিশ সুপার বলেন, “আমরা তাকে গ্রেপ্তারে অভিযান চালাচ্ছি। আমরা আশা করছি, অচিরেই তাকে গ্রেপ্তার সম্ভব হবে।”

নারায়ণগঞ্জের এই হত্যাকাণ্ডের পর এই পর্যন্ত ২২ জনকে আটক করেছে পুলিশ, তবে তার মধ্যে মামলার ছয় আসামির কেউ নেই।

এর মধ্যে মামলার তিন নম্বর আসামি হাসমত আলী হাসুকে যশোরে গ্রেপ্তারের খবর প্রথমে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জানালেও পরে অস্বীকার করেন।

আটক ২২ জনের মধ্যে সাতজনকে হত্যামামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়েছে পুলিশ। বাকিদের ৫৪ ধারায় (সন্দেহভাজন) গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। তাদের সঙ্গে যোগ হলেন র‌্যাবের সাবেক দুই কর্মকর্তা।

ক্ষোভ-বিক্ষোভের মধ্যে আদালতে তারা

ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জে আনার পর জেলা পুলিশ লাইনে রাখা হয়েছিল তারেক সাঈদ ও আরিফকে। দুপুর ২টায় কড়া নিরাপত্তার মধ্যে দুজনেক সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট চাঁদনী রূপমের আদালতে আনা হয়।

ছুটির দিনে বিচার প্রার্থী কম থাকলেও কয়েক হাজার উৎস্যুক জনতার উপস্থিতির মধ্যে বিপুল সংখ্যক পুলিশ আদালত চত্বর ঘিরে রাখে। এর মধ্যেই হেলমেট ও বুলেট প্রুফ জ্যাকেট পরিহিত তারেক ও আরিফকে নামানো হয় গাড়ি থেকে।

সাবেক এই দুই র‌্যাব কর্মকর্তাকে হাতকড়া না পরিয়ে আদালতে আনায় আইনজীবীরা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তখন বিচারকের নির্দেশে আদালতের ভেতর দুজনকে হাতকড়া পরানো হয়।

চন্দন সরকার হত্যাকাণ্ডে অভিযোগের মুখে থাকা সাবেক এই র‌্যাব কর্মকর্তাদের পক্ষে কোনো আইনজীবী আদালতে দাঁড়াননি। তারেক সাঈদ নিজেই বক্তব্য রাখেন।  

আইনজীবীদের ক্ষোভ প্রকাশের মধ্যে তারেক সাঈদ বক্তব্যের শুরুতেই বলেন, ‘মিডিয়ার সৃষ্ট’ খবরের কারণে র‌্যাবের প্রতি আইনজীবীরা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন।

এসময় আদালতে থাকা আইনজীবীদের মধ্য থেকে বলা হয়, “আমরা বলিনি র‌্যাব জড়িত। আপনার মতো গুটিকয়েক কর্মকর্তা এই ঘটনা ঘটিয়েছেন। আপনারাই এই ঘটনা ঘটিয়েছেন।”

শুনানিতে তদন্ত কর্মকর্তা মামুনুর রশিদ ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিন হেফাজতের আবেদন জানালে তা নিয়েও আইনজীবীরা ক্ষোভ দেখায়।

রিমান্ডের আবেদনে বলা হয়, সাত খুনের ঘটনায় দুটি মামলা হয়েছে। কাউন্সিলর নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম ও এলাকাবাসী অভিযোগ করেছেন, নূর হোসেনের প্ররোচনায় আর্থিক সুবিধা নিয়ে র‌্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তা ৭ জনকে অপহরণের পর হত্যা করেছেন। তাই এই বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন।

তারেক সাঈদ

শুনানি শেষে হাকিম চাঁদনী রূপম পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

সাবেক দুই র‌্যাব কর্মকর্তাকে আদালত থেকে বের করার সময় বিক্ষুব্ধ মানুষ তাদের ফাঁসির দাবিতে স্লোগান দেয়। অনেকে তাদের দিকে থুথু মারে। কয়েকজন মাথায় আঘাতের চেষ্টা করলেও পুলিশ তাদের হটিয়ে দেয়।

আইনজীবীদের একটি অংশ বিক্ষুব্ধ হয়ে স্লোগান দিতে থাকে। তখন আইনজীবী নেতারা তাদের শান্ত করেন।

জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, “হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার না দেখিয়ে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখানোতে আইনজীবীদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।”

যেভাবে গ্রেপ্তার

হাই কোর্টের আদেশের পর গত কয়েকদিন ধরেই সাবেক র‌্যাব কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তারের গুঞ্জন চললেও তা না হওয়ায় অসন্তোষও দেখা দেয় নিহতদের স্বজনদের মধ্যে।

গ্রেপ্তারের আদেশ আদালত থেকে পুলিশ সদর দপ্তরে যাওয়ার পর তা পাঠানো হয়েছিল নারায়ণগঞ্জে। তখন থেকে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলছিলেন, প্রক্রিয়া চলছে।

কিন্তু সাঈদ ও আরিফ সেনাবাহিনীর সুযোগ-সুবিধা আরো এক বছর পাবেন বলে তাদের গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি ছাড়পত্রের প্রয়োজন ছিল।

বৃহস্পতিবার রাতে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ওই চিঠি পাঠানোর পর গ্রেপ্তারের বাধা কাটলে তা বাস্তবায়নের গুঞ্জন শুরু হয়। এর মধ্যে ঢাকা সেনানিবাসের জাহাঙ্গীর গেইটে জড়ো হন সাংবাদিকরা। অন্যদিকে নারায়ণগঞ্জের সাংবাদিকরা জড়ো হন পুলিশ লাইন ও আদালতপাড়ায়। 

এই সময়কালে পুলিশ কর্মকর্তারা কোনো কথাই বলছিলেন না। ভোরের দিকে নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার খন্দকার মহিদ উদ্দিন মুখ খোলেন; বলেন, “গ্রেপ্তার হয়েছেন দুই কর্মকর্তা, আনা হচ্ছে নারায়ণগঞ্জে।”

আরিফ হোসেন

পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের চিঠি পাওয়ার পর তারা হাই কোর্টের নির্দেশ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ শুরু করেন তারা।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) সাজ্জাদুর রহমানের নেতৃত্বে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) সুব্রত হালদার, সহকারী পুলিশ সুপার জীবন কান্তি সরকার, তদন্ত কর্মকর্তা মামুনুর রশিদসহ ৩০ জনের একটি দল একটি মাইক্রোবাস ও পাঁচটি পিকআপের বহর নিয়ে ঢাকা রওনা হয়।

এই দলে থাকা এক পুলিশ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, রাত সাড়ে ১২টার দিকে তারা ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থানায় যান। সেখানে বসে তারা মিলিটারি পুলিশসহ সেনাবাহিনীর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।

“ক্যান্টনমেন্টের ভেতর থেকে গ্রিন সিগন্যাল পাওয়ার পর রাত ২টার দিকে আমরা ভেতরে যাই। সেখানেই দুজনকে আমাদের হাতে তুলে দেয়া হয়।”

পরে আবার ক্যান্টনমেন্ট থানায় ফিরে প্রয়োজনীয় কাজ শেষ করে ভোর রাত পৌনে ৪টায় সেনানিবাসের জিয়া কলোনির গেইট দিয়ে বেরিয়ে নারায়ণগঞ্জের পথে রওনা হয় পুলিশের গাড়িবহর।

ওই কর্মকর্তা জানান, দুটি পিকআপ ভ্যানে তারেক সাঈদ ও আরিফ হোসেনকে বসানো হয়। তাদের পরানো হয় হেলমেট ও বুলেট প্রুফ জ্যাকেট। পিকআপ ভ্যানের দু’জনের পাশে আরো দু’জন করে হেলমেট ও বুলেট প্ প্রুফ জ্যাকেট পরিহিত পুলিশ সদস্য বসানো হয়, যাতে বাইরে থেকে বোঝা না যায়, দুই র‌্যাব কর্মকর্তা কোন দুইজন।

রাত ৪টা ৪০ মিনিটে নারায়ণগঞ্জে পৌঁছে সরাসরি জেলা পুলিশ লাইনে ঢুকে যায় ওই গাড়িবহর। যেখানে রাত থেকেই ছিল কড়া নিরাপত্তা।