৭ খুন: গ্রেপ্তারের আদেশ ‘প্রক্রিয়ার’ ফাঁদে

আইনি কোনো বাধা না থাকলেও দৃশ্যত সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের সঙ্গে পুলিশের প্রক্রিয়াগত জটিলতার কারণে দুই দিনেও গ্রেপ্তার হননি নারায়ণগঞ্জ হত্যাকাণ্ডে অভিযোগের মুখে থাকা  র‌্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তা।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 May 2014, 02:00 PM
Updated : 14 May 2014, 05:00 AM

সামরিক বাহিনী থেকে অবসরে পাঠানো এই তিন কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তারে গত রোববার হাই কোর্টের আদেশ হয়, পরদিন সেই আদেশ পৌঁছে পুলিশ সদর দপ্তরে কাছে, তা গেছে নারায়ণগঞ্জেও।

এরপর স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল গ্রেপ্তারের প্রক্রিয়া চলছে বলে সোমবার দুপুরে সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, ২৪ ঘণ্টায়ও সেই প্রক্রিয়ার শেষ দেখা যায়নি।

গ্রেপ্তারের বিষয়ে অগ্রগতি কী- জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার খন্দকার মহিদ উদ্দিন মঙ্গলবার বিকালে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “হাই কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ চলছে। সহসাই এর প্রতিফলন দেখতে পারবেন।”

সামরিক বাহিনীর সাবেক তিনজনকে গ্রেপ্তারে হাই কোর্টের নির্দেশ বাস্তবায়নে সশস্ত্র বাহিনীর সহযোগিতা চেয়ে নারায়ণগঞ্জ পুলিশের পক্ষ থেকে চিঠি পাঠানো হয়েছে বলে সূত্র জানায়।

ওই চিঠির কোনো উত্তর পেয়েছেন কি না- জানতে চাইলে পুলিশ সুপার মহিদ বলেন, “কাজ চলছে। এর বেশি কিছু বলা যাবে না।”

ওই তিনজনকে গ্রেপ্তার না করায় ক্ষোভ জানিয়েছেন র‌্যাব-১১ এ থাকা এই কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপনকারী শহীদুল ইসলাম, যিনি নিহত কাউন্সিলর নজরুল ইসলামের শ্বশুর।

কাউন্সিলর নজরুল ও আইনজীবী চন্দন কুমার সরকারসহ সাতজনকে গত ২৭ এপ্রিল অপহরণ করা হয়েছিল, তিন দিন পর শীতলক্ষ্যা নদীতে তাদের লাশ ভেসে ওঠে

এরপর র‌্যাব-১১ এর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শহীদুল অভিযোগ তুললে নারায়ণগঞ্জের ঘটনার তদন্তে হাই কোর্টের নির্দেশে একটি কমিটি গঠন করা হয়। ছয় দিনের মাথায় হাই কোর্ট আরেক আদেশে তিন র‌্যাব কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেয়।

ওই তিনজন হলেন- সেনা কর্মকর্তা তারেক সাঈদ মোহাম্মদ ও আরিফ হোসেন এবং নৌবাহিনীর কর্মকর্তা এম এম রানা। অপহরণের পর তাদের নারায়ণগঞ্জ থেকে সরিয়ে আনা হয়, পরে তাদের অবসরে পাঠানো হয়।

উচ্চ আদালতের আদেশের পর তাদের গ্রেপ্তার না করার কোনো কারণ থাকতে পারে না বলে মনে করেন ড. কামাল হোসেন।

নারায়ণগঞ্জে আইনজীবীদের প্রতিবাদ সভায় ড. কামাল হোসেন

তিনি মঙ্গলবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “উচ্চ আদালতের আদেশ বাস্তবায়ন বাধ্যতামূলক। সংবিধানই এটা ঠিক করে দিয়েছে। এর অন্যথা করার কোনো সুযোগ আছে বলে আমি জানি না।”

চন্দন কুমারের জামাতা বিপুল পালসহ তিনজনের যে রিট আবেদনে র‌্যাবের সাবেক কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তারের আদেশ হয়েছে, তাতে আবেদনকারীর আইনজীবী ছিলেন ড. কামাল।

হাই কোর্ট গ্রেপ্তারের এই আদেশ দিয়েছে পুলিশকে। বলা হয়েছে, সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ আনা না গেলে ৫৪ ধারায় তাদের গ্রেপ্তার করতে হবে।

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নুরুল হুদা মনে করেন, এরপর গ্রেপ্তার না করার কোনো কারণ নেই।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমার জানা মতে, তাদের গ্রেপ্তারে আইনগত কোনো বাধা নেই। তবে তারা পলাতক থাকলে বা অন্য কোনো সমস্যা থাকলে সংশ্লিষ্টদের তা বলা উচিত।”

এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের স্পষ্ট বক্তব্য না থাকায় বিভিন্ন মহল থেকে কথা উঠছে বলে মনে করেন সাবেক এই আইজিপি।

তবে অভিযোগের মুখে থাকা তিন ব্যক্তি গ্রেপ্তার এড়াতে আদালতে আত্মসমর্পণ করতে পারেন, বলেন তিনি।

এই বিষয়ে জানতে চাইলে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এম কে রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, হাই কোর্টের দেয়া গ্রেপ্তারের আদেশের পর ওই তিন কর্মকর্তার আপিল বিভাগে যাওয়ার কোনো উদ্যোগ তার জানা নেই।

“রাষ্ট্র থেকেও এ ধরনের কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। হাই কোর্টের ওই আদেশটিই সর্বশেষ আদেশ। এরপর আর কিছু জানি না।”

এ এস এম শাহজাহান (ফাইল ছবি)

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা, সাবেক আইজপি এ এস এম শাহজাহানও বলেন, “হাই কোর্টের নির্দেশ পালন করা শিরোধার্য। যদি কোনো ফরমালিটিস থাকে, তা দ্রুত শেষ করা উচিত, গ্রেপ্তারে দেরি করা উচিত না।”

এই কর্মকর্তাদের একজন তারেক সাঈদ ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার জামাতা।

তবে গ্রেপ্তারে দেরির ক্ষেত্রে প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা ছাড়া অন্য কোনো কারণ রয়েছে বলে মনে করেন না সাবেক আইজিপি শাহজাহান।

সামরিক বাহিনীর এই কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে প্রক্রিয়ার কথা বলে আসছেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীও।

সেই প্রক্রিয়া কী- তা বুঝতে সাবেক সেনা কর্মকর্তা এম সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে জানা যায়, দুই সেনা কর্মকর্তাকে অকালীন অবসরে পাঠানো হওয়ায় তারা আরো এক বছর নিজ বাহিনীর সব সুবিধা ভোগ করবেন। সংশ্লিষ্ট বাহিনীর কর্মকর্তা হিসেবে বহাল থাকবেন।

তিনি জানান, সশস্ত্র বাহিনীর কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা হলেও সাধারণ পুলিশ সরাসরি ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে তাকে  গ্রেপ্তার করতে পারে না। কাউকে আনতে হলে মিলিটারি পুলিশের মাধ্যমে আনতে হবে।

অবসরে পাঠানো লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ ও মেজর আরিফ সেনানিবাসে রয়েছেন বলে সেনা সূত্র জানিয়েছে। তারা নজরদারিতে রয়েছেন বলে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীও জানান। 

বাহিনীতে থাকা কোনো কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করার ক্ষেত্রে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের সহযোগিতায় তা করতে হবে বলে জানান অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাখাওয়াত।

এম সাখাওয়াত হোসেন (ফাইল ছবি)

এবারের মতো ঘটনা আগে দেখা যায়নি জানিয়ে সাবেক এই নির্বাচন কমিশনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এটা ইউনিক পরিস্থিতি। আদালত যেহেতু গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়েছে, সেহেতু তা বাস্তবায়ন করতে হবে,আদালতের রায় মানতে হবে।

“তারা ক্যান্টনমেন্টে বসবাস করছে। এক্ষেত্রে দুই পক্ষের সহযোগিতার প্রয়োজন রয়েছে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, সশস্ত্র বাহিনী বা স্ব স্ব বাহিনীর মাধ্যমে তাদের সোপর্দ করতে বলতে পারে।”

সাবেক নির্বাচন কমিশনার সাখাওয়াত বলেন, “আদালতের নির্দেশের পর সামরিক বাহিনীর হেড কোয়ার্টারের অসহযোগিতা করার কোনো কারণ নেই। তবে এমন ঘটনা তো আগে হয়নি। এক্ষেত্রে প্রসিউডিউরাল মেনে তা ক্লিয়ার করতে হবে। এজন্যে উভয় পক্ষকে বিষয়গুলো দেখে নিতে হবে। প্রক্রিয়াগুলো সারতে সময়েরও প্রয়োজন হতে পারে।”

এদিকে আদালতের আদেশের পরও গ্রেপ্তারে অগ্রগতি না দেখে ‘আশ্চর্য’ ড. কামাল বলেন, “কেন তারা গ্রেপ্তার হচ্ছেন না, এটা জানার জন্য আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি।”