একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে ১৬টি ঘটনায় এরশাদ সরকারের প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারের বিচার শুরুর আদেশ দিয়েছে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
Published : 02 Feb 2014, 11:36 AM
বিচারপতি ওবায়দুল হাসান নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ রোববার কায়সারের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে শুনানি শুরুর দিন ঠিক করে দেয়।
এ মামলায় সাক্ষ্য ও জেরা শুরুর আগে প্রসিকিউশনের ‘ওপেনিং স্টেইটমেন্ট’ শুরু হবে আগামী ৪ মার্চ।
গত বছর ১০ নভেম্বর কায়সারের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ জমা দেয় প্রসিকিউসন, যাতে হত্যা, গণহত্যা, নির্যাতন, আটক, ধর্ষণ, মুক্তিপণ আদায়, অগ্নিসংযোগ ও ষড়যন্ত্রের অভিযোগ রয়েছে।
গত ১৫ মে কায়সারের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে ট্রাইব্যুনাল। ওইরাতেই গ্রেপ্তার করা হয় মুসলিম লীগের সাবেক এই নেতাকে। এরপর তাকে রাজধানীর অ্যাপোলো হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
২১ মে কায়সারকে হাসপাতাল থেকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করে পুলিশ। এরপর তাকে কারাগারে পাঠানো হয়।
গত ৪ আগস্ট সৈয়দ কায়সারকে শর্তসাপেক্ষে জামিন দেয় ট্রাইব্যুনাল।
মানবতাবিরোধী অপরাধে বিচারাধীন আসামিদের মধ্যে কায়সার দ্বিতীয় ব্যক্তি, যাকে
জামিনে রেখে বিচার কাজ পরিচালিত হচ্ছে।
বিচার শুরুর আদেশ দেয়ার আগে সৈয়দ কায়সারের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো পড়ে শোনানো হয়। এরপর বিচারক তাকে জিজ্ঞেস করেন, তিনি দোষী না নির্দোষ।
এ সময় নিজেকে নির্দোষ বলে দাবি করেন ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত সৈয়দ কায়সার।
সৈয়দ কায়সারের বাবা সৈয়দ সঈদউদ্দিন ১৯৬২ সালে সিলেট-৭ আসন থেকে কনভেনশন মুসলিম লীগের এমএলএ নির্বাচিত হন। সৈয়দ কায়সার ১৯৭০ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হন।
প্রসিকিউশনের অভিযোগে বলা হয়, ১৯৭১ সালে দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় ৫০০ থেকে ৭০০ ‘স্বাধীনতাবিরোধীকে’ নিয়ে ‘কায়সার বাহিনী’ গঠন করেন এই মুসলিম লীগ নেতা। তিনি নিজে ছিলেন এ বাহিনীর প্রধান।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, সৈয়দ কায়সার পাকিস্তানি সেবাবাহিনীকে পথ দেখিয়ে বিভিন্ন গ্রামে নিয়ে স্বাধীনতার পক্ষের লোক এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর দমনাভিযান চালাতেন। পরে স্বাধীনতার ঠিক আগে তিনি আত্মগোপন করেন।
১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পর ১৯৭৮ সালে আবারো রাজনীতিতে সক্রিয় হন কায়সার। ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে সিলেট-১৭ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে সাংসদ নির্বাচিত হন তিনি।
পরে জিয়াউর রহমানের সময়ে তিনি বিএনপিতে যাগ দেন এবং হবিগঞ্জ বিএনপির সভাপতি হন। এরশাদের সময়ে তিনি যোগ দেন জাতীয় পার্টিতে। ১৯৮৮ সালে হবিগঞ্জ-৪ আসন থেকে লাঙ্গল প্রতীকে নির্বাচন করে সংসদ সদস্য হন।
১৬ অভিযোগ
অভিযোগ ১: ১৯৭১ সালের ২৭ এপ্রিল বেলা দেড়টা থেকে বিকেল ৩টার মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া (তৎকালীণ কুমিল্লা মহকুমা) সদরের পুলিশ ফাঁড়ি ও ইসলামপুর গ্রামের কাজীবাড়িতে শাহজাহান চেয়ারম্যানকে হত্যা, নায়েব আলী নামের একজনকে জখম ও লুটপাট করে কায়সার ও তার লোকজন।
অভিযোগ ২: একই দিনে হবিগঞ্জ জেলার (তৎকালীন মহকুমা) মাধবপুর বাজারের পশ্চিমাংশ ও পার্শ্ববর্তী কাটিয়ারায় লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে সৈয়দ কায়সার ও তার লোকজন। এ সময় কামিনী রায়, বিনোদ বিহারী মোদক, শচীন্দ্র রায়, হীরেন্দ্র রায়, রতি বাবু, অহিদ হোসেন পাঠানের দোকানসহ প্রায় ১৫০টি বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
অভিযোগ ৩: ১৯৭১ সালের ২৭ এপ্রিল সন্ধ্যায় হবিগঞ্জ জেলার (তৎকালীন মহকুমা) মাধবপুর থানার কৃষ্ণনগর গ্রামের অহিদ হোসেন পাঠান, চেরাগ আলী, জনাব আলী ও মধু সুইপারকে হত্যা করে কায়সার ও তার লোকজন। তাদের বাড়িঘরে লুটপাট করার পর আগুন দেয়া হয়।
অভিযোগ ৪: প্রসিকিউশনের অভিযোগ অনুযায়ী, সৈয়দ কায়সার ও তার বাহিনী ১৯৭১ সালের ২৮ এপ্রিল হবিগঞ্জের মাধবপুর বাজারের উত্তর পূর্ব অংশে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ করে। এ সময় তারা পূর্ব মাধবপুরের আব্দুস সাত্তার, লালু মিয়া ও বরকত আলীকে হত্যা করে এবং কদর আলী জখম করে।
অভিযোগ ৫: ১৯৭১ সালের ২৯ এপ্রিল দুপুর থেকে বিকালের মধ্যে হবিগঞ্জ সদরের শায়েস্তাগঞ্জ খাদ্যগুদাম এবং শায়েস্তাগঞ্জ পুরান বাজারের রেলব্রিজ এলাকায় আব্দুল আজিজ, আব্দুল খালেক, রেজাউল করিম, আব্দুর রহমান এবং বড়বহুলা এলাকার আব্দুল আলী ওরফে গ্যাদা উল্লাহ, লেঞ্জাপাড়া এলাকার মাজত আলী ও তারা মিয়া চৌধুরীকে আটক করে নির্যাতনের পর হত্যা করে সৈয়দ কায়সার ও তার বাহিনী।
অভিযোগ ৬: ১৯৭১ সালের ২৯ এপ্রিল সন্ধ্যার পর হবিগঞ্জ সদরের পুরানবাজার পয়েন্টে সাবেক প্রধান বিচারপতি সৈয়দ এ বি এম মহিউদ্দিনের বাড়িতে হামলা হয়। এছাড়া লস্করপুর রেল লাইনের পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে সালেহ উদ্দিন আহমেদ এবং হীরেন্দ্র চন্দ্র রায়কে ধরে নিয়ে নির্যাতনের পর হত্যা করে সৈয়দ কায়সার ও তার বাহিনী।
অভিযোগ ৭: সৈয়দ কায়সার ও তার বাহিনী ১৯৭১ সালের ৩০ এপ্রিল হবিগঞ্জ সদরের এনএনএ মোস্তফা আলীর বাড়িসহ ৪০/৫০টি বাড়িঘর, দোকানপাটে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে।
অভিযোগ ৮: মুক্তিযুদ্ধের সময় ১১ মে হবিগঞ্জের চুনারুঘাট থানার চাঁদপুর চা বাগানে সাঁওতাল নারী হীরামনিকে ধর্ষণ করে সৈয়দ কায়সারের বাহিনী। সৈয়দ কায়সার এ সাঁওতাল নারীকে ধর্ষণে সহায়তা করেছিলেন বলে অভিযোগ এনেছে প্রসিকিউশন।
অভিযোগ ৯: ১৯৭১ সালের ১৫ মে হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুরের লোহাইদ এলাকার আব্দুল আজিজ, আব্দুল গফুর, জমির উদ্দিন, আজিম উদ্দিন, এতিমুনেছা, নূর আলী চৌধুরী, আলম চাঁনবিবি ও আব্দুল আলীকে হত্যা করে সৈয়দ কায়সার ও তার বাহিনী। এদিন আকরাম আলী চৌধুরী (বর্তমানে মৃত) নামে একজনকে জখমও করেb সৈয়দ কায়সার।
অভিযোগ ১০: এরপর ১৩ জুন হবিগঞ্জ সদর, মোকাম বাড়ি, শায়েস্তাগঞ্জ থানার আর এন্ড এইচ ডাকবাংলো এবং মাধবপুর থানার শাহাজীবাজার এলাকার হামলা চালায় সৈয়দ কায়সার ও তার বাহিনী। এ সময় শাহ ফিরোজ আলী নামের একজনকে অপহরণের পর নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। সাবু মিয়া নামের আরেকজনকে অপহরণের পর চালানো হয় নির্যাতন।
অভিযোগ ১১: ১৯৭১ সালের ২৩ জুন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার হরিপুর থানার নাসিরনগরের গোলাম রউফ মাস্টার ও তার পরিবারের লোকজনদের উপর নির্যাতন চালায় সৈয়দ কায়সার ও তার বাহিনী। এছাড়া গোলাম রউফ মাস্টারকে অপহরণ ও আটকের পর তার উপর নির্যাতন চলে। এক পর্যায়ে মুক্তিপণ আদায় করে তার বাড়িঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।
এছাড়া একই দিনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর থানার দয়াল গোবিন্দ রায় ওরফে বাদল কর্মকারের বাড়িতে হামলা চালায় সৈয়দ কায়সার ও তার বাহিনী। লুটপাটের পর ওই বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়।
অভিযোগ ১২: সৈয়দ কায়সার ও তার বাহিনী অগাস্টের মাসের মাঝামাঝি কোনো একদিন হবিগঞ্জের মাধবপুর থানার বেলাঘর ও জগদীশপুর হাইস্কুল থেকে আতাব মিয়া, আইয়ুব মিয়া, মাজেদা বেগমকে অপহরণ করে। এক পর্যায়ে মাজেদাকে ধর্ষণ করা হয়।
অভিযোগ ১৩: ১৯৭১ সালের ১৮ অগাস্ট হবিগঞ্জের নলুয়া চা বাগান থেকে মহিবুল্লাহ, আবদুস শহীদ, আকবর আলী, জাহির হোসেনকে অপহরণ করে নরপতিতে আব্দুস শাহীদের বাড়ি ও রাজেন্দ্র দত্তের বাড়িতে স্থানীয় শান্তি কমিটির কার্যালয় এবং কালাপুরের পাকিস্তানি আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে যায় সৈয়দ কায়সার ও তার বাহিনী। অপহৃতদের আটকে রেখে নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়।
অভিযোগ ১৪: ১৯৭১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর হবিগঞ্জের মাধবপুরে সোনাই নদীর ব্রিজ এলাকা থেকে সিরাজ আলী, ওয়াহেদ আলী, আক্কাস আলী, আব্দুল ছাত্তারকে অপহরণ করে নিয়ে যায় সৈয়দ কায়সার ও তার বাহিনী। তাদের আটকে রেখে নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়।
অভিযোগ ১৫: অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি কোনো একদিন সন্ধ্যায় হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুরে শালবন রঘুনন্দ পাহাড় এলাকায় শাহাপুর গ্রামের নাজিম উদ্দিনকে অপহরণের পর আটকে রেখে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়।
অভিযোগ ১৬: সৈয়দ কায়সার ও তার বাহিনী ১৯৭১ সালের ১৫ নভেম্বর ব্রাহ্মণবড়িয়ার ভাটপাড়া থানার দাউরা, নিশ্চিন্তপুর, গুটমা, বুরুঙ্গা, চিতনা, নূরপুর, ফুলপুর, জেঠাগ্রাম, পাঠানিশা, কুলিতুণ্ডা, আন্দ্রাবহ, তিলপাড়া, কমলপুর, গঙ্গানগর, বাঘি, শ্যামপুর, কুয়ারপুর, নোয়াগাঁও, কুণ্ডা, লক্ষীপুর, করগ্রাম গ্রামের ১০৮ জন গ্রামবাসীকে হত্যা করে।