আশরাফ-মুঈনুদ্দীনের পক্ষে যুক্তিতর্ক

একাত্তরে বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার লক্ষ্যে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ যাদের বিরুদ্ধে সেই আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মুঈনুদ্দীনের পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন শুরু করেছে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 Sept 2013, 05:55 PM
Updated : 29 Sept 2013, 07:06 PM

বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ রোববার পলাতক চৌধুরী মুঈনুদ্দীনের পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেন রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী সালমা হাই টুনি।

তিনি বলেন, চৌধুরী মুঈনুদ্দীন আদর্শগতভাবে ছাত্রসংগঠনের সমর্থক ছিলেন, তবে তিনি কোন নেতা ছিলেন না। স্কুল জীবনে তিনি রাজনীতে যুক্ত ছিলেন না। কলেজ জীবনে সক্রিয় রাজনীতে যুক্ত ছিলেন এমন কোন তথ্য তদন্ত সংস্থা বা প্রসিকিউশন দেখাতে পারেননি।

যুক্তিতর্কের শুরুতেই সালমা হাই ট্রাইব্যুনালকে জানান, মামলার কাজে চৌধুরী মুঈনুদ্দীনের নিজ জেলা ফেনীতে তার আত্মীয়-স্বজনের খোঁজ করার চেষ্টা করেছেন, পত্রিকার মাধ্যমে আহ্বান জানিয়েছেন, কিন্তু কোন ধরনের সহায়তা পাননি। তাই তিনি কোনো সাফাই সাক্ষীও উপস্থিত করতে পারেননি।

সালমা হাই টুনি তার যুক্তিতর্কে দাবি করেন, একাত্তরের আগে মুঈনুদ্দীন স্বাধীনতাবিরোধী ছিলেন, এমন কোনো প্রমাণ নেই। ওইসময় দৈনিক পূর্বদেশ একটি ভালো মানের পত্রিকা ছিল, সেখানে স্টাফ রির্পোটার হিসেবে কাজ করতেন চৌধুরী মুঈনুদ্দীন। অন্য কোনো কাজে তিনি যুক্ত ছিলেন না। সাংবাদিক হিসেবে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সংবাদের কাজে ব্যস্ত থাকতেন তিনি।

একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরের আগ পর্যন্ত মুঈনুদ্দীন আলবদরের হাইকমান্ড ছিলেন বা সক্রিয় কোনো সদস্য ছিলেন, এমন কোন দালিলিক প্রমাণ নেই- দাবি করে সালমা হাই টুনি যুক্তিতর্কে বলেন, তিনি পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার একজন সমর্থক ছিলেন, তবে তার স্বপক্ষে সক্রিয় কোনো ভূমিকা পালন করেননি।

এ প্রসঙ্গে বিবিসি ও আল-জাজিরায় চৌধুরী মুঈনুদ্দীনের সাক্ষাৎকারের উদ্ধৃতি দেন সালমা হাই।

এরপর চৌধুরী মুঈনুদ্দীনের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলোর তথ্যপ্রমাণ সাপেক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেন। পরে যুক্তি উপস্থাপন অসমাপ্ত রেখে সোমবার পর্যন্ত ট্রাইব্যুনাল মুলতবি ঘোষণা করা হয়।

গত ২২ সেপ্টেম্বর এ মামলায় প্রসিকিউশনের সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়। পলাতক এ দুই অভিযুক্তের পক্ষে কোনো সাক্ষী না থাকায় এরপর ২৮ সেপ্টেম্বর থেকে এ মামলায় প্রসিকিউশনের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরুর নির্দেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল।

প্রসিকিউশনের যুক্তি উপস্থাপনের শুরুতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও পটভূমি, এবং মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের প্রাক্কালে বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার উদ্দেশ্যে দেশের স্বাধীনতার সপক্ষে থাকা বুদ্ধিজীবীদের হত্যায় আলবদর বাহিনীর ভূমিকা বর্ণণা করেন প্রসিকিউটর শাহীদুর রহমান।

আলবদর বাহিনীর এ নীল নকশার পরিকল্পনা এবং এতে নেতৃত্ব দেয়া চৌধুরী মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খানের ভূমিকাও বর্ণণা করেন তিনি। পরে প্রকিউটর হায়দার আলী এ মামলার আইনি দিকগুলো নিয়ে যুক্তি উপস্থাপন করেন।

চৌধুরী মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানের বিরুদ্ধে গত ২৪ জুন ১১টি অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল-২ এ অভিযোগ গঠন হয়।

গত ২ মে দুজনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছিল ট্রাইব্যুনাল। দেশে না পাওয়ায় তাদের হাজির হতে দুটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশও হয়েছিল।

বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পরও হাজির না হওয়ায় তাদের অনুপস্থিতিতেই বিচার শুরুর আদেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল।

১৫ জুলাই প্রথম সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেন শহীদ অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমেদের ভাগ্নি মাসুদা বানু রত্না।

পরে আরো সাক্ষ্য দেন শহীদ মুনীর চৌধুরী, শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন, অধ্যাপক সিরাজুল হক খান, সাংবাদিক সিরাজ ঊদ্দিন হোসেন, সৈয়দ নাজমুল হক, নিজাম উদ্দিন আহমেদ, ডা. আব্দুল আলীম চৌধুরী, ডা. ফজলে রাব্বি, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর সন্তানরা, সাংবাদিক আ ন ম গোলাম মোস্তফার ছেলে ও ভাই, সাংবাদিক শহীদুল্লাহ কায়সারের স্ত্রী পান্না কায়সার, চিকিৎসক মোহম্মদ মর্তুজার স্ত্রী’র ভাই ওমর হায়াৎ, অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমেদের বোন ফরিদা বানু, রায়েরবাজার বধ্যভূমি থেকে বেঁচে ফিরে আসা একমাত্র ব্যক্তি দেলোয়ার হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, ফেনীর বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা শরীয়ত উল্লাহ বাঙালি এবং একাত্তরে আশরাফুজ্জামানের ভাড়া বাসার মালিকের ছেলে আলী সাজ্জাদ।

এছাড়া তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে দেয়া আরো চারজন সাক্ষীর জবানবন্দি সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা করে ট্রাইব্যুনাল।

এরা হলেন- স্বাধীনতার পরে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের ঘটনার তদন্তকারী তৎকালীন এনএসআই কর্মকর্তা সামাদ তালুকদার, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়ার চৌধুরীর ছেলে তাসলিম হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর ছেলে মিশুক মুনীর ও ফেনীর বাসিন্দা আবুল কালাম আজাদ।

আরো সাক্ষ্য দেন আশরাফুজ্জামান ও চৌধুরী মুঈনুদ্দীনের বিরুদ্ধে তদন্তকারী কর্মকর্তা মো. শাহজাহান কবীর ও মো. আতাউর রহমান। সাক্ষ্য দেয়ার পরে প্রত্যেক সাক্ষীকে জেরা করেন পলাতক আশরাফুজ্জামান ও চৌধুরী মুঈনুদ্দীনের রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আব্দুস শুকুর খান ও সালমা হাই টুনি।

আশরাফুজ্জামানের গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরের বেজড়া ভাটরা (চিলেরপাড়) গ্রামে। চৌধুরী মুঈনুদ্দীনের বাড়ি ফেনীর দাগনভুঞার চানপুরে।