দীর্ঘসূত্রতার ঘেরাটোপে পড়েছে হল-মার্ক ও ডেসটিনি গ্রুপের আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা।
Published : 25 May 2013, 01:34 PM
দুটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলার প্রায় বছর গড়ালেও তদন্ত শেষ না হওয়ায় এখনো অভিযোগপত্র দিতে পারেনি দুর্নীতি দমন কমিশন, ফলে শুরু হয়নি বিচার।
ফৌজদারি অপরাধের আলোচিত এই মামলাগুলোর বিচার দ্রুত হওয়া উচিত বলে মনে করেন আইনজীবীরা।
ফৌজদারি কার্যবিধিতেও অনাবশ্যক দেরি না করে প্রত্যেক ফৌজদারি মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের কথা উল্লেখ রয়েছে।
হল-মার্কের ঋণ জালিয়াতি এবং ডেসটিনি গ্রুপের অর্থ পাচার গত বছর ছিলো দেশে ব্যাপক আলোচিত দুটি ঘটনা।
দুটি প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী প্রধানরা এখনো কারাগারে রয়েছেন। কিন্তু ডেসটিনি গ্রুপের বিরুদ্ধে মামলার সাড়ে ৯ মাসেও যেমন অভিযোগপত্র জমা হয়নি, তেমনি তা সাড়ে সাত মাসেও হয়নি হল-মার্কের বিরুদ্ধে।
তদন্তের দায়িত্বে থাকা দুর্নীতি কমিশন কর্মকর্তারা অবশ্য বলছেন, তারা শিগগিরই অভিযোগপত্র দেবেন।
দুই মামলার দীর্ঘসূত্রতা নিয়ে জানতে চাইলে দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল এই বিষয়ে কিছু বলতে রাজি হননি।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রতিবেদন দাখিলের বিষয়টি তদন্ত কর্মকর্তাদের ব্যাপার। এ বিষয়ে আমি ভালো-মন্দ কিছু বলবো না।”
এই দুই মামলা নিয়ে ঢাকার আদালতে ফৌজদারি মামলার আইনজীবী মাহবুব হাসান রানা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এইসব প্রতিষ্ঠানের হাতে লক্ষ লক্ষ মানুষ জিম্মি। তাই শুধু তদন্তই নয়, বিচারও তাড়াতাড়ি হওয়া উচিৎ।”
কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান গোলাম রহমানের মেয়াদ আগামী মাসে শেষ হচ্ছে। তার আগেও এই মামলাগুলোর প্রতিবেদন দুদকে জমা হবে।
ডেসটিনি মামলার অন্যতম তদন্ত কর্মকর্তা কমিশনের উপ-পরিচালক মোজাহের আলী সরদার এবং হল-মার্ক কেলেঙ্কারি মামলার অন্যতম তদন্ত কর্মকর্তা উপ-পরিচালক এস এম আকতার হামিদ ভূইয়া দুজনেই শনিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তারা তদন্ত গুছিয়ে এনেছেন। ‘অল্প কিছুদিনের’ মধ্যেই তা জমা দেবেন।
তদন্ত প্রতিবেদন কমিশনে জমা হওয়ার পর আইন অনুযায়ী ওই প্রতিবেদন আদালতে দাখিলের জন্য অনুমোদন দেয়া হবে। এরপর আদালতে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে শুরু হবে বিচার।
তদন্তে দেরির কারণ জানতে চাইলে মোজাহের আলী বলেন, “ডেসটিনির এ দুই মামলায় ৩৫টি কোম্পানির ৭০০ ব্যাংক হিসাব খতিয়ে দেখতে কিছু সময় তো যৌক্তিক কারণেই লাগছে।”
দুটি মামলার অধিকাংশ আসামি গ্রেপ্তার না হওয়ার কারণ জানতে চাইলে তদন্ত কর্মকর্তারা বলেন, তারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
ডেসটিনি: ২২ আসামির মধ্যে গ্রেপ্তার ৪
ডেসটিনির বিরুদ্ধে মামলার আসামির সংখ্যা ২২ জন, পলাতক রয়েছেন ১৮ জন।
এ মামলায় কারাগারে আছেন ডেসটিনির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রফিকুল আমিন, চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হোসেন ও পরিচালক দিদারুল আলম।
কিছু দিন কারাগারে থাকার পর জামিনে ছাড়া পান ডেসটিনির সভাপতি সাবেক সেনা প্রধান হারুন-অর রশীদ।
প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ এনে ডেসটিনির ২২ পরিচালকের বিরুদ্ধে গত বছরের ৩১ জুলাই দুটি মামলা করে দুদক।
ডেসটিনির বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি প্রকল্প থেকে ২ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ আনা হয় আসামিদের বিরুদ্ধে। আর ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কোম্পানির হিসাব থেকে ১ হাজার ৯৩৫ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ আনা হয়।
গত বছরের ২৭ নভেম্বর দুদকের আবেদনে ডেসটিনি গ্রুপের ৩৫টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে যে সব প্রতিষ্ঠানের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি আছে, তা ক্রোকের নির্দেশ দেয় আদালত।
এ ছাড়া গত বছরের গত ২ অক্টোবর দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো অপারেটিভ সোসাইটি, ডেসটিনি ট্রি-পল্যানটেশন, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ৫৩৩টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করার নির্দেশ দেয় আদালত।
এ ছাড়া ডেসটিনি গ্রুপের ২৩টি জেলার ৬০০ কোটি টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ক্রোকের আদেশ রয়েছে আদালতের।
ডেসটিনির মামলায় যারা পলাতক রয়েছেন- মো. গোফরানুল হক , মো. সাইদ উর রহমান ,ইরফান আহমেদ সানি , মেজবাহ উদ্দিন স্বপন, সাজ্জাদ হোসেন, ফারাহ দীবা, জামশেদ আরা চৌধুরী, শেখ তৈয়বুর রহমান, মজিবুর রহমান, নেপাল চন্দ্র বিশ্বাস, জাকির হোসেন, আজাদ রহমান, আকবর হোসেন সুমন, শিরিন আক্তার, রকিবুল ইসলাম সরকার, সুমন আলী খান ও সাইদুল ইসলাম খান।
হল-মার্ক: ২০ আসামিই বাইরে
হল-মার্ক কেলেঙ্কারির ১১টি মামলায় ২৭ আসামির মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন সাতজন, বাকি ২০ আসামি এখনো বাইরে।
গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তানভীর মাহমুদ, প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান তার স্ত্রী জেসমিন ইসলাম, তানভীরের ভায়রা তুষার আহম্মেদ গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে রয়েছেন।
হল-মার্ক কেলেঙ্কারির মামলায় সোনালী ব্যাংকের সাবেক ডিজিএম একেএম আজিজুর রহমান, সোনালী ব্যাংকের জিএম মীর মহিদুর রহমান, দুই ডিজিএম শেখ আলতাফ হোসেন ও শফিজ উদ্দিন আহমেদও গ্রেপ্তার হয়ে এখন কারাগারে।
হল-মার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনায় গত বছরের ৪ অক্টোবর মামলা করে দুদক। মামলায় মোট আসামির সংখ্যা ২৭ জন। এর মধ্যে সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তা ২০ জন এবং হল-মার্ক গ্রুপের সাত জন।
রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা (সাবেক শেরাটন) শাখা থেকে ভুয়া ঋণপত্র বা এলসির মাধ্যমে হল-মার্ক গ্রুপের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে গত বছরের ৪ অক্টোবর রমনা থানায় কয়েকটি মামলা হয়।
১ হাজার ৫৬৮ কোটি ৪৯ লাখ ৩৪ হাজার ৮৭৭ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে আসামিদের বিরুদ্ধে।
এইসব মামলায় পলাতক আসামিরা হলেন- হল-মার্ক গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান আনোয়ারা স্পিনিং মিলসের মালিক মো. জাহাঙ্গীর আলম, ম্যাক্স স্পিনিং মিলসের মালিক মীর জাকারিয়া, সেঞ্চুরি ইন্টারন্যাশনালের মালিক মো. জিয়াউর রহমান ও অ্যাপারেল এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. শহিদুল ইসলাম।
পলাতক ব্যাংক কর্মকর্তা হলেন- সোনালী ব্যাংক রূপসী বাংলা শাখার সাবেক সহকারী উপমহাব্যবস্থাপক মো. সাইফুল হাসান (সাময়িক বরখাস্ত), নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুল মতিন (সাময়িক বরখাস্ত), অবসরপ্রাপ্ত জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা মো. ওয়াহিদুজ্জামান ও সোনালী ব্যাংক ধানমন্ডি শাখার বর্তমান জ্যেষ্ঠ নির্বাহী কর্মকর্তা মেহেরুন্নেসা মেরী, সোনালী ব্যাংকের ডিএমডি মাইনুল হক (বর্তমানে ওএসডি) ও আতিকুর রহমান (ওএসডি), মহাব্যবস্থাপক (জিএম) আ ন ম মাশরুরুল হুদা সিরাজী,ননী গোপাল নাথ (ওএসডি), সাবেক জিএম সবিতা সিরাজ, ডিজিএম ভগবতী মজুমদার (সাময়িক বরখাস্ত), কানিজ ফাতেমা চৌধুরী, এজিএম মো. কামরুল হোসেন খান (সাময়িক বরখাস্ত), আশরাফ আলী পাটোয়ারী (সাময়িক বরখাস্ত), মো. আবুল হাসান ও মো. খুরশিদ আলম।