পদ্মায় থই পেল না বিশ্ব ব্যাংক

পদ্মা সেতুতে অর্থায়নের প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল বিশ্ব ব্যাংক, ঋণের চুক্তিও হয়েছিল, কিন্তু দুর্নীতির অভিযোগ তোলার পর সরকারের সঙ্গে শুরু হয় সংস্থাটির টানাপড়েন। এরপর তাদের বাদ দিয়েই হল বাংলাদেশের দীর্ঘতম সেতু।

রিয়াজুল বাশারও তাবারুল হকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 June 2022, 03:08 AM
Updated : 22 June 2022, 03:08 AM

দুর্নীতির সেই অভিযোগের ভিত্তি কানাডার আদালত এবং দেশে দুদক না পাওয়ার পর বিশ্ব ব্যাংকের আক্ষেপ প্রকাশের কথা সম্প্রতি বলেন সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। “শেষ পর্যন্ত বিশ্ব ব্যাংক বলেছে, পদ্মা সেতু থেকে সরে যাওয়া ভুল হয়েছে,” বলেন তিনি।

বিশ্ব ব্যাংক একটি শতবর্ষী প্রকল্প থেকে নিজেদের সরিয়ে নিজেদেরই ‘বঞ্চিত’ করেছে বলে সম্প্রতি মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এবং সেই সময় পদ্মা সেতুর ইন্টিগ্রিটি উপদেষ্টা মসিউর রহমান।

প্রমত্তা পদ্মা নদীর উপর ২৫ জুন উদ্বোধন হতে যাচ্ছে দেশের দীর্ঘতম পদ্মা সেতু। ৬ দশমিক ১ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতু দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপন করবে। এই সেতু জনপদের চালচিত্র বদলে দেবে বলে একে বলা হচ্ছে ‘স্বপ্নের সেতু’।

নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে উদ্বোধনের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলছেন, পদ্মা সেতু নিছক একটি সেতু নয়, এটা বাংলাদেশের ‘সামর্থ্য আর আত্মবিশ্বাসের প্রতীক’।

ছবি: রয়টার্স

বিশ্ব ব্যাংকের আসা ও যাওয়া

দেশের সবচেয়ে বড় এই সেতুর পরিকল্পনা, সম্ভাব্যতা যাচাই ও নকশা প্রণয়নের সময়ও বাংলাদেশের সরকার কখনোই ভাবেনি যে এই সেতু নিজস্ব অর্থায়নে হবে।

নানা নাটকীয়তা ঘটনার মধ্যে সম্ভাব্য দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে বিশ্ব ব্যাংকে সরে যাওয়ার পরই অনেকটা ‘জেদে’র বশেই নিজস্ব অর্থায়নে এই সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে শেষ হয়েছে।

পদ্মার উপর সেতু নিয়ে আলোচনা শুরু হয় অনেক আগেই। ২০০১ সালে মাওয়া প্রান্তে পদ্মা সেতুর ভিত্তিস্থাপন করেছিলেন শেখ হাসিনা। তখনও তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন।

এরপর এই সেতু নিয়ে তেমন অগ্রগতি হয়নি। সেতুটি মাওয়ায় হবে, না কি পাটুরিয়ায় হবে- তা নিয়েও অঞ্চলবাসীর মধ্যে বিভেদ দেখা দেয়। ২০০৪ সালে জাইকা একটি সমীক্ষা চালিয়ে মাওয়া-জাজিরা পয়েন্টে সেতু নির্মাণের পরামর্শ দেয়। 

এরপর এই সেতুর বিষয়টি অনেক দিন চাপা থাকলেও ২০০৭ সালে সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে এই সেতু নির্মাণের আলোচনা নতুন করে শুরু হয় এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সহায়তায়। তখন একনেকে অনুমোদিত প্রকল্পের নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০ হাজার ১৬২ কোটি টাকা।

২০০৯ সালে শেখ হাসিনার সরকার দায়িত্ব নিয়ে নতুন আঙ্গিকে সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা করে। কয়েক দফায় নির্মাণ ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ২৯১ কোটি ডলার। সিদ্ধান্ত হয়, সড়ক ও রেল উভয় যান পারাপার হবে এই সেতুতে; উপরে চলবে গাড়ি, নিচে ট্রেন।

পদ্মা সেতু নির্মাণে ঋণচুক্তিতে সই করছেন বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের আবাসিক প্রতিনিধি অ্যালেন গোল্ডস্টেইন ও সেতু বিভাগের সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া। ছবি: মুস্তাফিজ মামুন/বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম/ ঢাকা, এপ্রিল ২৮, ২০১১

কয়েক দফায় ব্যয় বাড়ানোর পর ২০১১ সালের ১১ জানুয়ারি ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকায় পদ্মা বহুমুখী সেতু সংশোধিত নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদন করে একনেক। এর আগেই নিশ্চিত করা হয় ঋণদাতাদের প্রতিশ্রুতি।

এডিবি প্রধান উদ্যোক্তা হলেও সবচেয়ে বেশি ঋণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে পদ্মা সেতু প্রকল্পে ‘লিড ডোনার’ হিসেবে যুক্ত হয় বিশ্ব ব্যাংক।

মোট নির্মাণ ব্যয় ২৯১ কোটি ডলারের মধ্যে ১২০ কোটি ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় বিশ্ব ব্যাংক। এডিবি ৬১ কোটি ৫০ লাখ, জাইকা ৪১ কোটি ৫০ লাখ, আইডিবি ১৪ কোটি ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। বাকি অর্থ সরকার দেবে বলে ঠিক হয়েছিল।

২০১১ সালের ২৮ এপ্রিল পদ্মার বুকে ভাষাশহীদ বরকত ফেরিতে হয় বিশ্ব ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে আসা সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এনগোজি ওকোনজো ইউয়েলা বলেন, বাংলাদেশের স্বপ্নে অংশীদার হতে পেরে তারা ‘গর্বিত’।

বিশ্ব ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি পরও অর্থায়ন ছাড় হচ্ছিল না এবং কাজও শুরু করা যাচ্ছিল না।

এরইমধ্যে পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার প্রথম খবরটি পাওয়া যায় আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে, যখন কানাডা পুলিশ এসএনসি লাভালিনের দুই কর্মকর্তাকে বাংলাদেশের কয়েকজন কর্মকর্তাকে ঘুষ সাধার অভিযোগে গ্রেপ্তার করে।

বিশ্ব ব্যাংক তখন জানায়, তারা নিজেরাও বিষয়টি খতিয়ে দেখছে।

৩ ডিসেম্বর ২০১২: পদ্মা সেতু প্রকল্পে ‘দুর্নীতির’ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনে যান সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন।

পদ্মা প্রকল্পে পরামর্শক হিসেবে প্রাকযোগ্য তালিকায় থাকা পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের একটি ছিল কানাডাভিত্তিক লাভালিন। মূল্যায়ন কমিটির মনোনীত এই পাঁচ প্রতিষ্ঠান থেকে একটিকে নির্বাচিত করার কথা ছিল বিশ্ব ব্যাংকের।

বিশ্ব ব্যাংকের মুখপাত্র লেসলি কুইন্টনের উদ্ধৃতি দিয়ে রয়টার্স ওই বছরের ৩ সেপ্টেম্বর জানায়, পদ্মা সেতু প্রকল্পের দরপত্র প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্ব ব্যাংকের কাছ থেকে তথ্য পেয়ে এ তদন্ত শুরু করেছে কানাডীয় কর্তৃপক্ষ।

রয়্যাল কানাডীয় পুলিশ লাভালিনের আন্তর্জাতিক প্রকল্প বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট রমেশ শাহ এবং পরিচালক মোহাম্মদ ইসমাইলকে গ্রেপ্তার করে। মামলাও হয় তাদের বিরুদ্ধে। পরে বাংলাদেশের মামলায়ও আসামি করা হয়েছিল এই দুজনকে।

ওই বছরের ১০ অক্টোবর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জানান, পদ্মা প্রকল্পে অর্থায়ন স্থগিত করেছে বিশ্ব ব্যাংক।

ঢাকায় বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিনিধি অ্যালেন গোল্ডস্টেইন জানান, ‘দুর্নীতির’ তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত তারা নেবেন না।

বিশ্ব ব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ তোলার পর সরকারের পক্ষ থেকে তা বারবারই নাকচ করা হচ্ছিল। তবে প্রকল্পের কাজ বন্ধই থেকেছে।

এই নিয়ে টানাপড়েনের মধ্যে ২০১২ সালের ২৯ জুন পদ্মা প্রকল্পে অর্থায়নের সিদ্ধান্ত বাতিল করে বিশ্ব ব্যাংক।

চুক্তি বাতিলের পক্ষে বিশ্ব ব্যাংক যুক্তি দেখায়, এই প্রকল্পে বাংলাদেশের শীর্ষ পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতির ‘বিশ্বাসযোগ্য’ প্রমাণ মিলেছে।

‘দুর্নীতির’ বিষয়টি বাংলাদেশ সরকারকে জানানো হয়েছিল জানিয়ে এক বিবৃতিতে বলা হয়, “বাংলাদেশ সরকারের যথাযথ সাড়া না মেলায় প্রকল্পে অর্থায়ন বাতিল করা হয়েছে।”

মাঝ নদী থেকে দেখা পদ্মা সেতু। সেতু বিভাগের তথ্য অনুযায়ী গত ১ জুন পর্যন্ত মূল সেতুর কাজের অগ্রগতি হয়েছে ৯৩ শতাংশের বেশি। সব ঠিক থাকলে আগামী জুনেই সেতুতে যান চলাচলে আশাবাদী সরকার। ছবি: মোস্তাফিজুর রহমান

দুদকের তদন্ত-মামলা

ঋণ বাতিলের সিদ্ধান্ত বদলানোর বিষয়ে দুর্নীতির অভিযোগ দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মাধ্যমে তদন্তের শর্ত দিয়েছিল বিশ্ব ব্যাংক। তখন তদন্ত এবং প্রকল্পের কাজ একসঙ্গে চালাতে সরকার চাইলেও ২০১২ সালের ২ ডিসেম্বর বিশ্ব ব্যাংক সাফ জানিয়ে দেয়, মামলা না হলে ঋণ মিলবে না।

এর মধ্যেই মন্ত্রীর পদ ছাড়েন সৈয়দ আবুল হোসেন। দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর তাকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

এরপর ছুটিতে যান সেতু বিভাগের তৎকালীন সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া এবং প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা মসিউর রহমান।

প্রাথমিক অনুসন্ধানের পর ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে দুদক জানিয়েছিল, মূল সেতু নির্মাণে প্রাকযোগ্য প্রতিষ্ঠান নির্বাচনে কোনো রকম দুর্নীতি হয়নি।

তবে বিশ্ব ব্যাংকের তাগিদে ‘ঘুষ লেনদেনের ষড়যন্ত্রের’ অভিযোগে দুদক কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল জাহিদ ২০১২ সালের ১৭ ডিসেম্বর বনানী থানায় একটি মামলা করেন, যাতে সেতু বিভাগের তখনকার সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকে প্রধান করে সাতজনকে আসামি করা হয়েছিল।

অন্য আসামিরা হলেন- সেতু কর্তৃপক্ষের তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (নদী শাসন) কাজী মো. ফেরদৌস, সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ) নির্বাহী প্রকৌশলী রিয়াজ আহমেদ জাবের, ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড প্ল্যানিং কনসালটেন্ট লিমিটেডের উপ ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বাংলাদেশে কানাডীয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এসএনসি লাভালিনের স্থানীয় প্রতিনিধি মোহাম্মদ মোস্তফা, এসএনসি-লাভালিনের সাবেক পরিচালক মোহাম্মদ ইসমাইল, এই সংস্থার আন্তর্জাতিক প্রকল্প বিভাগের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট রমেশ সাহ ও সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট কেভিন ওয়ালেস।

মামলার আগে অভিযোগ অনুসন্ধানে মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, সাবেক প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী, জাতীয় সংসদের হুইপ নূরে আলম চৌধুরীর ভাই নিক্সন চৌধুরী, সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া, এসএনসি-লাভালিনের বাংলাদেশ প্রতিনিধি জিয়াউল হকসহ ২৯ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক কর্মকর্তারা।

কানাডার আদালতে এসএনসি-লাভালিনের বিচারকাজ পর্যবেক্ষণ, কোম্পানির তিন কর্মকর্তা ও দুদকের মামলার আসামি কেভিন ওয়ালেস, রমেশ শাহ ও ইসমাইলের জবানবন্দি সংগ্রহ এবং রমেশের ডায়েরি সংগ্রহ করতে ২০১৩ সালের মে মাসে দুদকের তৎকালীন প্রধান কৌঁসুলি আনিসুল হক এবং দুদকের উপ-পরিচালক মির্জা জাহিদুল আলম কানাডা গিয়েছিলেন। তবে জবানবন্দি কিংবা ডায়েরি পাননি তারা।

এর মধ্যে ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিশ্ব ব্যাংককে বাদ দিয়ে সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে এই বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের ঘোষণা সরকার দিলে পরের বছরের সেপ্টেম্বরে দুদক ওই মামলায় আসামিদের অব্যাহতি দেয়। দুদকের পক্ষ থেকে বলা হয়, পদ্মা সেতু নির্মাণে ‘দুর্নীতি বা ষড়যন্ত্রের প্রমাণ পাওয়া যায়নি’।

তৎকালীন দুদক চেয়ারম্যান মো. বদিউজ্জামান বলেছিলেন, “মামলার মেরিট না থাকায়, তদন্তে পর্যাপ্ত তথ্য ও সাক্ষী না পাওয়ায় চূড়ান্ত প্রতিবেদনের জন্য মামলাটি নথিভুক্ত করা হয়েছে। দেড় বছরের বেশি সময় ধরে তদন্তে মামলাটিকে এগিয়ে নেওয়ার মতো তথ্য পাওয়া যায়নি। তাই আদালতে চার্জশিট পেশ করা সম্ভব হচ্ছে না।”

এরপর একই বছরের অক্টোবর দুদকের চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করে পদ্মা সেতু দুর্নীতি মামলায় সাত আসামির সবাইকে অব্যাহতির আদেশ দেয় আদালত।

এ মামলায় মোশাররফ হোসেন গ্রেপ্তার হওয়ার পাশাপাশি সরকারি চাকরি থেকেও সাময়িক বরখাস্ত হয়েছিলেন। পরে তিনি মুক্তি পান। ২০১৩ সালের জুনে বরখাস্তের আদেশও প্রত্যাহার করে তাকে চাকরি ফিরিয়ে দেওয়া হয়। পরে তিনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর অবসরে গিয়ে বর্তমানে জার্মানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিযুক্ত আছেন।

৪ নভেম্বর ২০১২: পদ্মা সেতু প্রকল্পে ‘দুর্নীতির’ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনে যান প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর রহমান। ছবি: নাসিরুল ইসলাম

কানাডার মামলায় অপ্রমাণিত

ছয় বছর ধরে বিচারিক কাজের পর পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের যে অভিযোগ বিশ্ব ব্যাংক তুলেছিল, তার প্রমাণ না পাওয়ার কথা জানায় কানাডার আদালত।

২০১৭ সালে এই মামলার তিন আসামিকে কানাডার আদালত খালাস করে দেয়।

কানাডিয়ান পত্রিকা দ্য গ্লোব অ্যান্ড মেইল এই সংক্রান্ত প্রতিবেদনে জানায়, ফোনে আড়ি পেতে সংগ্রহ করা যে তথ্যের ওপর ভিত্তি করে প্রসিকিউশন মামলা সাজিয়েছিল তাকে গাল-গল্প ও গুজব বলে ছুড়ে ফেলেছেন বিচারক।

নিজস্ব অর্থায়নে এগিয়ে চলা

বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়ন বাতিলের ঘোষণা এলে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখায় সরকার। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে ওয়াশিংটনভিত্তিক বহুজাতিক এই সংস্থার সমালোচনা আসে।

তখনই ২০১২ সালের ৪ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে প্রয়োজনে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত জানিয়েছিলেন।

তিনি বলেছিলেন, “পদ্মা সেতু করার জন্য দেশে আমাদের ১৬ কোটি মানুষ আছে, ৮০ লাখ প্রবাসী আছে। বাংলার মানুষ সারা জীবন কি অন্যের সাহায্যে চলবে? নিজের পায়ে দাঁড়াবে না? আত্মনির্ভরশীল হবে না? পদ্মা সেতু আমরা করবই।”

বিশ্ব ব্যাংকের সমালোচনা করে তিনি বলেছিলেন, “যারা একটি পয়সাও ছাড় করেনি, তারা দুর্নীতির অভিযোগ করে! তাদের ভেতর যে দুর্নীতি তা দেখেন।”

১২ ডিসেম্বর ২০১৫: জাজিরায় পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের মূল সেতু ও নদীশাসন কাজের প্রকল্প ঘুরে দেখেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ছবি: পিএমও

নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর ঘোষণা সারাদেশে যে সাড়া ফেলেছিল, তাতে অভিভূত হন প্রধানমন্ত্রী নিজেও।

বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা টাকা তুলতে থাকে। সংসদ সদস্য, সরকারি কর্মকর্তা, সাধারণ মানুষসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি মেলে সহায়তার।

অনুদান দেয়ার সুযোগ রেখে ওই বছরেই দুটি ব্যাংক হিসাব খোলা হয়। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংগঠনগুলো এক দিনের বেতনের সমপরিমাণ অর্থ অনুদান হিসেবে দেওয়ার ঘোষণা দেয়।

তবে এ পদ্ধতিতে অর্থ সংগ্রহে সরকার আগ্রহ দেখায়নি। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর কাজ এগিয়ে নিতে বাজেট থেকে বরাদ্দ দিতে শুরু করে সরকার।

অর্থ বরাদ্দ প্রথম আসে ২০১৩-২০১৪ অর্থবছর থেকে। এর আগে ২০১৩ সালের ৩১ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারের পক্ষ থেকে বিশ্ব ব্যাংককে জানিয়ে দেয়া হয় যে, এই প্রকল্পের জন্য তাদের ঋণ নেওয়া হবে না।

পদ্মা সেতুর নকশা ঠিক রেখেই এরপর শুরু হয় সেতু নির্মাণের বাকি কাজগুলো। ২০১৩-১৪ অর্থবছরের বাজেটে সরকার পদ্মা সেতুর জন্য বরাদ্দ দেয় প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা। পরের বছরগুলোতেও প্রয়োজন অনুযায়ী বরাদ্দ দিয়ে গেছে সরকার।

২০১৫ সালের ১২ই ডিসেম্বর আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে মূল সেতুর নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মূল সেতু ছাড়াও টোল প্লাজা, সংযোগ সড়ক নির্মাণ ও নদীশাসনের কাজ এগিয়ে যেতে থাকে।