ভ্যান ঘিরে মানুষের ভিড়। এর মধ্যেই রীতিমতো চিৎকার করে খাবার বিক্রেতার সঙ্গে তর্ক জুড়েছেন মহাখালীর একটি মার্কেটের নিরাপত্তাকর্মী মাজেদ মিয়া।
Published : 31 Mar 2022, 12:42 AM
হলুদ পলিথিনে সদ্য কেনা বিরিয়ানির পোটলাটা উঁচু করে মধ্যবয়সী মাজেদুল বলছিলেন, “এই কয়ডা খালি পুলাও-ভাত ১০০ ট্যাকা! মুরগির একটা ঠ্যাংও দিলা না। আগে তো ৫০ ট্যাকার নিলে ভাঙ্গাচুরা একখান মুরগি ঠিকই দিতা।”
নিত্যপণ্যের চড়া বাজারের আঁচ লেগেছে রাজধানীর উচ্ছিষ্ট খাবারের বাজারেও। ক্রেতারা জানাচ্ছেন, কয়েক মাস আগেও যে দামে যতটুকু খাবার কিনতে পারতেন, এখন সেটুকু কিনতেই দ্বিগুণ টাকা গুনতে হচ্ছে।
বিক্রেতারাও স্বীকার করলেন, দাম এখন বেড়ে গেছে। কারণ এ খাবারের ক্রেতা বেড়েছে, বেড়েছে চাহিদা। বিয়ে-বৌভাতের মতো বিভিন্ন অনুষ্ঠানের বেঁচে যাওয়া অথবা ফেলে দেওয়া খাবারের বাজারেও এখন মূল্যবৃদ্ধির খাঁড়া।
চৈত্রের হঠাৎ গরমে শার্ট ছেড়ে স্যান্ডো গেঞ্জি পরেই ভ্যানে খাবার বিক্রি করছিলেন সুমন। ক্রেতাদের প্রশ্ন আর দামাদামির চাপে কিছুটা বিরক্ত তিনি।
গজগজ করে বললেন, “মালের দাম কী আর আগের মত আছে। আমরাও তো হ্যাগো কাছ থিকা কিন্না আনি। ভ্যানের ভাড়া দেওন লাগে। হ্যারা যেই দাম চায় হেইডা না দিলে ভালোগুলান বেইচা দিব আরেক ব্যাডার কাছে। আমি পামু খালি ভাঙ্গাচুরা। নিলে নাও, না নিলে থুইয়া ট্যাকা নিয়া যাও।”
মহাখালীর জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের সামনে রাত ১১টার পরে প্রায় প্রতিদিনই বসে এই উচ্ছিষ্ট খাবারের বাজার।
ভ্যানের ওপর বড় ডালি ভরে রাখা হয় বিরিয়ানি বা পোলাও, বড় ডিব্বা বা বালতি ভরে আসে গরুর মাংস, খাসির রেজালা, মুরগির রোস্ট, জর্দা; বোতল ভরে আসে বোরহানি।
অনেক সময় অবশ্য পলিথিনেই মাখামাখি করে আসে সব খাবার। পলিথিনের ওই খাদ্যসম্ভার খালি চোখে দেখলেই বোঝা যায়, সেগুলো একেবারেই উচ্ছিষ্ট।
তবে সুমন বললেন, “আমরা ইনট্যাক ডেগও নামাই।” মানে, একেবারে কারও হাত না পরা বিরিয়ানির ডেকচিও তাদের ভ্যানের দোকানে আসে।
এ দোকানের ক্রেতার তালিকায় আছেন পরিবহন কর্মী, দোকান কর্মী, রিকশা, অটোরিকশার চালক, মেসে থাকা ছাত্রসহ নানান পেশার মানুষ।
এখানে ১০০ টাকায় মোটামুটি পলিথিন ভরা দুই-তিন জনের বিরিয়ানি, একটা গোটা বা আধখানা টিকিয়া মেলে। মাংস বা রোস্ট নিতে আলাদা টাকা দিতে হয়।
রোস্ট কিনতে আসা ক্রেতাদের আব্দার- ‘ভাঙ্গাচুরা দিবেন না’; ভাঙ্গাচুরা মানে আধখাওয়া।
এ খাবার আসে কোথা থেকে? বিক্রেতা ফারুক জানান, কাছাকাছি থাকা রাওয়া কনভেনশন সেন্টার, সেনাকল্যাণ ভবনের পার্টি সেন্টার, ফ্যালকন হল বা শাহীন স্কুলের মিলনায়তনে আয়োজিত বিয়ে, জন্মদিনসহ বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানের অবশিষ্ট খাবার কিনে এনে এখানে বিক্রি করেন তারা।
ওইসব মিলনায়তনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে খাবার প্রস্তুতের দায়িত্ব পাওয়া বাবুর্চিদের সহকারী, পরিচ্ছন্নতার কাজে নিয়োজিত কর্মীরা অনুষ্ঠান শেষে বেচে যাওয়া খাবারগুলো বড় ডালি, বালতি বা বস্তায় জমিয়ে রাখেন।
ফারুক জানালেন, শুধু উচ্ছিষ্ট খাবারই নয়, বেঁচে যাওয়া খাবারও বিক্রি করে দেওয়া হয়। সুযোগমত তাদের কাছ থেকে নিয়ে আসতে হয়।
তার ভাষায়, “ইনট্যাক ড্যাগের দাম বেশি। এইহানে পাবলিক দাম দিবার চায় না। খালি কাউকাউ করে। তবু মাঝে মধ্যে আনি।”
কথা হল এই দোকানের ক্রেতা- সাইফুলের সঙ্গে। সাইকেলআরোহী সাইফুল মেসে থেকে ঢাকার একটি কলেজে পড়ালেখা করছেন। সাইকেল থেকে না নেমেই খাবারের চেহারা একনজর দেখে নিয়ে ফোন করলেন। বললেন, “কীরে বিরানি আনুম? ... আছে ভালোই। গরুও আছে।”
সাইফুলের সঙ্গে ৫০০ টাকায় রফা হল। এই টাকায় এক পলিথিন ভর্তি বিরিয়ানি এবং আধ পলিথিন ভর্তি গরুর মাংস পেলেন সাইফুল।
গরুর মাংসের পোটলাটা ঝাঁকিয়ে বিক্রেতা সুমন বললেন, “মিনিমাম এক কেজি হইব। আইজকা গরু কিন্তু এক্কেরে ফ্রেশ।”
ঘাড় ঝাঁকিয়ে সাইফুল জবাব দিলেন, “অ্যাহ! ঝোল দিয়া তো ভইরা দিলেন।”
সাইফুল জানালেন, মাঝেমধ্যেই এখান থেকে খাবার কেনেন। তবে কেনার সময় দেখে নিতে হয়। অনেক সময় খাবারের মান একেবারে খারাপ থাকে, গন্ধ হয়ে যায়। দেখে নিতে পারলে মোটামুটি কম টাকায় ভালো খাবার পাওয়া যায়।
পাঁচশ টাকায় যে খাবার কিনেছেন তা দিয়ে পাঁচ-ছয় জন পেট পুরে খেতে পারবেন বলে আশা করছেন তিনি।
এই খাবারেরও দাম বেড়ে গেছে জানিয়ে সাইফুল বললেন, “কয়দিন আগেও এত দাম ছিল না। এই খানা আমি মুরগীসহ ৩০০ ট্যাকাতেও নিছি। এহন ভিড় (ক্রেতাদের) বেশি হয় বইলা হ্যারাও দাম বাড়ায়া দিছে। এক ভ্যান মাল ব্যাচতে এহন এক ঘণ্টাও লাগে না।”
এভাবেই চলছে কেনা-বেচা। বিক্রেতারা কাউকে গরু মাংস বের করে দেখাচ্ছেন, আবার কাউকে বলছেন, “আইজকা রোস্ট এক্কেরে ফুল। কুনো ভাঙ্গাচুরা নাই। পঞ্চাশের নিচে দাম হইব না।” একজন পলিথিনে খাবার ভরে দিচ্ছেন, আরেকজন টাকা গুনে দাম নিচ্ছেন।
বিক্রেতা ফারুক বললেন, “আগে পাঁচশ-হাজার গুইজ্জা দিয়াও মাল আনছি। এহন হেই জায়গাতেও কম্পিটিশান। কে কার আগে মাল নিয়া বেচতে বইব। হেই কারণে দামও বাড়ছে। আর এহন জিনিসপত্রের দাম তো এমনিতেই বাড়তি। হ্যারাও বেশি লাভ করতে চায়, আমাগোও তো সংসার চালান লাগে।”
খাবার কিনতে যত লোক এ দোকানে আসছেন, তারচেয়ে বেশি আসছেন দেখতে। কেউ আস্ত রোস্ট চান তো কেউ খাসির রেজালা। একজন অটোরিকশা চালক অনেকক্ষণ ধরেই অস্থায়ী দোকানটার বিভিন্ন খাবার উঁকি-ঝুঁকি মেরে দেখলেন। তবে কিনলেন না। জানতে চাইলে নাম বললেন মো. মহসিন।
কী কিনতে এসেছেন জিজ্ঞেস করতে বললেন, “জিনিসপত্রের যে দাম, সংসার চালানই কষ্ট। এর মইদ্দ্যে পুলাপাইন হ্যাগো মার কাছে পুলাও-মাংস খাইতে চায়। হেইজন্যে খাড়াইলাম। আগে হ্যাগো কাছে একশ টাকায় যে খাওন নিছি এহন দাম ডাবল হইছে। দেহি, অল্প চাইরটা পুলাও আর রোস্ট দেয় নাকি। পুলাপাইন খাইতে পারলেই হইত।”
মহসিনের হাতে ধরা বাটন ফোনটা বারবারই বাজছে। বিরক্ত হয়ে মহসিন ফোন ধরে বললেন, “আরে আইতাছি তো। আইজকা মুরগি আনুমনে।”
কিছুক্ষণ পর খাবারের পোটলা হাতে হেঁটে অটেরিকশার কাছে ফিরতে দেখা গেল মহসিনকে।