কলেজ জীবনের স্বাদ তারা কি পাবে?

স্কুলের নানা নিয়ম-কানুনের বেড়াজাল ডিঙিযে যে জীবন প্রথম স্বাধীনতার স্বাদ দেয়, মহামারীর মধ্যে সেই জীবনটি হারিয়ে যেতে বসেছে অনেক শিক্ষার্থীর।

কাজী নাফিয়া রহমান নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 Sept 2021, 06:52 PM
Updated : 2 Sept 2021, 06:52 PM

তাদেরই একজন ঢাকার শহীদ বীরউত্তম লেফটেন্যান্ট আনোয়ার গার্লস কলেজের শিক্ষার্থী রায়া আদিবা আহমেদ।

তার ভাষায়. “কলেজ লাইফটা কী, সেটাই তো জানলাম না। স্কুলের পর কলেজটা আসলে কেমন হয়, সেটা তো বুঝতে পারলাম না।”

করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে দেড় বছর ধরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ঘরে বসেই কলেজে ভর্তি হয়েছেন আদিবার মতো লাখো শিক্ষার্থী।

প্রথম বর্ষ পেরিয়ে গেছে তাদের, কিন্তু কলেজে ক্লাস করা হয়নি।

নিজেরা এখন কোন অবস্থানে রয়েছেন, সেটাও   অবোধগম্য ঠেকছে লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার পাটগ্রাম আদর্শ কলেজের শিক্ষার্থী জাহাঙ্গীর আলমের কাছে।

এই শিক্ষার্থী বলেন, “কোন ইয়ারে আছি, সেটা বুঝতে পারছি না। মনে হয়, সেকেন্ড ইয়ারে উঠছি। কিন্তু আমাদের তো কোনো পরীক্ষাই হয়নি।”

আদিবা ও জাহাঙ্গীরের মতো এমন শিক্ষার্থী রয়েছেন ১৪ লাখের মতো।

২০২০ সালে ২০ লাখ ৪০ হাজার ২৮ জন শিক্ষার্থী মাধ্যমিকের চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশ নেয়, তাদের মধ্যে ১৬ লাখ ৯০ হাজার ৫২৩ জন পাস করে।

এদের মধ্যে প্রায় ১৪ লাখ শিক্ষার্থী একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে।

তবে মহামারীর মধ্যে গত বছরের মার্চে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তারা কলেজে ভর্তি হলেও ক্লাস করার সুযোগ পায়নি।

গত বছর মহামারীর আগে এই শিক্ষার্থীরা এসএসসি পরীক্ষায় বসতে পেরেছিল। কিন্তু এইচএসসি শিক্ষার্থীদের দেওয়া হয়েছিল ‘অটোপাস’।

পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় ২০২১ সালের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা এখনও নেওয়া যায়নি।

তবে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে এলে নভেম্বরে এসএসসি ও ডিসেম্বরে এইচএসসি পরীক্ষা নেওয়ার ঘোষণা দিয়ে রেখেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলবে কি না, সেই সিদ্ধান্ত রোববার নেওয়া হবে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে।

মহামারীর কারণে গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব স্কুল-কলেজ বন্ধ বলে শ্রেণিকক্ষগুলো এমন ফাঁকা। ফাইল ছবি

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলবে, ক্লাস শুরু হবে- সেই আশায়ই এখন দিন গুণছেন শাহিনুর সুলতানা শ্রাবণী।

শ্রেণিকক্ষের বাইরে থেকেই উচ্চ মাধ্যমিকের পাঠ চুকতে বসায় হতাশ ঢাকার শহীদ পুলিশ স্মৃতি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির এই শিক্ষার্থী বলেন, “টিচারদের সাথে দেখা-সাক্ষাতও হল না। কোনো পরীক্ষাও হল না।”

বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার আগে কলেজ অনেক কিছু শেখার ‘দারুণ জায়গা’ বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম।

তিনি বলেন, “উচ্চ শিক্ষাঙ্গনে আমার দায়িত্বটা কী, আমার অধিকারগুলো সম্পর্কে আমাকে সচেতন করেছে, নেতৃত্ব দিতে সহায়তা করেছে। কাজেই একটা নতুন মাত্রা যোগ করেছে এই কলেজ জীবন। কলেজ জীবনের এই আনন্দ থেকে মহামারীর কারণে তারা বঞ্চিত।”

অনলাইনে মিটছে না ক্লাসের স্বাদ

দেড় বছর ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ২০২০ সালে কলেজে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের অনলাইনেই ক্লাস চালিয়ে যেতে হচ্ছে।

শাহিনুর সুলতানা শ্রাবণী বলেন, “এখন অনলাইনে সব ক্লাস হচ্ছে, প্রতি সপ্তাহে অ্যাসাইনমেন্ট করতে হচ্ছে। তবে বাসায় বসে বসে পড়াশুনা হচ্ছে না তেমন।

“অনলাইনে নতুন নতুন ক্লাস করাচ্ছে। তো দেখা যায়, ক্লাস ঠিকঠাক করতে করতেই অনেক সময় নষ্ট হয়ে যায়। ক্লাসের সময়টাও কমে যায়।”

এভাবে পড়ালেখা ঠিকভাবে হচ্ছে না বলে মনে করেন এই তরুণী।

ইন্টারনেটের ধীরগতি ও ডিভাইস সঙ্কটেও অনেক শিক্ষার্থী অনলাইন ক্লাসে যুক্ত হতে পারছে না।

মহামারীর মধ্যে অনলাইনে ক্লাস চললেও তাতে মন ভরছে না শিক্ষার্থীদের। ফাইল ছবি

লালমনিরহাটের পাটগ্রামের জাহাঙ্গীর জানান, প্রথমদিকে তাদের অনলাইনে ক্লাস হলেও দেড় মাস ধরে হচ্ছে না। 

“অনলাইনে প্রথমে কয়েকদিন ক্লাস হত, এখন আর হয় না। আমি সংক্ষিপ্ত সিলেবাস শেষ করছি, কিন্তু কলেজ থেকে দেড় মাস যাবত অনলাইনে ক্লাস হয় না। তবে অ্যাসাইনমেন্ট করছি।”

সংক্রমণ এড়াতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও অ্যাসনাইনমেন্ট জমা দেওয়ার সময় স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না বলেও দেখান তিনি।

“হুড়োহুড়ি করে জমা নেওয়া হয়। তাহলে এতে তো সংক্রমণ ছড়াবেই। তাহলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে লাভ কী হল?”

অনলাইনে ক্লাস করতে গিয়ে কারিগরি জটিলতার সমস্যায় পড়তে হচ্ছে ঢাকার মিরপুরের বিসিআইসি কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী আনাস বিন সাজ্জাদকেও।
“সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে রেকর্ড নাই। রেকর্ড থাকলে পরে শুনে নেওয়া যায়। এমনকি জুমের ফ্রি ভার্সনটা ব্যবহার করায় ৪০ মিনিট পরেই আবার ক্লাস অটোমেটিক বন্ধ হয়ে যায়।”

তিনি বলেন, “সরাসরি পড়া বুঝে নেওয়া, আর অনলাইনে ক্লাসের মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। কোনো বিষয়ে প্রশ্ন থাকলে সেটার সমাধান পাওয়া যাচ্ছে না।”

আনাস হতাশ কণ্ঠে বলেন, “পড়ার সেই স্পিরিটটা আমাদের আর নাই।”

দীর্ঘ ছুটির মধ্যে পরিবার থেকে এই শিক্ষার্থীকে এখন বাবার ব্যবসায় সহযোগিতা করতেও তাগিদ আসছে বলে জানান তিনি।

শহীদ আনোয়ার গার্লস কলেজের শিক্ষার্থী রায়া আদিবাও অনলাইন ক্লাসে সমস্যার কথা বলেন।

“সরাসরি ক্লাসের সাথে এর তুলনা করা যায় না। পরীক্ষাও হচ্ছে না, তাই পড়াশুনাও হচ্ছে না। অ্যাসাইনমেন্টও নিজেরা করছে না অনেকেই, অনলাইনেই পাওয়া যাচ্ছে অনেক সময়।”

এই শিক্ষার্থীর মা তানিয়া জেবিন বলেন, “কলেজ খোলা থাকলে কলেজের চাপে পড়াশুনা হত। অনলাইনের ক্লাসে কিছুই বোঝে না। প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস হয়, সেটাও কোনো্ কাজের না। মুখে বললে তো আর হয় না, প্র্যাকটিক্যাল তো ল্যাবে গিয়ে দেখে বোঝার বিষয়।”

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার দাবিতে এখন এমন বিক্ষোভ বাড়ছে। ফাইল ছবি

সপ্তাহে অন্তত দুই-তিন দিন হলেও সরাসরি ক্লাস নেওয়ার পক্ষে মত দেন এই অভিভাবক।

সন্তানের পড়াশোনা নিয়ে হতাশ কণ্ঠে তিনি বলেন, “পড়াশুনার কোনো আগ্রহ নাই। বলে বলে পড়তে বসাতে হয়। সিলেবাস কমিয়ে দিছে, বাচ্চারা এতে খুশি। কিন্তু এতে লাভটা কী হবে?”

পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেই স্কুল-কলেজ খুলে দেওয়া উচিৎ বলে মনে করেন শাহীনুরের মা নাজমা ইসলামও।

মহামারীর আগে এপ্রিলে পরীক্ষায় বসত উচ্চ মাধ্যমিকের পরীক্ষার্থীরা। এবার ২০২১ সালের এইচএসসি পরীক্ষা না হওয়ায় পরবর্তী শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদেরও অনিশ্চয়তা বাড়ছে।

শাহিনুর সুলতানা বলেন, “আমাদের এইচএসসি পরীক্ষা পেছাবে কি না, তা তো আমরা নিশ্চিত না। একটা বছর লস গেল। আবার সিলেবাস শেষ হতে কতদিন চলে যাবে, সেটারও ঠিক নাই।”

বাস্তবতা মেনে নিজেকে তৈরি করার পরামর্শ

দেড় বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরাসরি ক্লাস না হওয়ায় যে ক্ষতি হয়েছে, তা পূরণ সহজে সম্ভবপর নয় বলে মনে করছেন ঢাকার গুলশান কমার্স কলেজের শিক্ষার্থী ফাহমিন ইসলাম।

তিনি বলেন, “ক্লাসে না যেতে যেতে পড়াশুনার সেই অভ্যাসটাই নষ্ট হয়ে গেছে। এখন পড়তে বসলেও সহজে পড়া মাথায় ঢোকে না। লেখারও কোনো স্পিড নাই। আসলে প্র্যাকটিস না থাকলে যেটা হয়।”

বাণিজ্য বিভাগের এই শিক্ষার্থী বলেন, “কলেজে গিয়ে ক্লাস করলে পরীক্ষা হত, কম্পিটিশন হত। এতে পড়ার আগ্রহটা বাড়ত। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে সেটা তো হল না।”

মহামারীর কারণে এদের মতো ১৪ লাখ শিক্ষার্থীর কলেজ জীবন ফুরিয়ে যাচ্ছে ক্লাস না করেই। ফাইল ছবি

অধ্যাপক মনজুরুল ইসলাম বলছেন মহামারীকালে এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতি মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে হবে।

“যে অভিজ্ঞতা কলেজ জীবনে হয়নি, সেটা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে কাজে লাগাতে হবে। এই সময়টাতে শিক্ষায় ফাঁকটা যেন না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। সাংস্কৃতিক যে গ্যাপটা হবে, সেটা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে পুষিয়ে নেয়া যাবে। কিন্ত পড়াশুনার গ্যাপটা পূরণ করা যাবে না। সেজন্য পড়াশুনা চালিয়ে যেতে হবে।”

একটি উদাহরণ দিয়ে শিক্ষার্থীদের বাস্তবতা উপলব্ধি করার পরামর্শ দেন এই শিক্ষক।

তিনি বলেন, “আমি এমন দুটি পরিবারকে জানি, যারা মহামারীতে মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে। তারা বিয়ে না দিলে সে হয়ত কিছু একটা করতে পারত। কিন্তু এখন সংসারের ঘানি টেনে জীবন পার করতে হবে।

“যাদের বিয়ে হয়ে গেছে বা পড়াশুনা বন্ধ হয়ে গেছে, তাদের মতো অবস্থা হয়নি ভেবে নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে। তাদের চেয়ে খারাপ অবস্থায় যারা আছে, তাদের কথা চিন্তা করে আক্ষেপ করার কিছু নেই। ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করতে হবে। নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে।”