সিলেট ও মৌলভীবাজারের খাসিয়া ও গারো জনগোষ্ঠীর জানমাল, বাসস্থান ও চাষাবাদের পুঞ্জির স্থায়ী নিরাপত্তা নিশ্চিত করাসহ তাদের ওপর বিভিন্ন সময় হামলায় জড়িতদের শাস্তির দাবি জানিয়েছে মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী কয়েকটি সংগঠন।
Published : 29 Aug 2021, 11:00 PM
রোববার ‘সামাজিক বনায়নের নামে প্রাকৃতিক বন ধ্বংস, খাসিয়া আদিবাসীদের উপর হামলা ও উচ্ছেদের ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে’ এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি জানানো হয়।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতি (বেলা) বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), নিজেরা করি এবং অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি) যৌথভাবে এ সংবাদ সমম্মেলনের আয়োজন করে।
লিখিত বক্তব্যে বাপার সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, সম্প্রতি মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলায় ডলুছড়া পুঞ্জিতে সামাজিক বনায়নের নামে খাসিয়া উচ্ছেদের `ষড়যন্ত্র’ শুরু হয়েছে।
“বন বিভাগের সাথে চলমান বিরোধের জেরে কর্মধা ইউনিয়নের বেলুয়াপঞ্জিতে পাঁচটি খাসি-গারো পরিবারের দুই হাজার ৮০০টি পানগাছ কাটা হয়। গত ২৫ অগাস্ট এ ঘটনা ঘটে। বেলুয়াপুঞ্জির এ ঘটনায় সহায়সম্বল হারিয়ে ভুক্তভোগীদের মধ্যে গভীর শোকের ছায়া মেনে এসেছে।”
এর জের শেষ না হতেই গত ২৭ অগাস্ট স্থানীয় ভূমি দখলকারী ‘দুষ্কৃতকারীরা’ ডলুছড়া পুঞ্জিতে তিন খাসিয়া পরিবারের জুমের প্রায় ৫০০টি পান গাছ কেটে ফেলেছে বলে তিনি অভিযোগ করেন।
কুলাউড়ায় গাছ কাটা ও আদিবাসীদের ওপর হামলার ঘটনায় দায়ীদের শাস্তির দাবি জানিয়ে শরীফ বলেন, “ক্ষতিগ্রস্ত খাসিয়া ও গারো জনগোষ্ঠীর ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। সামাজিক বনায়নের নামে প্রাকৃতিক বন ধ্বংসের সাথে জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। সিলেটে খাসিয়া ও গারো জনগোষ্ঠীকে জানমাল, বাসস্থান ও পুঞ্জির স্থায়ী নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে হবে।”
সংবাদ সম্মেলনে বাপার সভাপতি ও মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল বলেন, “ওইখানে (মৌলভীবাজার) একটা জনগোষ্ঠীর সদস্যরা বলছে যে, তারা আতঙ্কের মধ্যে আছে। সরকারকে প্রশাসনকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এটা অবশ্যই আমলে নিতে হবে, আমলে নিয়ে তাদের স্থায়ী নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে।
“‘এ রকম আর হবে না’- এ কথার ওপর আমরা আস্থা রাখতে পারছি না। এ জনগোষ্ঠীর স্থায়ী নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সাংবিধানিক, নৈতিক দায়িত্ব।”
আদিবাসী খাসিয়া জনগোষ্ঠীও যে এদেশের নাগরিক, সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, “তাদের নাগরিক-রাজনৈতিক অধিকার রয়েছে, তাদের অর্থনৈতিক সামাজিক সাংস্কৃতিক অধিকার রয়েছে। আজকের আলোচনা থেকে দেখতে পেলাম তাদের সব অধিকার ভয়ানকভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে।
“যারা এ কাজগুলো করছেন, তাদের কোনো রকম সংকোচ যেন নেই। বিচারহীনতার সংস্কৃতি আমাদের এখানে বহমান, সে কারণে তারা মনে করে এগুলো করে পার পেয়ে যাবে।”
বন বিভাগ বন সংরক্ষণের দায়িত্বে থাকলেও তাদের কাজে ‘বন সংরক্ষণের কোনো বালাই নেই’ বলে মন্তব্য করেন সুলতানা কামাল।
তিনি বলেন, “বন বিভাগই বনের পর বন উজার করে দিচ্ছে। আমাদের একটা হিসেব নেওয়া উচিত যে, কয়জন আদিবাসী মানুষ বনে থেকে লক্ষপতি-কোটিপতি হয়েছেন। আর বন বিভাগের সঙ্গে যুক্ত এবং তাদের প্রশ্রয়প্রাপ্ত ব্যক্তিরা এই বন থেকে কতজন লক্ষপতি-কোটিপতি হয়েছেন। ”
সুলতানা কামাল বলেন, “প্রচুর দৃষ্টান্ত আছে বনখেকো হিসেবে যাদের নাম, তারা কিন্তু আদিবাসী সম্প্রদায়ের বাইরে। তারা অনৈতিক ও দুর্নীতির মাধ্যমে বন থেকে রোজগার করেছেন।”
বন বিভাগ দেশের ‘কোনো উপকার করেনি’ বলে সংবাদ সম্মেলনে মন্তব্য করেন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মোহাম্মদ নিজামুল হক নাসিম।
আপিল বিভাগের সাবেক এই বিচারক বলেন, “আজকে আমরা বন বিভাগের কাজ নিয়ে আলোচনা করছি, আমার মনে হয় বন বিভাগ হল একমাত্র বিভাগ, যাদের দিয়ে বাংলাদেশের এক পয়সার উপকার হয়নি আজ পর্যন্ত। তারা শুধু জানে গাছ কাটতে, আর জানে গাছের এলাকা থেকে লোকদের তাড়িয়ে সেসব জায়গা দখল করতে।”
বন বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পত্তির হিসাব নেওয়ার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, “এটা এমন একটা বিভাগ, আমি বলব প্রতিটি স্টাফ, প্রতিটি অফিসার, যারা গত ২০/২৫ বছর ধরে অবসরে গেছেন, তাদের প্রত্যেকের সম্পত্তির হিসাব নেওয়া উচিত দুদকের। দেখা উচিত তারা আমাদের কী উপহার করেছে। কারণ তারা যদি সেগুলো চুরি না করত, তাহলে অন্তত সেই টাকাগুলো দেশের হাতে থাকতো এবং দেশের উপকারে আসত।”
দেশের বনাঞ্চলগুলোতেই যে বেশিরভাগ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বসবাস, সে বিষয়টি তুলে ধরে সাবেক বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম বলেন, “তাদেরকে উৎখাত করাই এদের (বন বিভাগ) একমাত্র কাজ। কেন, কোন আইনের বলে তারা এটা করছেন? এটা আমি চিন্তাও করতে পারছি না। শুনতেছি গত চার/পাঁচ দিনে নাকি রাস্তায় আটকে তাদের মারধর করা হচ্ছে। এটা আরও মারাত্মক কথা। দেশে কী আইনশৃঙ্খলা নেই? আমার দেশে কী পুলিশ নেই? তারা কী পারে না এদের রক্ষা করতে? রক্ষা করার জন্য এগিয়ে আসতে? তাদের উপস্থিতিতে এ ধরনে ঘটনা কীভাবে ঘটে?”
অন্যদের মধ্যে নিজেরা করির সমন্বয়কারী খুশী কবীর, বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং সংবাদ সম্মেলনে অংশ নেন।