এক বছর আগের কথা, করোনাভাইরাস মহামারীর সবে শুরু, লকডাউনের মধ্যে ঢাকার পশ্চিম আগারগাঁও এলাকার গাড়িচালক মো. শাকিলের বাসায় এসে চাল-ডাল, বাচ্চাদের খাবার দিয়ে গিয়েছিলেন একজন বিত্তশালী প্রতিবেশী।
Published : 08 Jul 2021, 10:46 AM
বছর গড়িয়ে আবার চলছে এখন লকডাউন। কিন্তু এবার তেমন করে কেউ আসেনি শাকিলের ঘরে।
“গত বছর হঠাৎ বাড়িতে আইসা টোপলা দিয়া গেল। বাচ্চা আছে শুইনা দুধের প্যাকেটও দিল। আশপাশের সব বাড়িতেই দিছে। এই বছর মানুষ আরও বেশি কষ্টে আছে। এহনও এরম কেউ টোপলা নিয়া আসে নাই,” বলেন শাকিল।
গত বছরের মার্চে লকডাউন শুরুর পর সঙ্কটে পড়া মানুষদের খাবার দিয়ে, খাদ্যসামগ্রী দিয়ে সহায়তা করতে নানা সংগঠনের কিংবা ব্যক্তি উদ্যোগে তৎপরতা ঢাকার বিভিন্ন স্থানে দেখা গিয়েছিল। সরকারি তৎপরতাও ছিল বেশ।
গতবার বড় রাস্তার ধারে, ফুটপাতে বসে থেকেও সহায়তা পেয়েছিল নিরন্ন মানুষ। সেই আশায় গত শুক্রবার মিরপুর ১২ নম্বরে সড়কে পাওয়া গেল এক ব্যক্তি ও তার মেয়েকে। কিন্তু তাদের আশা পূরণ হয়নি।
আব্দুল হাই নামের ওই ব্যক্তি ইট ভাঙার কাজ করতেন। লকডাউনে কর্মহীন হয়ে সাত বছরের মেয়েকে নিয়ে পথে নেমেছিলেন। অনভ্যাস আর লজ্জায় আড়ষ্ট ছিল শিশুটি।
আব্দুল হাই বলেন, গত বছরে পথে বসে থেকে কিছু খাবার পেয়েছিলেন। এ বছর সেই আশাতেই বসেছিলেন। তবে সাড়া পাচ্ছেন না।
বছর গড়ানোর পর মহামারী উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছায় এখন আবার কঠোর লকডাউন চলছে দেশে; অফিস-আদালত বন্ধ রেখে সবাইকে বলা হয়েছে ঘরে থাকতে। এর ফলে বন্ধ হয়েছে আব্দুল হাইয়ের মতো অনেকের আয়-রোজগার।
এদের মতো মানুষদের খাবার দিতে যারা গতবার নেমেছিলেন; সেই সব স্বেচ্ছাসেবীরা বলছেন, নানাজনের অর্থ সহায়তা নিয়ে এই কাজ করেন তারা। কিন্তু এবার সহায়তা তেমন মিলছে না।
এটা যেমন রাজধানীর ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, অন্য জেলাগুলোতেও তাই।
গত বছর লকডাউনে ঠাকুরগাঁওয়ের কর্মহীন মানুষের মাঝে খাবার বিতরণ, হ্রাসকৃত মূল্যে বাজারের ব্যবস্থা, নামমাত্র মূল্যে ঈদের বাজারের ব্যবস্থা করেছিল ‘জুলুম বস্তি’ নামের একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্মে জড়ো হওয়া তরুণ-যুবারা। এবার তহবিলের অভাবে মানুষের পাশে সেভাবে দাঁড়াতে পারছে না তারা।
‘জুলুম বস্তি’র উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ফারুক হোসেন জুলু বলেন, গত বছর তারা সব মিলিয়ে প্রায় ৯ লাখ টাকা তুলেছিলেন। ওই টাকা দিয়ে খাবার বিতরণ ছাড়াও ৩০ শতাংশ কম মূল্যে বাজার, ৫ টাকায় ঈদ বাজারের মতো প্যাকেজ নিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। গত বছর ঈদের আগে পাঁচ টাকায় ৪৩০ টাকার বাজার তারা দিয়েছিলেন।
এবছর ‘জুলুম বস্তি’ এখন পর্যন্ত কেবল সাতটি অক্সিজেন সিলিন্ডার কিনতে পেরেছে। ওই সিলিন্ডারগুলো তারা গরিব মানুষদের বিনামূল্যে ব্যবহার করতে দেন।
এবার এই ক’টি অক্সিজেন সিলিন্ডারের টাকা জোগাড় করতেই অনেক কষ্ট করতে হয়েছে বলে জানান ফারুক।
গতবার তাদের তহবিল জুগিয়েছিলেন পরিচিত ব্যক্তি, বিত্তশালী, রাজনীতিবিদরা। এবার সেখান থেকে খুব সাড়া তারা পাননি।
ফারুক বলেন, পৌরসভার নির্বাচনের আগে গত বছর অনেক রাজনীতিবিদ সহায়তা দিয়েছিলেন, এবার কেউ দেননি।
“এবার সেভাবে কারোই সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না,” বলেন তিনি।
ঢাকায়ও একই অভিজ্ঞতার কথা শোনালেন ‘৪৫০ টাকায় এক সপ্তাহ’ প্ল্যাটফর্মের সমন্বয়ক ফেরদৌস আহমেদ উজ্জ্বল।
গত বছর লকডাউনের সময় ঢাকায় মাসব্যাপী মানুষকে খাইয়েছিল ‘চাল, ডাল, আলু- বাঁচার জন্য- ৪৫০ টাকায় এক সপ্তাহ’ নামের এই অনলাইন প্ল্যাটফর্ম। যার সমন্বয়কের দায়িত্বে রয়েছেন সাবেক ছাত্রনেতা ও বর্তমানে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের সম্পাদক উজ্জ্বল।
তিনি বলেন, গত বছর প্রায় ১২ লাখ টাকার মতো খাদ্য ও নগদ সহায়তা বিতরণ করেছিলেন তারা। চাকরিজীবী, ছাত্রসহ বিভিন্ন স্তরের মানুষের সহযোগিতায় তারা এই কাজ চালিয়ে যান।
“মানুষের অনুদানের টাকাতেই এত কিছু করা গেছে। তবে এবার এই কাজে মানুষের সাড়া একদমই কম, নেই বললেই চলে।”
উজ্জ্বল জানান, গত বছরের মার্চে তারা কয়েকজন চাল, ডাল, আলু বিতরণের মধ্য দিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াতে শুরু করেন। ৪৫০ টাকার একটা প্যাকেজে থাকত ৫ কেজি চাল, ১ কেজি ডাল, ২ কেজি আলু, আধা লিটার তেল ও সাবান। তহবিল বাড়ার পর প্যাকেজের সংখ্যা বাড়ত। বছর শেষে হিসাব করে দেখা গেছে প্রায় এক হাজার ২০০ মানুষকে ওই তহবিলের মাধ্যমে চাল-ডাল দেওয়া হয়েছিল।
গত বছরের রমজানে চাল-ডাল বিতরণ বন্ধ করে রান্না করা ডিম-খিচুড়ি বিতরণ শুরু করেছিলেন উজ্জ্বলরা। ৫২টি পরিবারের ২০০ মানুষকে প্রায় দেড়মাস খাওয়ান তারা। এছাড়া প্রায় ২০ জনের মতো অন্তঃসত্ত্বা নারীকে ৪ মাসের মতো পুষ্টিকর খাবার দেওয়া হয়। চারজনের সন্তান জন্মদানের খরচও ওই তহবিল থেকে দেওয়া হয়।
উজ্জ্বল বলেন, বছিলা সেতুর কাছে আটকে পড়া বেদের বহর, কিছু যৌনকর্মীকেও মাসখানেকের খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছিল। এর পাশাপাশি কাজ হারিয়ে দিশেহারা, খাবার টাকা নেই, এমন অনেক ব্যক্তিকে নগদ সহায়তাও দেওয়া হয়।
তহবিলের অভাবে এবছর এখনও কাজে নামতে না পারলেও পরিকল্পনা রয়েছে।
উজ্জ্বল বলেন, “এই বছর সেই অর্থে বড় অঙ্কের কোনো অনুদান আসেনি। গত বছরের তহবিলে অব্যবহৃত কিছু টাকা নিয়ে এবছর আমরা শুরু করতে যাচ্ছি। বুধবার থেকে কিছু লোককে চাল-ডাল দেওয়ার কার্যক্রম শুরু করব।”
গত বছর লকডাউন ঘোষণার পর টানা ১২১ দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় ভাসমান মানুষদের রান্না করা খাবার দিয়েছিলেন ডাকসুর সাবেক সদস্য এবং ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির উপ-সমাজসেবা বিষয়ক সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত ও তার বন্ধুরা।
এবার লকডাউন শুরুর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের আশে-পাশের এলাকার ভাসমান মানুষদের জন্য শনিবার থেকে আবার সেই কর্মসূচি শুরু করেছেন তারা।
গত বছর ৫০০ মানুষকে দুবেলা খাওয়াতে পারলেও এবার অর্থ সঙ্কটের কারণে শুরুতে দুদিন আড়াইশ লোকের একবেলা আহারের ব্যবস্থা করেন সৈকতরা।
সৈকত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নিজেদের যা টাকা-পয়সা ছিল, তাই নিয়েই নেমে পড়েছি। বন্ধু-বান্ধব ও বড় ভাইদের মধ্য কেউ কেউ সহায়তা করেছে। তবে আগের মতো সহযোগিতা পাচ্ছি না।”
ঢাকার তিনটি বস্তিতে গত শুক্রবার গিয়ে জানা যায়, সেখানে এবার এখনও কেউ সহায়তার হাত নিয়ে যায়নি।
মহামারীর দীর্ঘায়িত হওয়ায় নিম্ন মধ্যবিত্ত পেরিয়ে এখন মধ্যবিত্তের সংসারেও ধাক্কা লেগেছে বলে বিভিন্ন জরিপে উঠে এসেছে।
সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জে খাবারের জন্য সরকারের হটলাইনে ফোন করেন এক ব্যক্তি, যিনি ছোটখাট একটি কারখানার মালিক, পারিবারিক সূত্রে তার পাকা বাড়িও রয়েছে। ফোন পেয়ে গিয়ে বাড়ি-ঘর দেখে ওই ব্যক্তিকে অভাবী মনে হয়নি স্থানীয় ইউএনওর; তাকে জরিমানাও করা হয়। কিন্তু পরে জানা যায়, ওই ব্যক্তি সত্যিকারেই খাবার সঙ্কটে ছিলেন।
ঢাকায় টিসিবির ট্রাকের সামনে লকডাউনের মধ্যে এখন মধ্যবিত্তকেও দেখা যাচ্ছে।
শাকিলা আঞ্জুমান নামে একজন বলেন, “ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে গেছে, সংসারের খরচ তো কমাইতে পারতেছি না। খাওয়া-দাওয়া তো বন্ধ করে দেওয়া যাবে না। কিছুটা কম দামে পাব বলে এসেছি।”
ব্র্যাকের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, মহামারীর কারণে বাংলাদেশের ৭৭ শতাংশ পরিবারে গড় মাসিক আয় কমেছে, আর ৩১ শতাংশ পরিবারে ঋণ বেড়ে গেছে।
দৃশ্যত নিরন্নের সহায়তায় এগিয়ে আসা অনেকের জীবনেই এখন সঙ্কট নেমেছে, যার প্রভাবে টান পড়েছে স্বেচ্ছাসেবীদের তহবিলে।
সরকারের পক্ষ থেকে সারাদেশে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের মানবিক সহায়তা ১১ কোটি ৭০ লাখ টাকা এবং ২৩ হাজার ৬৩০ টন চাল বিতরণের ঘোষণা সোমবারই দিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। তবে সেই টাকা ও চাল কবে নাগাদ কর্মহীন মানুষের কাছে পৌঁছাবে, তা এখনও স্পষ্ট নয়।
গতবার বিভিন্ন এনজিও ত্রাণ ও নগদ সাহায্য নিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিল। এবার এনজিওগুলো এখনও ত্রাণ বিতরণ শুরু করেনি। তবে ত্রাণ বিতরণের জন্য তহবিল সংগ্রহ ও বণ্টনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে তিনটি এনজিওর কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।
[প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি রাসেল সরকার]