তেরটি ছোট পেঁপে আর তিনটি জালি কুমড়া নিয়ে রাস্তার পাশে বসেছেন সাহিদা বানু। তার পাশেই সাহারা খাতুন বসেছেন কয়েকটি কাটা বেগুন, কাঁচা মরিচ, বাসি চিচিঙ্গা আর ঝিঙ্গা নিয়ে।
Published : 03 Jul 2021, 01:12 AM
মিরপুর ৭ নম্বর পোড়া বস্তিতে ঢোকার গলির মুখে ফুটপাথে দেখা হল এই দুই নারীর সঙ্গে। মলিন মুখে ক্রেতার অপেক্ষায় তারা।
বেলা ১২টা পর্যন্ত সাহিদা ২০০ টাকার সবজি বেচতে পেরেছেন। আর সাহারার বিক্রি হয়েছে কেবল ৪০ টাকা।
সাহিদা বললেন, “গেল বছর বস্তিত আগুন লাগল, সব পুইড়া গেল। তবুও তহন ত্রাণ পাইছিলাম, আর্মিরাও আইসা চাউল-ডাউল দিয়া গেছিল। এই বছর আবার লকডাউন আইলো, পুলাপাইনডি এইবার এক্কেরে বহা। কারও কামাই নাই। আমি আর কী করি, দুইডা বাসি-বুসি মাল টোহাইয়া আইন্যা বইছি।”
বেচা-বিক্রি ভালো হয়নি বলে সাহারার মেজাজ খারাপ, কপালে চিন্তার ভাঁজ। উদ্বেগের কারণ ফুটে ওঠল তার কথায়।
“কারও কাম নাই। আরও দুইদিন হয়ত চলব। গেল বার আশপাশের বাড়িওলারাও চাউল-ডাউল-সাবান দেছিল। এইবার কিচ্ছু নাই।
“খামু কী! সরকাররে কন আমাগো খাওন দিব। নাইলে গরিব মানুষ বাঁচব ক্যামনে।”
এই দুজনের সঙ্গে কথোপকথনের মধ্যে বস্তি থেকে আরও কয়েকজন বের হয়ে এলেন। তারা ভেবেছিলেন বোধ হয় ত্রাণের জন্য তালিকা করতে লোক এসেছে। ত্রাণ পাওয়া যাবে না শুনে কয়েকজন একটু রেগেই গেলেন।
এক তরুণ বললেন, “গাড়ি-ঘোড়া দোকানপাট সব বন্ধ, আমরা কী কইরা খামু? আমরা তো ফিরিজে খাওন ভইরা রাখতে পারি না।”
এই সময়ে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ বাড়ির বাইরে বের হতে পারবেন না। জরুরি পরিষেবা ছাড়া সব সরকারি-বেসরকারি অফিস বন্ধ থাকবে। জরুরি পণ্যবাহী পরিবহন ছাড়া সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে।
করোনাভাইরাসের বিস্তার নিয়ন্ত্রণে জারি করা ‘কঠোর লকডাউন’ বাস্তবায়নে মাঠে এবার সেনাবাহিনী রয়েছে; ‘অপ্রয়োজনে’ বের হওয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তারও চলছে।
সাহিদা আর সাহারার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সামনে কিছুদূর এগোতেই দুয়ারিপাড়া খালপাড়ে ভোলা বস্তি।
এই বস্তির বেশিরভাগ মানুষ ভোলা জেলার ইলিশা এলাকার। নদী ভাঙনে সব হারিয়ে তারা ঢাকায় এসে এ বস্তিতে উঠেছিলেন। তাই এর নাম হয় ভোলা বস্তি, স্থানীয়দের ভাষায় ‘ভোলাইয়া বস্তি’।
একসময় বস্তিটা ছিল বিশাল এলাকা নিয়ে। জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ বস্তি উচ্ছেদ করে নিজেদের জায়গা বুঝে নেওয়ায় এখন খালপাড় ধরে লম্বা হয়ে ছড়িয়ে গেছে বসতি।
বস্তির মুখে চায়ের দোকান ঘিরে তরুণ-যুবাদের জটলা। এরা সবাই বস্তিরই মানুষ। কেউ কাজে যাননি, বস্তির ছোট্ট ঘরে দিনভর থাকাটাও কঠিন। তাই সবাই এখানে জটলা করছেন।
বস্তির ভেতরে ঢুকে কিছুদূর যেতেই গোসলখানা। এর সামনে নারী-পুরুষের আরেক জটলা।
‘দিন কেমন চলছে’ জটলার মাঝে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতেই কিছুটা ঝাঁঝালো কণ্ঠে কবির হোসেন নামে একজন বললেন, “দোকান বন্ধ, এহন বেতন পাই কী না সন্দেহ। ঘরে তিন বাচ্চা।’
কবিরের পাশে দাঁড়ানো মধ্যবয়সী মীরজাহানও গৃহকর্মী হিসেবে মানুষের বাসায় কাজ করতেন।
তিনি বললেন, “বাড়িওয়ালি কইছে বুয়াগো লাইগা তাগো সবার করোনা হইতারে। এই কারণে ওই বিল্ডিংয়ে বুয়াগো ঢুকা বন্ধ করছে। এহন আমাগো তো খাওন নিয়া টানাটানি।”
বস্তির ভেতরে একটি ঘরে দুই ছেলে-মেয়েকে নিয়ে ভাড়া থাকেন মাসুমা আক্তার। মাস শেষে ভাড়া দিতে হয় তিন হাজার টাকা। তিনিও বাসা-বাড়িতে কাজ করতেন, এখন বন্ধ।
১৫ বছরের ছেলে শামীমকে স্কুল ছাড়িয়ে ছোট একটি পোশাক কারখানায় কাজ নিয়ে দিয়েছেন। বেতন-বোনাস মিলিয়ে ছেলে আট হাজার টাকা পায়। এখন ছেলের আয়েই ভরসা।
মাসুমা বলেন, “স্বামীর লগে ছাড়াছাড়ি হইছে বহুদ্দিন। আমিই সংসারটা চালাচ্ছিলাম। এহন কোমরের ব্যথায় বেশি কাম করতে পারি না। একটা বাড়িতে করতাম, এখন তাও বন্ধ।”
বস্তিতে মাসুমার ছেলের মত স্কুল ছেড়ে কাজে ঢোকা কিশোরের সংখ্যা এখন অনেক। তাদের একজন সোহেল জানায়, স্থানীয় মডেল স্কুলে পড়ত সে। গত বছরই লকডাউনে পরিবারের দুর্দশার মুখে সে স্কুল ছেড়ে পোশাক কারখানায় কাজে ঢুকেছে।
ভোলা বস্তিতেও বাইরের মানুষ দেখে অনেকে ভেবেছিলেন- বোধ হয় ত্রাণ দেওয়া হবে। তাই জাতীয় পরিচয়পত্র হাতে ছুটে এসেছিলেন কয়েকজন। তারা বলতে থাকেন, ‘আমার নামটা রাইখেন’।
একজন বলেন, ‘গেল বছরে কইছিল রিলিফের কার্ড দিব, নাম-ধাম নিয়া গেল। হেই কার্ড এহনো পাইলাম না। আল্লাই জানে কার কার্ড কেডা খাইতাছে?”
কঠোর লকডাউনের এই বিধিনিষেধে সবচেয়ে দুর্দশার মধ্যে পড়েছে সেসব মানুষ, যাদের প্রতিদিন কাজ না করলে ভাত জোটে না। আগের লকডাউনে কাজের খোঁজে বের হওয়া গেলেও এবার আছে গ্রেপ্তারের ভয়।
এবারের লকডাউনেও সরকার ঘরবন্দি এসব দরিদ্র মানুষদের ঘরে ঘরে ত্রাণ পৌঁছানোর ঘোষণা দিয়েছে। তবে সেই ত্রাণ না পাওয়ার কথাও অতীতে অনেকে বলেছেন। আবার ত্রাণ নিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগও ছিল।
ভোলা বস্তি থেকে বেরিয়ে ঝিরি ঝিরি বৃষ্টির মধ্যে মিরপুর ১০ নম্বরের দিকে যাওয়ার পথে চোখে পড়ল এক বাবা আর মেয়েকে। ১২ নম্বরের ৩ নম্বর সড়কের ফাঁকা ফুটপাতে জবুথবু হয়ে বসে ছিলেন দুজনে।
কাছে গিয়ে নাম জিজ্ঞেস করতেই ভয় পাওয়া কণ্ঠে বললেন, “আবদুল হাই। বালুর মাঠে থাকি স্যার, ঘরে খাওন নাই। মাইয়াডারে নিয়া বাইর হইছিলাম, যদি কিছু ব্যবস্থা করতে পারি।’
সাংবাদিক পরিচয় দেওয়ার পর আবদুল হাই বুঝলেন। তিনি এতক্ষণ ভেবেছিলেন পুলিশের লোক।
একটু হাঁফ ছেড়ে বললেন, তিনি ইট ভাঙার কাজ করেন। মাস দুয়ের আগে মাচা থেকে পড়ে গিয়ে আহত হন। তারপর থেকে শরীরে শক্তি পান না, হাত কাঁপে। তবুও টুকটাক কাজ করছিলেন, এখন লকডাউনে সব বন্ধ।
১৭ বছরের বড় ছেলে সাগর বাসে ‘হেলপারি’ করে। এখন ছেলেরও আয় বন্ধ। চার ছেলে-মেয়ে নিয়ে খুবই বিপদে পড়ে গেছেন, ঘরে খাবার নেই।
আবদুল হাই বলেন, “কী কমু ভাই, মাইনষের কাছে হাত পাতার অভ্যাস নাই, লজ্জা লাগে। গেলবছর রাস্তায় বইয়া ছিলাম লোকে কিছু চাউল-ডাউল দিয়া গ্যাছে। কিন্তু এই বছরে কিচ্ছু নাই। ক্যামনে যে চলুম সরকার কী আমাগো দিকে দ্যাখব না?’