বড় মেয়ের ছেলে হয়েছে, কিছু জটিলতার কারণে ঢাকা মেডিকেলে থাকতে হচ্ছে। মনোয়ারা বেগম মেয়ের সঙ্গে হাসপাতালেই ছিলেন। রাতে ছেলে বাবলুর আসার কথা ছিল, কিন্তু এল না। সকাল বেলা মনোয়ারা জানলেন, মাস্ক না পরে বের হওয়ায় বাবলুকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে।
Published : 04 Jul 2021, 12:53 AM
ছেলের খোঁজে মিরপুর থানায় গেলে সেখান থেকে কোর্টে যেতে বলা হয় মনোয়ারাকে। ছোট মেয়ে রেহানাকে সঙ্গে নিয়ে হন্যে হয়ে কোর্টে যান তিনি। শনিবার দুপুরে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের সামনে কথা হয় মা ও মেয়ের সঙ্গে।
আদালত চত্বরে দেখা গেল তাদের মত শতাধিত উদ্বিগ্ন মানুষ, যাদের স্বজন বা বন্ধু কেউ সরকার ঘোষিত লকডাউনের বিধিনিষেধ ভঙ্গের দায়ে গ্রেপ্তার হয়েছেন।
এরকম অন্তত ২০ জন স্বজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, গ্রেপ্তারদের কেউ দোকান কর্মী, কেউ রাজমিস্ত্রী বা পরিবহন শ্রমিক, কিংবা ভাসমান ব্যবসায়ী। প্রায় সবাই নিম্ন আয়ের লোক। স্বজনেরা আইনজীবী ধরে তাদের ছাড়ানোর ব্যবস্থা করছেন।
ভিড়ের মধ্যে যেন ঠিক স্বস্তি পাচ্ছিলেন না শীর্ণ দেহের মনোয়ারা। আদালতের সামনে উপস্থিত আরও কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে বোঝার চেষ্টা করছিলেন, এখন কী করা উচিত তার। তাদের পরামর্শেই একজন আইনজীবী ঠিক করলেন।
মনোয়ারা বলেন, “আগে কহনো কোর্ট-কাচারিত আহিনাই। কিছুই ঠাহর করবার পারতাছি না। উকিলে কইলো পোলারে বাইর করতে হাজার টাকা লাগব, আমি কবুল কইছি। বলছি পোলারে আইনা দাও, ট্যাহা দিমু।”
এমনিতেই বড় মেয়ের চিকিৎসার জন্য বাড়তি খরচ হচ্ছে। লকডাউনে ছেলে বাবলুও ঘরে বসা। এখন আবার তাকে ছাড়াতে জরিমানা, উকিলের ফি, গাড়িভাড়া সব মিলিয়ে দেড়-দুই হাজার টাকা খরচ হয়ে গেছে জানিয়ে মনোয়ারা বললেন, এই টাকায় তাদের কয়েক দিনের খাবার খরচ হয়ে যেত।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়ায় বৃহস্পতিবার সারা দেশে সাত দিনের লকডাউনের বিধিনিষেধ শুরু হয়। অফিস-আদালত বন্ধ রাখার পাশাপাশি যান্ত্রিক যানবাহন চলাচলেও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়।
সরকার আগে থেকেই বলে আসছিল, এবারের লকডাউন সত্যিই ‘কঠোর’ হবে। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বের হলেই পড়তে হবে গ্রেপ্তার, জরিমানার মুখে।
পুলিশের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী বৃহস্পতি ও শুক্রবার দুই দিনে ৮৭০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ঢাকায়। শনিবার গ্রেপ্তার করা হয় আরও ৬২১ জনকে।
তাদের প্রায় সবাইকে ঢাকা মহানগর পুলিশ অধ্যাদেশের (ডিএমপি অ্যাক্ট) কয়েকটি ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠাচ্ছে পুলিশ।
শনিবার দুপুরে আদালত প্রাঙ্গণে দেখা গেল, পুলিশের আসামিবাহী একেকটি গাড়ি আসার সঙ্গে সঙ্গে স্বজন ও আইনজীবীরা দৌড়ে যাচ্ছেন। নিজেদের স্বজন বা মক্কেলের নাম ধরে ডাকাডাকি করছেন।
অর্ধ শতাধিক আইনজীবী আদালত চত্বরেই স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে পরামর্শ দিচ্ছেন, জরিমানা দিয়ে ছাড়িয়ে আনার দায়িত্ব নিচ্ছেন।
মো. ইসমাইল হোসেন নামে একজন আইনজীবী বললেন, ডিএমপি অ্যাক্টের ১০০, ৭৭, ৭৮ ও ৬৯ ধারায় বেশিরভাগ ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। আদালত অভিযোগ বুঝে ২০০ থেকে ৭০০ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করছে।
‘অপ্রয়োজনে’ বের হওয়ার অভিযোগে কামরাঙ্গীরচরের ভাসমান ফল ব্যবসায়ী ইলিয়াস হোসেনকে শুক্রবার রাতে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাকে ছাড়াতে আদালতে এসেছিলেন ভাই ইব্রাহীম।
তিনি বলেন, “উকিলে কইছে তিনডা ধারা দিছে, হাজার টাকা জরিমানা হইতে পারে। এই কারণে হ্যাতে দেড় হাজার টাকা চায়। আমি কইছি আমার ধারে বারোশ টাকাই আছে। তারপর উকিলে রাজি হইছে।”
লকডাউনে রোজগার বন্ধ, তার মধ্যে জরিমানা গুনতে গিয়ে কষ্ট আরও বেড়ে গেছে ইব্রাহীমের।
তিনি বলেন, “আমরা করি কাঁচামালের ব্যবসা। মাল একবার আইন্না বেচতে না পারলে তো চালানসুদ্ধা লস। ব্যবসা বাঁচামু না বউ-পোলাপাইনরে খাওয়ামু? এহন পুলিশ যদি দোহানদারী করতে না দেয়, তাইলে নিশ্চিত চালানসুদ্ধা যাইবোগা, চালান গ্যালেগা আবার ঋণ করতে হইব, গরীবের যে কি জ্বালা!”
বংশালের একটি বেকারির কর্মী আল আমিনকে শনিবার সকালে দোকান খুলতে না খুলতেই ধরে নিয়ে আসে বংশাল থানার পুলিশ। তাকে ছাড়াতে আদালতে এসেছিলেন দোকান মালিকের ভাই তাজুল ইসলাম।
তিনি বলেন, “পুলিশ আমাগো কয় অনলাইনে বেচতে। আরে ভাই আমরা ছোট দোকানদার, মহল্লার লোকজন আমাগো কাস্টমার। আমরা কইত্তে অনলাইনে বেচুম।
“কিন্তু হ্যারা শুনব না, দোকান খুলতে দিব না। পরে আমাগো কর্মচারী একজনরে উডায়া নিয়া গেল। পাঁচ আনি মামলা দিছে, আটশ টাকায় চুক্তি করলাম উকিলের লগে।”
কবিরের ভাষ্য, আসবাবপত্র ব্যবসায়ী শহীদুল দোকানের শাটার নামিয়ে ভেতরে কাজ করছিলেন। পুলিশের গাড়ি গিয়ে তাকে ধরে নিয়ে আসে।
“আমার ভাই বুঝতে পারে নাই যে এত্ত কড়া লকডাউন হইব। হ্যাতে একাই কাম করতেছিল, তাও ধইরা নিল।”
এবার কঠোর হওয়ার বার্তা দিয়ে লকডাউন শুরুর আগে বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার মুহা. শফিকুল ইসলাম বলেছিলেন, “জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ ঘর থেকে বের হলেই তার বিরুদ্ধে মামলা হতে পারে, তিনি গ্রেপ্তার হতে পারেন। যদি এমন পরিস্থিতি তৈরি হয় যে প্রথম দিনে ৫০০০ মামলা ও গ্রেপ্তার করতে হচ্ছে, আমরা তাও করব।”
তবে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের মহাসচিব মানবাধিকার কর্মী নূর খান মনে করেন রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে মানবিক হওয়া ‘বাঞ্ছনীয়’।
“আমি নিজে পরশু মোহাম্মদপুর থানায় গিয়ে যাদের গ্রেপ্তার হতে দেখলাম, তাদের অধিকাংশই নিম্ন আয়ের মানুষ। কেউ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, কেউ নির্মাণ শ্রমিক। এভাবে ভয় দেখিয়ে, শক্তি প্রয়োগ না করে বরং মানুষকে সচেতন করা এবং দুর্দশার সময়ে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস সরবরাহ করা বাঞ্ছনীয় ছিল।”
তবে গ্রেপ্তার সবাই নিম্ন আয়ের মানুষ- এরকম বলার ‘সুযোগ নেই’ বলে ঢাকা মহানগর পুলিশের গণমাধ্যম বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার ইফেতেখায়রুল ইসলামের ভাষ্য।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আটশর মত গাড়ির বিরুদ্ধেও মামলা হয়েছে। এখন গাড়ির মালিকেরা তো উচ্চ আয়ের লোক।”
জরুরি পরিষেবার বাইরে যারাই বিধিনিষেধ ভঙ্গ করে ‘একদম অপ্রোয়জনে’ বাইরে ঘোরাফেরা করছেন, কেবল তাদেরই গ্রেপ্তার করা হচ্ছে দাবি করে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, “এক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের তত্ত্বাবধানে খুবই সতর্কভাবে যাচাই করা হচ্ছে।”