অভিনেতা মুজিবুর রহমান দিলুর প্রতি শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন শিল্পাঙ্গনের কলাকুশলীরা।
Published : 19 Jan 2021, 05:22 PM
মঙ্গলবার বিকাল ৩টার পর অভিনেতা দিলুর মরদেহ নিয়ে আসা হয় শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালা প্রাঙ্গনে।
সেখানে অস্থায়ী বেদিতে একে একে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন শিল্পকলা একাডেমি, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন, নাটকের দল থিয়েটারসহ আরও বেশকিছু সংগঠন।
অভিনেতা দিলুর ছোট ছেলে অতুল রহমান দেশের বাইরে থাকায় তিনি বাবার দাফনে অংশ নিতে পারেননি। তিনি একটি ভয়েস রেকর্ড পাঠান, যা পড়ে শোনান বড় ছেলে অয়ন রহমান।
বার্তায় অতুল বলেন, “বড় হওয়া পর্যন্ত একজন মানুষকেই সবচেয়ে সৎ দেখেছি, তিনি আমাদের বাবা। বাবার জন্য আপনারা সবাই দোয়া করবেন।”
অভিনেতা মুজিবুর রহমান দিলুর বড় ভাই নাট্য নির্দেশক আতাউর রহমান বলেন, “আমরা ছয় ভাই ও দুই বোন ছিলাম, আমি সবার জ্যেষ্ঠ। আজ আমাদের এক ভাই চলে গেল।
“১৫ বছর আগে গুলেনবারি সিনড্রোমে আক্রান্ত হয়েও সে ফিরে এসেছিল। দিলুর ছিল অপূর্ব জীবনীশক্তি। সেই জীবনীশক্তির কারণেই সে অপরাজিত।”
আতাউর রহমান জানান, ২০০৫ সালের পর থেকে অভিনয় জীবন থেকে নিজেকে কিছুটা দূরে সরিয়ে রাখলেও শিল্পের মানুষদের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল।
বীর মুক্তিযোদ্ধা দিলুর যুদ্ধকালীন স্মৃতির চুম্বক অংশ তুলে ধরে আতাউর রহমান কান্নাভেজা কণ্ঠে বলেন, “দিলু মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিল কাউকে না বলে, বাসা থেকে পালিয়ে গিয়ে সে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়েছিল। যুদ্ধ শেষে যখন ফিরে আসে তখন তার রণক্লান্ত অবস্থা থেকে তাকে চেনার উপায় ছিল না। তখন আমি কাজ করি এক বিদেশি সংস্থার অফিসে। সে আমার অফিসে এসেছিল।অনেক কথার পর তাকে আমরা চিনতে পারি।
বীর মুক্তিযোদ্ধা দিলু একাত্তরে যুদ্ধ করেছেন ২ নম্বর সেক্টরে। ঢাকা উত্তরের যুদ্ধে তার কমান্ডার ছিলেন নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু।
নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু বলেন, “মাত্র ১৮ বছর বয়সে অভিনেতা দিলু দেশমাতৃকার ডাকে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে সে যখন মুক্তিযুদ্ধে গেল, তখন সে ভালো করেই জানত এ মহান কাজে তাকে জীবনও দিতে হতে পারে। কিন্তু সে ছিল অকুতোভয়।”
রণাঙ্গনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব বাচ্চু বলেন, “মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সে যুদ্ধ করেছিল আমাদের সাথে ঢাকা -২ নম্বর সেক্টরে। রাইসুল ইসলাম আসাদ ও কাজী শাহাবুদ্দিন শাহজাহানের মতো সেও ছিল এক দুর্ধর্ষ গেরিলা যোদ্ধা। যুদ্ধকালীন সময়ে আমাদের বেশ কয়েকটি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়া হল।
“তখন আমাদের সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফ দায়িত্ব দিলেন, এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করতে হবে। কাজটা বেশ কঠিন। তখন গুটিকয়েক হলেও শিক্ষার্থী ক্লাস করতে যাচ্ছিলেন, সেখানে বোমা হামলা হলে তো আমাদের বন্ধুরাই মারা পড়বে। দিলুর উপর দায়িত্ব পড়ল ঢাকা কলেজ বন্ধ করার। সে দিনে দুপুরে সাধারণ ছাত্রের বেশে ঢাকা কলেজে ঢুকে পড়ল। তখন সবাই জেনে গেছে, দিলু গেরিলা যোদ্ধা। দিলু তড়িৎ গতিতে বোমা মেরে চলে আসল। ঢাকা কলেজ বন্ধ হয়ে গেল।”
দিলুর অভিনয় জীবন নিয়ে নাসির উদ্দীন বলেন, “আমাদের অনুজ দিলু যখন মঞ্চে এল, তখন ‘আমি গাধা বলছি’, ‘নানা রঙের দিনগুলি’ কীভাবে তাকে জনপ্রিয়তা এনে দিল সে তো আমাদের চোখের দেখা। আশির দশক থেকে যারা নাট্যচর্চায় যুক্ত হয়েছে, তারা সকলেই জানে দিলুর ছিল সকল চরিত্রে পারঙ্গম। তার মতো চমৎকার কণ্ঠস্বর ও উচ্চারণ খুব কম জনের হয়। দিলুর চলে যাওয়া ইতিহাসের বড় অংশের বিদায়।”
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী বলেন, “নিভৃতচারী মানুষ ছিলেন অভিনেতা দিলু। তার লক্ষ্যই ছিল, ভালো কাজের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত রাখা। যারা নীরবে নিভৃতে দেশ, সমাজ ও শিল্পের উৎকর্ষ সাধনের জন্য কাজ করে যান, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা সবসময়ই আমাদের আলাদা রকম বেশি।”
মঙ্গলবার ভোরে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসা অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন অভিনেতা মুজিবুর রহমান দিলু। পরে জোহরের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদে তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
শিল্পকলা একাডেমিতে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর মঙ্গলবার বাদ আসর বনানী কবরস্থানে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয়েছে অভিনেতা মুজিবুর রহমান দিলুকে।