প্রতিদিনই বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ-বিআরটিএর বিভিন্ন সার্কেল ও জেলা কার্যালয়ে ভিড় করছেন চালকরা। সবারই একটাই উদ্দেশ্য, স্মার্ট লাইসেন্স।
Published : 23 Nov 2020, 10:44 PM
নতুনদের সঙ্গে লাইসেন্স নবায়ন করতে দেওয়া চালকরাও রয়েছেন তাদের মধ্যে। কিন্তু প্রতিদিনই তাদেরকে ব্যর্থ হয়ে ফিরতে হচ্ছে।
দেড় বছরের বেশি সময় ধরে বিআরটিএ স্মার্ট লাইসেন্স দেওয়া বন্ধ রাখায় চালকদের এই ভোগান্তি।
বিআরটিএর তথ্য অনুযায়ী, সাড়ে সাত লাখ চালক স্মার্ট ড্রাইভিং লাইসেন্সের অপেক্ষায় আছেন। এসব চালকরা গাড়ি চালাচ্ছেন বিআরটিএর ‘অ্যাকনলেজমেন্ট স্লিপ’ দিয়ে।
চালকরা বলছেন, স্মার্ট কার্ড না পাওয়ায় সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে আবেদন করতে পারছেন না তারা। বিদেশগামী চালকরাও আছেন দুর্ভোগে।
বিমানবন্দর এলাকার বাসিন্দা জাকির হোসেন গত বছরের জানুয়ারিতে ড্রাইভিং লাইসেন্স নবায়ন করতে দিয়েই পড়েছেন বিপদে। এ পর্যন্ত বিআরটিএ থেকে তিনবার তারিখ দিলেও তিনি হাতে পাননি স্মার্ট লাইসেন্স। গত বৃহস্পতিবার (১৯ নভেম্বর) আরেক দফা মিরপুরে বিআরটিএ কার্যালয়ে আসেন তিনি। কিন্তু এদিনও তারিখ নবায়ন করা হয়েছে তার।
ক্ষুব্ধ জাকির বলেন, তিনি পেশাদার চালক; বিভিন্ন কোম্পানির গাড়ি চালান। স্মার্ট লাইসেন্স না পাওয়ায় কোথাও স্থায়ী চাকরিও পাচ্ছেন না।
“একটি কোম্পানিতে চাকরির জন্য আবেদন করেছিলাম। এখন সেখান থেকে বলছে, স্মার্ট কার্ড লাগবে। অনেকেই স্মার্ট কার্ড শো করে চাকরি নিশ্চিত করতেছে। আমি পড়লাম বিপদে। এর আগে স্মার্ট কার্ড না থাকার কারণে অনেক জায়গায় চাকরি হয়নি।”
ওইদিন বাসচালক আল আমিন স্মার্ট লাইসেন্স নিতে একই কার্যালয়ে এসে জানতে পারেন তার কার্ডটি তৈরি হয়নি। যে স্লিপ দেওয়া হয়েছে তাতে আবার সময় বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
আল-আমিন বলেন, “কাগজের স্লিপ নিয়ে সমস্যার শেষ নেই। দুই-তিনটা কাগজ একত্র করে স্ট্যাপলার মেরে দিয়েছে। বেশ কয়েকবার বৃষ্টিতে ভিজে এই কাগজের এখন আর অস্তিত্ব নেই বললেই চলে।”
জরাজীর্ণ কাগজ দেখিয়ে তিনি বলেন, “এই যে দেখেন, কাগজ ভাঁজে ভাঁজে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। এটা যদি কখনও পুলিশ চেক করতে চায় তাহলে দেখাই কী করে? খুলতে গেলেই তো টুকরো টুকরো হয়ে আলাদা হয়ে যাবে। এতো বড় কাগজ পকেটে রাখাও প্রবলেম। স্মার্ট কার্ডটা যদি থাকত তাহলে এই প্রবলেম হইত না।”
সরকারি কর্ম কমিশনের গাড়িচালক খায়রুল ইসলাম জানান, গতবছর ফেব্রুয়ারি মাসে ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য পরীক্ষা দিয়েছেন তিনি। পরীক্ষায় পাসের পর একটি রশিদ দেওয়া হয়েছে বিআরটিএ থেকে। তবে স্মার্ট লাইসেন্স পাননি তিনি।
“প্রতিবারই তারা কাগজের ওপর সিল মেরে মেয়াদ বাড়িয়ে দিচ্ছে, কিন্তু লাইসেন্সটা দিচ্ছে না। পকেটে থাকতে থাকতে কাগজটা এখন প্রায় ছিঁড়ে যাচ্ছে। এই কাগজ পেতে বহু ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে। কখন আবার পুরোপুরি ছিঁড়ে অকেজো হয়ে যায়, সেই ভয়ে আছি,” বলেন খায়রুল।
মিরপুরের ভাসানটেকের বাসিন্দা আবদুর রহমান বিআরএটিএতে গাড়ি চালানোর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। কিন্তু এখনও স্মার্ট লাইসেন্স না পাওয়ায় তিনি রাইড শেয়ারিংয়ের গাড়ি চালানোর জন্য নিবন্ধিত হতে পারছেন না।
রহমান বলেন, “অবসরের ফাঁকে ফাঁকে গাড়ি চালিয়ে কিছুটা রোজগারের চিন্তা করছিলাম। কিন্তু স্মার্ট ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকায় নিবন্ধন করতে পারছি না।”
২০১১ সালের নভেম্বর ১৭ অক্টোবর থেকে ইলেক্ট্রনিক চিপযুক্ত ডিজিটাল স্মার্ট ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়া শুরু করে বিআরটিএ ।
বর্তমানে ২৭ লাখ ২২ হাজার স্মার্ট লাইসন্সেধারী চালক আছেন। আর প্লাস্টিক কার্ড রয়েছে প্রায় এক লাখ চালকের।
টাইগার আইটি নামের একটি তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান প্রথম দফায় ১৩ লাখ ২২ হাজার এবং দ্বিতীয় দফায় পাঁচ বছরে ১৫ লাখ জন্য স্মার্ট লাইসেন্স সরবরাহ করে।
বিআরটিএ জানিয়েছে, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, বিভিন্ন রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম শুরু এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়াকড়ির চাপে ২০১৯ সালের শুরুতেই ১৫ লাখ স্মার্ট ড্রাইভিং লাইসেন্স বিতরণ শেষ হয়ে গেছে।
স্মার্ট ড্রাইভিং লাইসেন্স দিতে দেরির কারণ জানতে চাইলে বিআরটিএর পরিচালক (অপারেশন্স) সিতাংশু শেখর বিশ্বাস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, টাইগার আইটির কার্ড শেষ হয়ে যাওয়ার পর নতুন করে দরপত্র আহ্বান করে বিআরটিএ। নতুন করে ইজারা দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করলেও তা দুই দফা বাতিল করতে হয়। এ কারণে স্মার্ট কার্ড বিতরণের প্রক্রিয়াটি আরও পিছিয়েছে।
“এ বছরের ২৯ জুলাই পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য কার্ড তৈরি ও বিতরণের ইজারা পেয়েছে ভারতের মাদ্রাজ সিকিউরিটিজ প্রিন্টার্স প্রাইভেট লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি ৪০ লাখ ড্রাইভিং লাইসেন্স ইস্যু করবে। এজন্য খরচ হবে ১২০ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রতিটি কার্ডের জন্য ভারতীয় প্রতিষ্ঠানটি পাবে ৩০০ টাকা।
প্রতিষ্ঠানটি এ বছরের ডিসেম্বর মাস থেকে নতুন লাইসেন্স সরবরাহ শুরু করতে পারবে বলে জানান সিতাংশু।
স্মার্ট লাইসেন্স না পেয়ে চালকদের দুর্ভোগের বিষয়ে তিনি বলেন, এখনও কিছু কার্ড রাখা হয়েছে বিদেশগামীদের জন্য।
“বিদেশগামী চালকরা প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ স্মার্ট কার্ডের জন্য আবেদন করলে আমরা দিয়ে দিচ্ছি। তবে কোনোভাবেই দেশে কারও জন্য এই কার্ড দেওয়া হচ্ছে না। বিআরটিএ থেকে পুলিশকেও জানানো হয়েছে সাময়িক ড্রাইভিং লাইসেন্সটা যেন গ্রহণ করা হয়।”