তাদের ভাষ্য, বরং একের পর এক নির্যাতনের ঘটনা ঘটতে থাকায় যে অনিরাপদ পরিবেশ তৈরি হয়েছে, সেজন্য বাল্যবিয়েও কমছে না। এর পেছনে বাল্যবিয়ে নিরোধ আইনের একটি বিশেষ বিধানও সহায়ক হয়ে উঠেছে।
বাল্যবিবাহ নিরোধকল্পে ২০১৮ সালে সরকার যে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করে, সেখানে ২০২১ সালের মধ্যে বাল্যবিয়ে এক-তৃতীয়াংশ কমিয়ে আনার লক্ষ্য ঠিক করা হলেও এখনও যে খুব একটা অগ্রগতি হয়নি তার প্রমাণ জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের জরিপের তথ্যেই রয়েছে।
গত নভেম্বরে ইনস্টিটিউটের প্রকাশিত বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে অনুযায়ী, দেশে ২০-২৪ বছর বয়সী নারীদের ৫৯ শতাংশেরই ১৮ বছরের কম বয়সে বিয়ে হয়। এর আগে ২০১৪ সালে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল প্রতিষ্ঠানটি, তাতেও বাল্যবিয়ের হার একই ছিল।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১২-১৩ সালের মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার জরিপে দেশে ২০-২৪ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে ৫২.৩ শতাংশেরই বাল্যবিয়ে। অর্ধযুগ পর ২০১৯ সালে সেই জরিপে বাল্যবিয়ের হার কিছুটা কমে দাঁড়ায় ৫১.৪ শতাংশে।
সরকারি তথ্যের ভিত্তিতে ইউনিসেফ চলতি মাসে যে প্রতিবেদন দিয়েছে, তাতে দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি বাল্যবিয়ে হচ্ছে বাংলাদেশে, যা সারাবিশ্বে অষ্টম। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৮ বছর বয়সের আগে বিয়ে হয়েছে দেশে এমন নারীর সংখ্যা তিন কোটি ৮০ লাখ।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে বাল্যবিয়ে বন্ধ এবং সরকারের জাতীয় কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী ২০৪১ সালের মধ্যে বাল্যবিয়ে নির্মূলে গত দশকের তুলনায় যথাক্রমে কমপক্ষে ১৭ গুণ ও আট গুণ বেশি কাজ করতে হবে বলে প্রতিবেদনে জানিয়েছে ইউনিসেফ।
প্রতিবন্ধকতা কোথায়?
১৯২৯ সালের ‘চাইল্ড ম্যারেজ রেসট্রেইন্ট অ্যাক্ট’ অনুযায়ী, মেয়েদের ১৮ বছরের কম বয়সে বিয়ে দেওয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আইনটি বাতিল করে ২০১৭ সালে সরকার শাস্তি বাড়িয়ে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন প্রণয়ন করলেও তাতে ‘বিশেষ প্রেক্ষাপটে অপ্রাপ্ত বয়স্কের সর্বোত্তম স্বার্থে’ বিয়ের সুযোগ রাখা হয়।
নারী অধিকার কর্মীরা বলছেন, তাদের আপত্তির পরও আইনের এই বিশেষ বিধানটিই বাল্যবিয়ে রোধে প্রতিবন্ধক হয়ে উঠেছে।
বিশেষ বিধানটি বাল্যবিয়ে বাড়িয়ে দিয়েছে বলে মনে করছেন বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী আইনজীবী এলিনা খান।
“আগে গোপনে বাল্যবিয়ে হলে আমরা বাধা দিতাম। কিন্তু এখন বাল্যবিয়ে হওয়ার পর মেয়েকে একটা বাচ্চা নেওয়ার জন্য বাবা ও শ্বশুরবাড়ি থেকে চাপ দেওয়া হয়, যেন তারা কোনো ঝামেলায় না জড়ায়। বাচ্চাটাই হচ্ছে বিশেষ কারণ। তখন এই বিয়ে ভাঙবে কীভাবে?
“এখন শুধু বিয়েই দিচ্ছে না, বাচ্চা হওয়ার মতো ঘটনার কারণে মেয়েটিও স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ে যাচ্ছে। তাই এই ‘কালো আইন’ উঠিয়ে দিতে হবে।”
মেয়েদের নিরাপত্তাজনিত ও অর্থনৈতিক কারণকেও বাল্যবিয়ে না কমার কারণ হিসেবে দেখেন তিনি।
এলিনা খান বলেন, “প্রথম সমস্যা হচ্ছে এখন বাবা-মায়েরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। তারা মনে করে, যদি বিয়ে দিয়ে দিই, তাহলে বখাটে ছেলেদের হয়রানি বা ধর্ষণের ঘটনা ঘটবে না। এছাড়া মেয়েকে তাড়াতাড়ি বিয়ে দিলে অর্থনৈতিক চাপ কমবে। আবার ছেলেকে দেরিতে বিয়ে দেয়, কেননা এতে পরিবারে আরেকজন সদস্য বাড়বে।”
সম্পত্তিতে সমান অধিকার না থাকাকে বাল্যবিয়ের প্রধান কারণ হিসেবে মনে করেন বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে জাতীয় কমিটির সদস্য ও বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের নির্বাহী পরিচালক রোকেয়া কবীর।
“বাল্যবিয়ের প্রধান কারণ হচ্ছে, মেয়েশিশু ‘দায়’ হিসেবে পরিবারে থাকে। উত্তরাধিকারে সমান অধিকার না হওয়া পর্যন্ত মেয়েকে বিয়ে দিয়ে ‘পার করে দেওয়ার’ সংস্কৃতির পরিবর্তন সম্ভব না। মেয়েকে পরিবারে সমান মানুষ হিসেবে যদি সুযোগ দেওয়া না হয়, তাহলে বাল্যবিয়ে তো হবেই।”
সমাজ ও রাষ্ট্রেও নারীদের প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সমান সুযোগ দিলে বাল্যবিয়ে বন্ধ হয়ে যেত বলে মন্তব্য করেন তিনি। এছাড়া বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনের বিশেষ বিধান তুলে দেওয়ার দাবিও তার।
“বিয়ে নিবন্ধন থেকে শুরু করে অভিভাবক, জনপ্রতিনিধি সবাইকে বাল্যবিয়ে বন্ধে কাজ করতে হবে। মেয়েদের সমান অধিকারের ব্যাপারে দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের জন্য পাঠ্যপুস্তকে বিভিন্ন বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। বাল্যবিয়ে কমাতে পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধের প্রচার ও প্রচারণা চালিয়ে যেতে হবে।
“স্থানীয় পর্যায়ের ক্লাবগুলোকে কাজ করতে হবে। ছেলেমেয়েদের কর্মদক্ষ ও উপার্জনক্ষম না করে বিয়ের চিন্তা করা যাবে না- সরকারের এ ধরণের প্রচার-প্রচারণা থাকতে হবে। এনজিও, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, গণমাধ্যম- সবাইকে একসাথে কাজ করতে হবে।”
ধর্মীয় অনুষ্ঠানে নারীকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করে বক্তব্য দেওয়া বন্ধেরও দাবি জানান রোকেয়া কবীর।
আইনের বিশেষ বিধানের কারণে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ গতি হারিয়েছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু।
“যারা বাল্যবিয়ে দিচ্ছে তাদের মধ্যে এখন আর কোনো ভয় কাজ করছে না। প্রশাসনও যে বাধা দিতে যাবে, তারাও ভাবে, কী দরকার ঝামেলা করে, আইনে তো আছেই বিশেষ পরিস্থিতির কথা। এই মহামারীতে তো বাল্যবিয়ে আরও বাড়ছে। জীবন-জীবিকা যেখানে ঝুঁকিতে, সেখানে মেয়েদের এক ধরনের বোঝা মনে করা হচ্ছে। যেহেতু এখন মেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে না, তাদের নিরাপত্তার অভাব রয়েছে- এই বিষয়গুলো চিন্তা করে মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার কথা চিন্তা করা হয়।”
এই আইনের ফলে ধর্ষকের সাথে বিয়ে দেওয়ার ঘটনাও ঘটছে জানিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে দ্রুত বাল্যবিয়ের বিশেষ বিধান তুলে নেয়া ও শাস্তির বিধান বাড়ানোর দাবি জানান তিনি।
মালেকা বানুর মতে, বাল্যবিয়ের সব খবর গণমাধ্যমে না আসায় আপাতদৃষ্টিতে তাদের পরিসংখ্যানে বাল্যবিয়ে কমে যাচ্ছে মনে হলেও আসলে তা কমছে না।
বাল্যবিয়ে বন্ধে সরকারকে মনিটরিং বাড়ানোর তাগিদ দিয়ে এই নারীনেত্রী বলেন, “বাল্য বিয়ে যে কত হচ্ছে, তার কোনো হিসাব নেই। কারণ ভুল জন্মনিবন্ধনপত্র দেওয়া হয় বাল্যবিয়ের সময়। আবার কাজী বা ভুয়া কাজীরাও বয়স বাড়িয়ে এ কাজগুলো করে।”
বাল্যবিয়ে ঠেকাতে সরকারকে মাঠপর্যায়ে তদারকি জোরদার, কাজীদের ও জনসাধারণের সচেতনতা বাড়ানোর উপর জোর দেন তিনি।
বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে মাঠপর্যায়ে সমন্বয়ের কাজ করা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের পরিবীক্ষণ, সমন্বয় ও সচেতনতা বিভাগের উপ-পরিচালক আবুল কাশেম বলেন, মহামারীতে বাল্যবিয়ে বেড়ে গেছে।
“লুকিয়ে লুকিয়ে অনেক সময় বাল্যবিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। আমরা খবর পেলে প্রতিরোধ করি।”
এ বিষয়ে ইউনিয়ন পর্যায়ে কাজী, পুরোহিত ও ইমামদের সাথে কাজ করার পরিকল্পনার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “বাল্যবিয়ে বন্ধে বেশ কিছু পরিকল্পনা আছে আমাদের। প্রতি স্কুলে আমরা একজন মেয়েকে অ্যাম্বাসেডর নির্বাচিত করব, যে বাল্যবিয়ে কমাতে ভূমিকা রাখবে। এছাড়াও স্কুলের অ্যাসেম্বলিতে যেহেতু সব শিক্ষার্থী উপস্থিত থাকে, তাই সেখানে বাল্যবিয়ের কুফল সম্পর্কে আমরা বার্তা দেব। আর প্রতিটি স্কুলেই কমপ্লেইন বক্সের ব্যবস্থা করব।”
তবে বাল্যবিয়ে আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে বলে দাবি মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি মেহের আফরোজ চুমকির।
“প্রতিদিন কোনো বাল্যবিয়ে হতে নিলেও আমরা খবর পেয়ে যাচ্ছি। গোপনে হয়ত দু-একটা হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আগের মত ঢালাওভাবে এখন আর হচ্ছে না। এখন তো আসলে সে অবস্থা নাই।
“বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে আমাদের কিশোরী, সরকারি কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধিরাও মাঠে নেমেছে। তার মধ্যে হয়ত দুই-একটা ঘটনা ঘটছে। একেবারে যে হচ্ছে না, তা বলছি না। কিন্তু আমাদের দেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে বাল্যবিয়ে আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে, সেটা আমি চ্যালেঞ্জ করেই বলতে পারি।”
“যে জরিপগুলো করা হচ্ছে, সেগুলোতে যাদের বিয়ে পাঁচ বছর আগে হয়েছে, তাদের নিয়ে করা হচ্ছে। সে কারণে সংখ্যাটা বেড়ে যাচ্ছে।”
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে বাল্যবিয়ের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি বলে ইউনিসেফের প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে মেহের আফরোজ বলেন, “যেসব দেশে বাল্যবিয়ে কমে গেছে, সেসব দেশে অনেক অসামাজিক বিষয়ও হচ্ছে। সেটা আমাদের দেশে সবচাইতে কম। আমাদের বাল্যবিয়ে বেশি ওরা বলতে পারে, কিন্তু সামাজিক সমস্যাগুলো অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম।”
আইনের বিশেষ বিধানের কারণে বাল্যবিয়ে বেড়ে যাচ্ছে কি না- এ প্রশ্ন করা হয় চুমকিকে, যিনি নতুন আইন প্রণয়নের সময় মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন।
উত্তরে তিনি বলেন, “আইন দিয়ে বাল্যবিয়ে বন্ধ করা যাবে না। সামাজিক পরিবর্তন ও মানসিকতার পরিবর্তনটাই সবচাইতে জরুরি।
“একটা দরিদ্র পরিবারের একজন বাবা বাল্যবিয়ে দিয়ে দিল, তাকে জরিমানা করলেন; কিন্তু সে তো তা দিতে পারবে না। সে জেলে গেলেও তার পরিবারকে আপনি কীভাবে সামাল দিবেন? সেজন্য সামাজিক মানসিকতার পরিবর্তন না করে আইন করে সমাধান সম্ভব না।”
আরও খবর-