খুনির পরনে ছিল পুরোদস্তুর কালো পোশাক, মুখে ছিল কালো মাস্ক। ফাহিম সালেহর পিছু নিয়েই সে লিফটে চড়ে ম্যানহটনের বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকেছিল।
Published : 17 Jul 2020, 12:58 AM
তদন্তকারীদের ধারণা, ফাহিম সালেহকে সে অচল করে দিয়েছিল বৈদ্যুতিক স্টান গান ব্যবহার করে। এরপর হত্যা করে বৈদ্যুতিক করাত চালিয়ে সে টুকরো টুকরো করে ফাহিমের দেহ।
নিউ ইয়র্ক সিটির ম্যানহটনে বিত্তবানদের আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত লোয়্যার ইস্ট সাইডের ওই কন্ডোমোনিয়ামে যেভাবে এই বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত তরুণ উদ্যোক্তাকে খুন করা হয়েছে, তা পেশাদার খুনির কাজ বলেই গোয়েন্দাদের ধারণা।
বাংলাদেশের পাঠাওয়ের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ফাহিম ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে নাইজেরিয়ায় লাগোসে যৌথ উদ্যোগে অ্যাপভিত্তিক মোটরবাইক রাইড সার্ভিস ‘গোকাডা’ চালু করেন। গতবছর সাড়ে ২২ লাখ ডলারে তিনি ইস্ট হিউস্টন স্ট্রিটের ওই বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট কেনেন।
যুক্তরাষ্ট্রে স্থানীয় সময় মঙ্গলবার বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে ওই অ্যাপার্টমেন্টের ভেতরে গার্বেজ ব্যাগ থেকে ৩৩ বছর বয়সী এই তরুণের খণ্ড-বিখণ্ড লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
এরপর দুই দিন পেরিয়ে গেলেও হত্যার ‘মোটিভ’ উদঘাটন করা সম্ভব হয়নি। তবে ব্যবসায়িক বিরোধের জেরে হত্যার সম্ভাবনার বিষয়টিও তদন্তকারীরা মাথায় রাখছেন বলে খবর আসছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোতে।
নিউ ইয়র্ক পুলিশের তদন্তকারীরা ওই অ্যাপার্টমেন্ট ভবনে তল্লাশি চালিয়ে আলামত সংগ্রহ করেছে। আশপাশের রাস্তা ও ভবনে যত সিসি ক্যামেরা আছে, সেগুলোর ভিডিও সংগ্রহ করা হয়েছে বলে এনওয়াইপিডির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
বৃহস্পতিবার নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, কলেজ জীবনে মজার ছলে প্র্যাঙ্কডায়াল নামের একটি অ্যাপ বানিয়েছিলেন ফাহিম, যার মাধ্যমে আগে থেকে রেকর্ড করে রাখা কথপোকথন কিনে নিয়ে বন্ধুদের কাছে পাঠানো যায়। সেই অ্যাপ থেকে মোটা অংকে লাভের মুখ দেখেন ফাহিম। তবে সেজন্য তাকে শখানেক পরোয়ানার মুখোমুখিও হতে হয়েছে।
মৃত্যুর সময়ও ফাহিমের বিরুদ্ধে নিউ জার্সির এক কারাকর্মীর করা মামলা চলমান ছিল। অবৈধভাবে ‘প্র্যাঙ্কডায়াল’ ব্যবহার করার কারণে ১৫ মাসের সাজা হয়েছিল ক্রিক ইডি নামের ওই ব্যক্তির।
হাডসন কাউন্টি কারেকশন ফ্যাসিলিটির সাবেক উপ পরিচালক ক্রিক ইডি ওই অ্যাপ ব্যবহার করে গোপনে তার সহকর্মীদের কথা রেকর্ড করতেন এবং শুনতেন।
ফাহিমের বিরুদ্ধে ২০১৭ সালে করা মামলায় ক্রিক ইডি প্রতারণার অভিযোগ আনেন। তার ভাষ্য, ওই অ্যাপ ব্যবহারের সময় তিনি ভেবেছিলেন, তিনি যা করছেন, তা বৈধ।
ফাহিম যখন গোকাডা চালু করেন, তার অনেক আগে থেকেই নাইজেরিয়াতে ভাড়ায় মোটরসাইকেল সেবা চলাচলের একটি জনপ্রিয় মাধ্যম ছিল। সেখানে গত বছর জুনে গোকাডা ভেঞ্চার ক্যাপিটাল হিসাবে ৫৩ লাখ ডলার তুলতে সক্ষম হয় বলে টেকক্রাঞ্চ ওয়েবসাইটের বরাতে জানিয়েছে নিউ ইয়র্ক টাইমস।
তবে লাগোসের অনেক বাণিজ্যিক ও আবাসিক এলাকায় মোটরসাইকেল চলাচলে নিষেধাজ্ঞা ঘোষণার পর গত ফেব্রুয়ারিতে বড় ধাক্কা খায় ফাহিমের গোকাডা।
তার এক বন্ধু নিউ ইয়র্ক টাইমসকে বলেন, ওই ঘটনার পর কর্মী ছাঁটাই করতে হয়েছিল ফাহিমকে। তবে ফাহিম ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় ছিলেন। নাইজেরিয়ার অর্থনৈতিক সম্ভাবনা নিয়ে আশাবাদী ফাহিম মনে করতেন, তার কোম্পানি অনেক তরুণ নাইজেরীয়র জন্য কাজের সুযোগ তৈরি করতে পারে।
এ বছর ফেব্রুয়ারিতেই গোকাডা খাবার ও পণ্য ডেলিভারির সেবা চালু করে। মহামারীর মধ্যে এপ্রিলে এক টুইটে ফাহিম জানান, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ভালোভাবেই সামলে নিতে পেরেছে তার প্রতিষ্ঠান।
নিউ ইয়র্ক টাইমন লিখেছে, ফাহিমকে হত্যার পেছনে ব্যবসায়িক বিরোধের কোনো বিষয় কাজ করছে কি না তাও খতিয়ে দেখছেন তদন্তকারীরা।
ফাহিম বিনোদনমূলক অ্যাপারেটাস কোম্পানি ‘কিকব্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ও অ্যাডভেঞ্চার ক্যাপিটলেরও সহপ্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তিনি ক্যালিফোর্নিয়ার সিলিকন ভ্যালিতে একটি নতুন কোম্পানি চালু করেছেন বলে তার এক নিকটাত্মীয় জানালেও সে ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য জানা যায়নি।
খুন হওয়া ফাহিমের অভিভাবকেরা বলছেন, ঘাতক কীভাবে ভবন থেকে পালালো তা জানতে হবে।
আর তদন্ত কর্মকর্তাদের ধারণা, ফাহিমকে হত্যার পর টুকরো টুকরো লাশ সুটকেসে ভরে কোথাও সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা ছিল খুনির, যাতে তার নিখোঁজ রহস্য উদঘাটনে অনেক সময় পেড়িয়ে যায়।
তবে তার কাজ শেষ হওয়ার আগেই হয়ত ওই অ্যাপার্টমেন্টে যাওয়ার জন্য কেউ নিচ থেকে কলিং বেল টিপেছিলেন; সে শব্দেই ঘাতক সবকিছু ফেলে ভবনের পেছনের দরজা ও সিঁড়ি ব্যবহার করে পালিয়ে যায়।
পুরো একদিন ফাহিমের সাড়া না পেয়ে মঙ্গলবার ওই অ্যাপার্টমেন্টে গিয়েছিলেন তার বোন। তিনিই প্রথম ব্যাগে ভরা ফাহিমের খণ্ডিত দেহ দেখতে পান এবং পুলিশে খবর দেন।