ঝড় প্রস্তুতি: ব্রিটিশ আমলের সংকেত ব্যবস্থা বদলে আগ্রহ নেই

ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় মানুষকে সতর্ক করতে সারা পৃথিবীতে সংকেত ব্যবস্থার আধুনিকায়ন হলেও দুর্যোগপ্রবণ বাংলাদেশ এখনও ব্রিটিশ আমলের সেই বন্দরভিত্তিক সংকেত ব্যবস্থাই আঁকড়ে ধরে আছে।

মঈনুল হক চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 May 2020, 03:39 PM
Updated : 18 May 2020, 04:05 PM

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঘূর্ণিঝড়ের সংকেত ব্যবস্থা পুনর্বিন্যস্ত করতে দুই দশক ধরে কাজ চললেও বাস্তব কোনো অগ্রগতি হয়নি। এতদিন ধরে চলে আসা নিয়ম মানুষের কাছে ‘গ্রহণযোগ্য ও সহজবোধ্য’ হয়ে গেছে- এই যুক্তিতে পুরনো নিয়মেই কাজ চালিয়ে যাচ্ছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. মোহসীন বলেন, “ঘূর্ণিঝড়ের জন্য এখন যে ১০টি সতর্ক সংকেত ব্যবস্থা আমাদের আছে, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে মিল রেখেই তা ব্যবহার করা হচ্ছে। এখন আমরা সহজভাবেই মানুষের কাছে উপস্থাপন করতে পারছি, প্রস্তুতিও সেভাবে নিচ্ছি। এই সংকেতগুলো দিয়ে কী বোঝানো হচ্ছে মানুষের কাছে তা স্পষ্ট।“

ব্রিটিশ শাসনামলে তৈরি এই সংকেত ব্যবস্থা আন্তর্জাতিক আধুনিক সংকেত ব্যবস্থা থেকে আলাদা। ঝড়ের গতি ও বিপদের সম্ভাব্য মাত্রা বিবেচনায় ১ থেকে ১১ নম্বর সংকেত দিয়ে এখানে সতর্কতার মাত্রা বোঝানো হয়।

সনাতনী এ সংকেত ব্যবস্থা মূলত তৈরি করা হয়েছিল সমুদ্রগামী জাহাজ ও বন্দরের নিরাপত্তার জন্য। জনসাধারণের জন্য সতর্কবার্তার বিষয়টি সেখানে খুব একটা গুরুত্ব পায়নি তখন।

কোন সংকেতের কী মানে

সমুদ্রবন্দরে ঝড়ের সতর্ক বার্তা হিসেবে ১ নম্বর দূরবর্তী সতর্ক সংকেত, ২ নম্বর দূরবর্তী হুঁশিয়ারি সংকেত, ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত, ৪ নম্বর হুঁশিয়ারি সংকেতের পর ৫, ৬ ও ৭ নম্বর বিপদ সংকেত; ৮, ৯ ও ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখানো হয়। সর্বশেষ ১১ নম্বর দিয়ে বোঝানো হয়- যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন।

পাশাপশি অভ্যন্তরীণ নদীবন্দরের জন্য রয়েছে ১ নম্বর নৌ সতর্ক সংকেত, ২ নম্বর নৌ হুঁশিয়ারি সংকেত, ৩ নম্বর নৌ বিপদ সংকেত ও ৪ নম্বর নৌ মহাবিপদ সংকেত।

সমুদ্রবন্দরের জন্য সংকেতগুলোর মধ্যে ৫, ৬ ও ৭ নম্বর বিপদ সংকেতের মাত্রা একই। আবার ৮, ৯ ও ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেতেরও মাত্রা এক। ঝড় কোন দিক দিয়ে যাবে তার ভিত্তিতে নম্বর আলাদা করা হয়, যদিও বিপদ সব ক্ষেত্রেই সমান।

এর ফলে সাধারণের মধ্যে অনেক সময় বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। সাধারণ মানুষ মনে করে, সংকেত যত বেশি, বিপদ তত বড়। ফলে দ্রুততম সময়ে বিপদ সম্পর্কে সচেতন করার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয় বলে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন।

ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতিতে এই পুরনো ব্যবস্থা বহু বছর আগে বাদ দিয়েছে খোদ যুক্তরাজ্যও। এখন অধিকাংশ দেশে ঝড়ের শক্তি ও দূরত্ব বিবেচনায় চার বা পাঁচ ধাপের রঙভিত্তিক সংকেত ব্যবস্থা চালু আছে। ভারতও চার ধাপের রঙভিত্তিক সংকেত ব্যবস্থা ব্যবহার করে আসছে।  

তবে মো. মোহসীন বলছেন, স্বেচ্ছাসেবকদের মাধ্যমে এসব সংকেত যেভাবে প্রচার করা হয়, তাতে প্রস্তুতিতে কোনো ঘাটতি থাকে না। 

“৪ নম্বর সংকেত দিলেই আমাদেরও প্রস্তুতি নেওয়া শুরু হয়। বিপদ ও মহাবিপদ সংকেত দেওয়ার ক্ষেত্রে এলাকাগুলোও উল্লেখ করে দেওয়া হয়। এখন বেশ সহজভাবে সিগন্যালটা বোঝানো যাচ্ছে। তবে মানুষকে আরো সচেতন করতে কাজ করে যেত হবে।”

মোহসীনের আগে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করা মো. শাহাদাৎ হোসেনের যুক্তিও প্রায় একই রকম।

“বিদ্যমান সংকেতগুলোতে মানুষ বেশ অভ্যস্ত এবং দ্রুত সাড়াও দেয়। এক দশক-দুই দশক আগেও মানুষের এতো সচেতনতা ছিল না। এখন জানমালের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে সচেতনতা বড় ভূমিকা রাখছে। সেই সঙ্গে সরকারের কার্যকর প্রস্তুতির কারণেও বড় ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব হচ্ছে।”

সংস্কারের উদ্যোগ বিফলে

বর্তমান সংকেত ব্যবস্থা সংস্কারের জন্য গত তিন দশকে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে বেশ কয়েকবার উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি।

১৯৯২-৯৩ সালে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণে মাস্টার প্ল্যান তৈরির সময় সমুদ্রবন্দর ও নৌবন্দরের জন্যে একীভূত সতর্কীকরণ সংকেত প্রণয়নের সুপারিশ করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়

এছাড়া, সংকেত ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ করে জনমুখী ও সহজীকরণের জন্য ২০০৬ সালে আবহাওয়া অধিদপ্তর, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ব্যুরো, পানি উন্নয়ন বোর্ড, স্পার্সো ও ঝড় সতর্কীকরণ কেন্দ্রের প্রধানদের নিয়ে একটি কমিটি করে সরকার। ওই কমিটি একটি প্রতিবেদন দিলেও পরে সুপারিশ বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় সিডরের আঘাতের পর ফখরুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ওই প্রতিবেদন নতুন করে পর্যালোচনার জন্য অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী নেতৃত্বে গঠিত আরেকটি কমিটিকে নির্দেশ দেয়।

ওই কমিটি পরের বছর জানুয়ারিতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ে যে প্রতিবেদন দেয়, তাতে বন্দরের পাশাপাশি জনসাধারণের জন্য সতর্কবার্তাকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়।

এছাড়া, সমুদ্রবন্দরের জন্য প্রচলিত ১০টি সংকেতের মধ্যে ১ নম্বর দূরবর্তী সতর্ক সংকেত ও ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত বহাল রেখে অন্য সংকেত কমাতে বলা হয়। গুরুত্ব কম বলে ৩, ৫, ৬, ৭, ৯ নম্বর সংকেত সমন্বয় করে সেখানে মাত্র একটি সংকেত রাখার প্রস্তাব দেওয়া হয় ওই প্রতিবেদনে।

২০০৯ সালে তৎকালীন খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় নৌ ও সমুদ্র বন্দরের জন্য ব্যবহৃত প্রচলিত মোট ১৫টি সংকেত পুনর্বিন্যাস করে আটটিতে নামিয়ে আনে। পরের বছর ১ এপ্রিল থেকে নতুন সঙ্কেত ব্যবস্থা চালুরও প্রস্তাব করা হয়।

তখনকার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেছিলেন, প্রচলিত সতর্ক সঙ্কেতগুলো শুধু নৌ ও সমুদ্রবন্দরের জন্য। কিন্তু নতুন ব্যবস্থায় এসব সঙ্কেত জনকল্যাণে ব্যবহার উপযোগী করা হয়েছে। কিন্তু সরকারের সেই সিদ্ধান্তও বাস্তবায়িত হয়নি।

পুরনোতেই আস্থা অধিদপ্তরের

আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক সামছুদ্দিন আহমেদ বলছেন, সংকেত পুনর্বিন্যাসের যে উদ্যোগ ছিল তার ফলাফল শূন্য। তবে বিদ্যমান ব্যবস্থায় কাজ চালাতেই তারা স্বস্তি বোধ করছেন।

“জাহাজের কথা বিবেচনায় রেখে সমুদ্র বন্দরের জন্য সংকেতগুলোর প্রবর্তন হলেও ইদানিং মানুষের কাছেই সেগুলো সহজবোধ্য হয়ে গেছে। সুফলও আসছে।  

“একটা সময় আমরা টেলিফোনে সতর্ক বার্তা জানিয়ে দিতাম, টেলিপ্রিন্টারের মাধ্যমে তথ্য পাঠাতাম। এখন ডিজিটাল বাংলাদেশে সে ব্যবস্থা নেই। দ্রুততম সময়ে সবার কাছে সতর্ক বার্তা, সতর্ক সংকেত পৌঁছে যাচ্ছে ইন্টারনেটের বদৌলতে।”

তিনি বলেন, আবহাওয়ার হালনাগাদ তথ্য জানাতে ব্যবহার করা হচ্ছে অ্যাপ, দ্রুত বুলেটিন দেওয়া হচ্ছে; ফেইসবুকেও তথ্য দেওয়া হচ্ছে, ১০৯০ নম্বরে ফোন করে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, সুনির্দিষ্ট করে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার নামসহ সংকেত দেওয়া হচ্ছে।

“সব থেকে বড় কথা, যাদের জন্য এ বার্তা, সেই উপকূলের মানুষ সংকেত মেনে নির্ধারিত সময়ে নিরাপদ স্থানে যাচ্ছে, সমুদ্র থেকে ফিরে আসছে বা ঝড়ো আবহাওয়ার বার্তা পেয়ে সমুদ্রে যাওয়া থেকে বিরত থাকছে। ৬৫ হাজার স্বেচ্ছ্বাসেবীর মাধ্যমে উপকূলের ঘরে ঘরে পৌঁছে যাচ্ছে সংকেত বার্তা।”

সামছুদ্দিন আহমেদ বলেন, “সংকেত পরিবর্তনের চেয়ে এখন প্রযুক্তির উন্নত ব্যবহার বেশি জরুরি। বিশেষ করে জিআইএস পদ্ধতি ব্যবহার, ফসলের ক্ষতির তথ্য সংগ্রহ, প্লাবিত এলাকা-দ্রুত চিহ্নিত করার ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।”

আরও খবর