আসামি না হয়েও পাটকলকর্মী জাহালমের কারাভোগের ঘটনায় ১১ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করার কথা হাই কোর্টকে জানিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন।
Published : 21 Aug 2019, 07:07 PM
তবে দায়ীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের নেওয়া ব্যবস্থা সংক্রান্ত প্রতিবেদনকে ‘অস্পষ্ট’ হিসেবে চিহ্নিত করে তা গ্রহণ করেনি হাই কোর্ট।
ওই ১১ কর্মকর্তাকে কেন দায়ী করা হয়েছে, কেন তাদের কারণ দর্শানোর নোটিস দেওয়া হয়েছে, তারা কী জবাব দিয়েছে, তাদের নাম-পদবি কী- সেসব বিষয় বিস্তারিত তুলে ধরে আগামী বুধবার আবারও প্রতিবেদন দিতে দুদকের আইনজীবীকে নির্দেশ দিয়েছে আদালত।
দুদকের দাখিল করা প্রতিবেদন দেখে বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের হাই কোর্ট বেঞ্চ বুধবার এ আদেশ দেয়।
আদালতে দুদকের প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন আইনজীবী খুরশীদ আলম খান। ব্র্যাক ব্যাংকের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মো. আসাদুজ্জামান আর সোনালী ব্যাংকের পক্ষে শেখ মো. জাকির হোসেন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আবদুল্লাহ আল মাহমুদ বাশার।
খুরশীদ আলম খান আদালতে প্রতিবেদন উপস্থাপন করে বলেন, হাই কোর্টের আদেশে চাকরি বিধিমালা অনুযায়ী ১১ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় কমিশন। সে অনুযায়ী তাদের কারণ দর্শানোর নোটিস দেওয়া হয়। কিন্তু তাদের জবাব সন্তোষজনক না হওয়ায় প্রত্যেকের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা হয়।
দুদকের আইনজীবী আদালতকে বলেন, সোনালী ব্যাংক মিরপুর ক্যান্টনমেন্ট শাখার অর্থ আত্মসতের অভিযোগে যে ৩৩ মামলায় জাহালমকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছিল, তার মধ্যে ৬টিতে অধিকতর তদন্ত চলছে। বাকি ২৭টি মামলায় অধিকতর তদন্তের জন্য তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে।
বেঞ্চের কনিষ্ঠ বিচারক কে এম কামরুল কাদের তখন বলেন, “পুনঃতদন্ত আপনাদের নিজস্ব ব্যপার। আমরা জানতে জানতে চেয়েছিলাম এ ঘটনার জন্য যারা দায়ী তাদের বিরুদ্ধে কী ববস্থা নেওয়া হয়েছে। যাই হোক এসব তদন্ত শেষ হতে কতদিন লাগবে?”
দুদক আইনজীবী বলেন, “যত তাড়াতিাড়ি সম্ভব।”
তখন জ্যেষ্ঠ বিচারক এফ আর এম নাজমুল আহাসান বলেন, “তাড়াতাড়ি করেন। আমাদের রুলের দুইটা টার্ম। একটা টার্ম হল জাহালমের মুক্তির বিষয়ে, সেটা তো হয়ে গেছে। আরেকটা টার্ম ছিল ক্ষতিপূরণের বিষয়ে। আমরা দেখতে চাই কারা দায়ী, ক্ষতিপূরণ দেওয়ার থাকলে বিষয়টি আমরা বিবেচনা করব।”
বিচারপতি কামরুল কাদের এ পর্যায়ে বলেন, “আমরা সাধুবাদ জানাই যে দুদক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। কিন্তু যেসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে তাদের তালিকা কোথায়? কেন তাদের শোকজ করা হয়েছে, তারা কী জবাব দিয়েছে এবং তাদের অবহেলা আছে কি না, তা আমরা দেখতে চাই। তালিকাগুলো দেননি কেন?”
খুরশিদ আলম খান বলেন, “নামগুলো দুদক আমাকে দেয়নি, তাই প্রতিবেদনে নামগুলো উপস্থাপন করতে পারছি না।”
বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান তখন বলেন, “শর্ষের মধ্যে ভূত থাকার দরকার কি? শর্ষেকে শর্ষের মত থাকতে দেন। গুড় খাওয়া না ছেড়ে আপনি গুড় খাওয়া ছাড়ার কথা বলতে পারেন না। আপনারা যদি ব্যবস্থা নেন, তাহলে আপনাদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে।”
দুদক আইনজীবী তখন বলেন, “শুধু আমাদের না, দেশের ভাবমূর্তিই উজ্জ্বল হবে।”
বিচারপতি কামরুল কাদের বলেন, “আপনারা প্রতিবেদনটা যথাযথভাবে দেননি। যাদের নাম দেওয়র কথা তাদের নাম দেননি। এটা অস্পষ্ট রিপোর্ট দিয়েছেন আপনি। আমরা এই রিপোর্ট গ্রহণ করতে পারছি না।”
দুদকের আইনজীবী এরপর আদেশ চাইলে বিচারক বলেন, “নতুন করে অদেশ দিতে হবে কেন? আগের আদেশই তো রয়ে গেছে। নতুন করে আদেশ দিলে তো আগের আদেশ যথাযথভাবে প্রতিপালন না করায় তাদের ডেকে আনতে হবে।”
এরপর আদালত আগামী বুধবার প্রতিবেদন দাখিলের আদেশ দেয়।
আদেশের পর আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, “আদালতের এ নির্দেশনা মোতাবেক একটি প্রতিবেদন দিয়েছি। আদালতকে দেখিয়েছি ১১ জন তদন্ত কর্মকর্তাকে শোকজ করা হয়েছে। তারা এর জবাব দিয়েছে। কিন্তু দুদক জবাবে সন্তুষ্ট না হয়ে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা রুজু করেছে। আর এই ঋণ জালিয়াতির ৩৩টা মামলার পুনরায় তদন্তের সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে।”
জালিয়াতির মাধ্যমে সোনালী ব্যাংকের প্রায় ১৮ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ২০১২ সালে আবু সালেক নামে এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে ৩৩টি মামলা করে দুদক। এরপর সালেককে তলব করে দুদক চিঠি দিলে সেই চিঠি পৌঁছায় জাহালমের টাঙ্গাইলের বাড়ির ঠিকানায়।
নরসিংদীর ঘোড়াশালের বাংলাদেশ জুট মিলের শ্রমিক জাহালম তখন দুদকে গিয়ে বলেছিলেন, তিনি আবু সালেক নন, সোনালী ব্যাংকে তার কোনো অ্যাকাউন্টও নেই। ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট খোলার জন্য আবু সালেকের যে ছবি ব্যবহার করা হয়েছে, সেটাও তার নয়।
কিন্তু দুদকে উপস্থিত বিভিন্ন ব্যাংকের কর্মকর্তারা সেদিন জাহালমকেই ‘আবু সালেক’ হিসেবে শনাক্ত করেন। পরে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঘোড়াশাল থেকে জাহালমকে গ্রেপ্তার করে দুদক।
পরে বিচারিক আদালতেও জাহালম দুদকের পরিচয় বিভ্রাটের বিষয়টি তুলে ধরে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন। কিন্তু কেউ তার কথা কানে তোলেনি।
তিন বছর ধরে জাহালমের কারাভোগের খবর গণমাধ্যমে এলে হাই কোর্ট ২৮ জানুয়ারি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে একটি রুল জারি করে।
কারাগারে থাকা ‘ভুল’ আসামি জাহালমকে কেন অব্যাহতি দেওয়া হবে না, তাকে মুক্তি দিতে কেন ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হবে না এবং তাকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না- তা জানতে চাওয়া হয় ওই রুলে।
উচ্চ আদালতের হস্তক্ষেপে গত ৪ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পান জাহালম। গত ১১ জুলাই আদালতে দাখিল করা আভ্যন্তরীণ তদন্ত প্রতিবেদনে দুদক জানায়, তদন্ত কর্মকর্তাদের ভুলের কারণে আসামি না হয়েও জাহালমকে কারাভোগ করতে হয়েছে।
সেখানে বলা হয়, ‘জাহালমকে আবু সালেকরূপে চিহ্নিত করার যে ভুলটি হয়েছে, তা দুদকের তদন্তকারী কর্মকর্তাদের কারণেই ঘটেছে।”
দুদকের ওই ৩৩ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন সেলিনা আখতার, মাসুদুর রহমান, সিলভিয়া ফেরদৌস, মেফতাহুল জান্নাত, দেবব্রত মণ্ডল, মুহাম্মদ জয়নাল আবেদীন, শেখ মেসবাহ উদ্দিন, সাইদুজ্জামান, রাফী মো. নাজমুস সাদাত ও রফিকুল ইসলাম। এসব মামলার বাদী এবং তদন্তের তদারক কর্মকর্তা ছিলেন আব্দুল্লাহ আল জাহিদ।
সেই প্রতিবেদন নিয়ে আদালত সন্তোষ প্রকাশ করলেও যাদের দোষে জাহালমকে কারাভোগ করতে হল, তাদের বিরুদ্ধে দুদক কী পদক্ষেপ নিয়েছে তা ২৮ জুলাইয়ের মধ্যে জানাতে বলা হয়।
এর ধারাবাহিকতায় দুদক বুধবার প্রতিবেদন দিলেও তাকে অস্পষ্ট হিসেবে বর্ণনা করে নতুন করে প্রতিবেদন দিতে বলল হাই কোর্ট।