থানা থেকে ভুক্তভোগীকে সর্বোচ্চ আইনি সহায়তার নির্দেশ দেওয়ার কথা জানিয়ে ঢাকার পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া দাবি করেছেন, থানা পুলিশের দৃষ্টিভঙ্গির অনেক পরিবর্তন হয়েছে।
Published : 07 May 2019, 09:15 PM
মঙ্গলবার উত্তরা ৬ নম্বর সেক্টরে উত্তরা কমিউনিটি সেন্টারে আয়োজিত আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে এই দাবি করেন ডিএমপি কমিশনার।
থানা পুলিশের কাছে গিয়ে প্রতিকার না পাওয়ার বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি বিষয়টি আরও সামনে চলে এসেছে ফেনীর মাদ্রাসা ছাত্রী নুরসাত জাহান রাফীকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় সোনাগাজী থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের কর্মকাণ্ড নিয়ে।
মাদ্রাসার অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের মামলা তুলে না নেওয়ায় গত ৬ এপ্রিল মাদ্রাসার ছাদে ডেকে নিয়ে নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। চার দিন পর ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে মেয়েটির মৃত্যু হয়।
এ ঘটনায় মামলা দায়েরের পর ওসি মোয়াজ্জেম আসামিদের ধরতে গড়িমসি করেন বলে অভিযোগ ওঠে। পরে ওই মামলার তদন্ত পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন-পিবিআইকে দেওয়ার পর আসামিরা গ্রেপ্তার হন এবং হত্যা রহস্য বেরিয়ে আসে।
এ ঘটনায় ওসি মোয়াজ্জেম ও ফেনীর পুলিশ সুপারের দায়িত্বে ‘গাফিলতির’ প্রমাণ পেয়েছে পুলিশেরই তদন্ত দল।
তবে ডিএমপির উত্তরা বিভাগ আয়োজিত মতবিনিময় সভায় ডিএমপি কমিশনার বলেন, “আমাদের থানা পুলিশের দৃষ্টিভঙ্গি অনেক পরিবর্তন হয়েছে। থানা থেকে ভুক্তভোগীকে সর্বোচ্চ আইনি সাহায্য করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
“থানায় এসে যাতে কেউ হয়রানি না হয় সেদিকে সংশ্লিষ্ট পুলিশ অফিসারকে সজাগ দৃষ্টি রাখার জন্য নির্দেশনা দেওয়া আছে।”
জনগণের সহযোগিতা ও উদ্দীপনায় এখন বাংলাদেশে নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ‘অনেক ভালো’ বলে মন্তব্য করেন আছাদুজ্জামান মিয়া।
তিনি বলেন, “আপনাদের সহযোগিতার কারণে ঢাকা শহরে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, ভূমি দখল, চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজির মতো অপরাধ নেই বললেই চলে। তবে একেবারেই ক্রাইম ফ্রি সমাজ চিন্তা করা যায় না।”
কেউ অপরাধ করলে দ্রুত সময়ের মধ্যে শনাক্ত করে তাকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে দাবি করে ডিএমপি কমিশনার বলেন, “টেকসই উন্নয়নের জন্য চাই টেকসই নিরাপত্তা। কয়েক বছর আগেও সবখানে সিসি ক্যামেরা থাকবে কল্পনা করা যেত না, আর এখন নিরাপত্তার স্বার্থে সরকারি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রায় প্রতিটি জায়গায় বসানো হয়েছে সিসি ক্যামেরা।
“যার ফলে অপরাধীকে স্বল্প সময়ে শনাক্ত করে গ্রেপ্তার করা সহজ হচ্ছে।”
আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, “আমরা মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা ধারণ করে দায়িত্ব পালন করি। মানুষের নিরাপত্তায় বাংলাদেশ পুলিশের অনেক বড় ত্যাগ রয়েছে। আমরা দেশের বিভিন্ন স্থানে আত্মত্যাগের মাধ্যমে অনেক সন্ত্রাসী হামলা থেকে দেশবাসীকে রক্ষা করেছি। যেমন হলি আর্টিজান ও শোলাকিয়া ঈদের জামাতে হামলার ঘটনা।”
তিনি বলেন, “জ্বালাও-পোড়াও রাজনীতি থেকে শুরু করে হলি আর্টিজান হামলা ছিল দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের অংশ। আমরা সকল ষড়যন্ত্র জীবনবাজি রেখে প্রতিহত করেছি। জঙ্গি দমনে বাংলাদেশের সাফল্য বিশ্বে অনুকরণীয়। আমাদের গোয়েন্দাদের কঠোর নজরদারির কারণে হলি আর্টিজানের পর বাংলাদেশে কোনো সন্ত্রাসী হামলা হয়নি।
“আমাদের গোয়েন্দারা ও কাউন্টার টেররিজম বিভাগ জঙ্গিদের নেটওয়ার্ক বিধ্বস্ত করে দিয়েছে।”
নিজেদের কর্মকাণ্ড তুলে ধরে ডিএমপি কমিশনার বলেন, “সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও মাদকের বিরুদ্ধে আপনাদের সচেতন করতে আমরা হাজার হাজার উঠান বৈঠক করেছি, সিটিজেন ইনফরমেশন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের মাধ্যমে ইতোমধ্যে ঢাকা শহরের প্রায় ৬৫ লক্ষ নাগরিকের তথ্যের সমন্বয়ে তথ্য ভাণ্ডার তৈরি করা হয়েছে। যার ফলে অপরাধের হার কমেছে এবং কোন ঘটনা ঘটলে দ্রুত শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে।”
মাদকের বিরুদ্ধে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “বর্তমানে আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ মাদক। আমরা চাই না ঐশীর মতো আর কোন ঐশী আমাদের সমাজে তৈরি হোক। মাদক সম্পর্কিত তথ্য পুলিশকে দিন।
“তথ্য দাতার নাম কোনো অবস্থায় প্রকাশ করা হবে না। তথ্য দাতার নাম প্রকাশ করা মাদক ব্যবসায়ীকে সহযোগিতা করার অংশ।”
পুলিশের কোনো সদস্য মাদক সেবন ও বেচাকেনায় সম্পৃক্ত থাকলে তাকে কঠোর শাস্তির আওতায় আনা হবে বলে হুঁশিয়ার করেন ডিএমপি কমিশনার।
তিনি বলেন, “সন্তান মাদকাসক্ত বা জঙ্গিবাদে জড়িয়েছে কি না তা প্রথমত বাবা-মার দেখার দরকার, এরপর নজরদারিতে রাখার দরকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের। এমন কিছু দেখলে পুলিশকে জানান। আমরা কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে তাকে সুপথে আনার চেষ্টা করব।”
সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের সহযোগিতা ছাড়া শুধু আইন প্রয়োগ করে মাদক ও সন্ত্রাস দমন করা যাবে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, “আপনারা পুলিশকে পজিটিভলি দেখেন। রমজানে রোজাদার নগরবাসীকে ইফতারের আগে নিজ গন্তব্যে পৌঁছে দিতে প্রতিদিন দুই হাজার ট্রাফিক পুলিশ শুধু খেজুর ও পানি খেয়ে ইফতার করে।
“আমরা রমজান ও ঈদে বাস-টার্মিনাল, শপিং মলে নিরাপত্তা দেব, যাতে নিরাপদে নগরবাসী ঈদের কেনাকাটা করতে পারে।”
আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক মতবিনিময় সভায় আগত বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ নিজ নিজ এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আরও ভালো রাখতে ডিএমপি কমিশনারে কাছে কিছু পরামর্শ ও দাবি তুলে ধরেন। সেগুলো বাস্তবায়নের আশ্বাস দিয়ে সংশ্লিষ্ট থানা ও পুলিশ কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন তিনি।
সভায় অন্যদের মধ্যে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (সিটিটিসি) মো. মনিরুল ইসলাম, অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) মীর রেজাউল আলম, স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান, রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিনিধি, সেক্টর কল্যাণ সমিতির প্রতিনিধিসহ ডিএমপির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।