পানি যেন কল ছেড়েই খাওয়া যায়, দাবি ‘গণশুনানিতে’

টেবিলের ওপর পাশাপাশি সাজানো ২২টি প্লাস্টিকের বোতল; একেক বোতলের পানির রঙ একেক রকম। কোনোটা হলদে, কোনোটা ঘোলা, কোনোটা আবার কালচে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 May 2019, 12:04 PM
Updated : 7 May 2019, 12:51 PM

রঙ যাই হোক, সবগুলো বোতলের পানিই এসেছে ওয়াসার সরবরাহ লাইন থেকে। জুরাইন, দনিয়া, শ্যামপুরসহ ঢাকার ২২টি পয়েন্ট থেকে এই পানি সংগ্রহ করেছেন ‘ওয়াসার নিরাপদ পানি আন্দোলন’- এর কর্মীরা।

এ সংগঠনের আয়োজনে মঙ্গলবার রাজধানীতে এক ‘গণশুনানিতে’ ভুক্তভোগীরা জানালেন ওয়াসার পানি নিয়ে জানালেন তাদের অভিজ্ঞতা আর দুর্দশার কথা। বললেন, বোতল কিনে তারা আর পানি খেতে চান না।

আন্দোলনের সমন্বয়ক মিজানুর রহমান গণশুনানিতে বলেন, “বাসায় বসে ট্যাপ ছেড়ে পানি পান করতে চাই, যেসব এলাকায় বিষাক্ত, নোংরা, ময়লা পানি আসছে, সেখানে অতি দ্রুত নিরাপদ পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে।”

জাতীয় প্রেসক্লাবের আব্দুস সালাম হলে এ অনুষ্ঠানের শিরোনাম ছিল ‘নিরাপদ পানি: ওয়াসার দাবি ও জনগণের অভিজ্ঞতা'।

এই গণশুনানিতে ওয়াসার নিরাপদ পানি আন্দোলনের দাবিগুলো তুলে ধরেন মিজানুর রহমান, যিনি সম্প্রতি ওয়াসার এমডিকে ওয়াসার পানির শরবত খাওয়াতে গিয়ে আলোচনায় এসেছেন।

তাদের দাবিগুলো হল-

>> দূষিত পানির কারণে জুরাইন, শ্যামপুর, মুরাদপুর, দনিয়ায় যারা অসুখ-বিসুখের শিকার হয়েছেন, তাদের প্রত্যেককে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।

>> ওয়াসার সরবরাহ করা দূষিত পানির জন্য এ যাবতকালে যে বিল আদায় করা হয়েছে, তার পুরো অর্থ গ্রাহককে ফেরত দিতে হবে।

>> সুপেয় পানি না পাওয়া পর্যন্ত ওইসব এলাকার মানুষ ওয়াসাকে আর বিল দেবে না।

>> বছরের পর বছর নোংরা, দূষিত পানি সরবরাহের জন্য ওয়াসার যারা দায়ী, তদন্ত করে তাদের কঠোর শাস্তি দিতে হবে।

>> ওয়াসার পানি শতভাগ সুপেয় বলে দাবি করেছেন এ প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান। ওই ‘অসত্য’ বক্তব্যের জন্য তাকে ক্ষমা চাইতে হবে এবং সুষ্ঠুভাবে দায়িত্ব পালন করতে না পারলে পদত্যাগ করতে হবে।

ওয়াসার পানি

রাজধানীর প্রায় দেড় থেকে দুই কোটি মানুষের জন্য পানি সরবরাহ করে ঢাকা ওয়াসা। কিন্তু সেই পানিতে ময়লার সঙ্গে দুর্গন্ধসহ নানা সমস্যার অভিযোগ অনেক পুরনো।

ওয়াটার এইড বাংলাদেশের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে নিরাপদ পানির প্রাপ্যতার হার ৫৬ শতাংশ। ঢাকার চিত্রও মোটামুটি একই রকম।

ঢাকায় দৈনিক বিশুদ্ধ পানির চাহিদা ২৩০-২৩৫ কোটি লিটার। ওয়াসা গভীর নলকূপ থেকে তুলে ১৭০ কোটি লিটার এবং বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যার পানি শোধন করে আরও ৬০ কোটি লিটার পানির যোগান দেয়।

কিন্তু অনেক এলাকায় সরবরাহ লাইনে ত্রুটির কারণে পরিশোধিত পানি বাসার কলে আসার সময় নিয়ে আসে ময়লা আর দুর্গন্ধ। ওই পানি ফোটালেও দুর্গন্ধ দূর হয় না সব সময়। ওয়াসার ওই পানি পেটের পীড়াসহ নানা ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যার কারণ বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ গণশুনানিতে বলেন, ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর পানি পরিষ্কার থাকলে মানুষের অসুখ-বিসুখ অর্ধেক কমে যেত।

“ঢাকায় পানিবাহিত রোগীর সংখ্যাই বেশি। পাইপের মাধ্যমে প্রতিটি মানুষের ঘরে নিরাপদ পানি যাবে, এটা তাদের নাগরিক অধিকার। কিন্তু সেটা জনগণ ভোগ করতে পারছে না। আলাদাভাবে পানির বাণিজ্যিকীকরণের ব্যবস্থা হচ্ছে। আমরা চাই, এটা বন্ধ করে ওয়াসার নিরাপদ সুপেয় পানি ঘরে বসে ট্যাপ খুলে পান করতে।”

বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স পানি নিয়ে এই গণশুনানিকে বর্ণনা করেন ‘জীবন নিয়ে গণশুনানি’ হিসেবে।

“পানির অপর নাম জীবন। ওয়াসার অনিয়ম-দুর্নীতি এখনো বন্ধ করা যায়নি। যদি এই দুর্নীতি বন্ধ করা যেত, তবে বছর বছর পানির দাম বাড়ত না। নাগরিকরা ঘরে বসে বিশুদ্ধ সুপেয় পানি পেত।”

তিনি বলেন, “ওয়াসার পাহারাদার সরকারকে আমরা বলতে চাই, আমরা বোতলের পানি কিনে পান করতে চাই না, আমরা সরাসরি ট্যাপের পানি পান করতে চাই।”

জনসাস্থ্য প্রকৌশলী ড. লেলিন চৌধুরী বলেন, ওয়াসার দায়িত্ব নগরবাসীকে সুপেয় পানি সরবরাহ করা। কিন্তু তারা তা পারছে না।

“আসাদগেইটে ওয়াসার একটি ল্যাবরেটরি আছে, সেখানে পানির বিশুদ্ধতা নির্ণয় করা হয়। সেখানে তারা আমাদের টাকায় বেতন নিচ্ছে ঠিকই, কিন্তু কাজ করছে না। সরকারের উচিত, তারা হয় নিয়মিত কাজ করবে, না হলে ওয়াসার ওই ডিপার্টমেন্ট বাতিল করে দেওয়া হোক।”

জুরাইন বাসিন্দা হাফিজুল ইসলাম সানি গণশুনানিতে বলেন, ছোট থেকে তিনি ওই এলাকায় বড় হয়েছেন। একটা সময় ছিল যখন সরাসরি ট্যাপের পানিই খাওয়া যেত, সেটাই ছিল স্বাভাবিক।

“কিন্তু এখন ওই পানি দিয়ে গোসলও করতে মন চায় না। অনেক সময় পানির রঙ হয় হলুদ বা কালো। ওই পানি দিয়ে রান্না তো অসম্ভব ব্যাপার। ওয়াসার কাছে আমরা বারবার অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার পাইনি।” 

অন্যদের মধ্যে বাসদের কেন্দ্রীয় নেতা বজলুর রশিদ ফিরোজ, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হাসনাত কাইয়ুম এবং ওয়াসার নিরাপদ পানি আন্দোলনের সদস্যরা গণশুনানিতে উপস্থিত ছিলেন।