এই ওয়াসাকে আর এক পয়সাও বিল নয়: মিজানুর

ঢাকা ওয়াসার ‘শতভাগ বিশুদ্ধ’ পানি দিয়ে শরবত বানিয়ে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খানকে তা খাওয়াতে ঢাকার কারওয়ান বাজারের ওয়াসা ভবনে এসেছিলেন জুরাইন নাগরিক অধিকার বাস্তবায়ন পরিষদের সমন্বয়ক মিজানুর রহমান; কিন্তু এমডির দেখা না পেয়ে ওয়াসার পরিচালকের আশ্বাস নিয়েই বাড়ি ফিরতে হল তাকে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 April 2019, 04:13 PM
Updated : 24 April 2019, 12:39 PM

ওয়াসার পরিচালক সহিদ উদ্দিন তাকে আশ্বাস দিয়েছেন, জুরাইনে গিয়ে সরবরাহ লাইনের পানি পরীক্ষা করে দেখা হবে, সমস্যা থাকলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

তবে মঙ্গলবার দুপুরে ওয়াসা ভবন ছেড়ে যাওয়ার আগে মিজানুর সাংবাদিকদের বলেছেন, এমডিকে ওয়াসার পানির শরবত খাওয়াতে না পেরে তিনি হতাশ।

“এ পর্যন্ত ঢাকা ওয়াসার পানি খেয়ে যারা অসুস্থ হয়েছে বা মারা গেছে, তদন্ত করে ওয়াসাকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এ পর্যন্ত ওয়াসা দূষিত পানি দিয়ে যে বিল নিয়েছে, তা গ্রাহকদের ফেরত দিতে হবে। এই ব্যবস্থা না নেওয়া পর্যন্ত ওয়াসাকে আর এক পয়সাও বিল দেব না।”

মিজানুরের পাশাপাশি সাংবাদিকরাও দুপুর পর্যন্ত ওয়াসার এমডির অপেক্ষায় থেকে বিফল হয়েছেন। তবে তাকসিম এ খান টেলিফোনে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, ‘অন্যের বানানো’ শরবত খেতে তার আপত্তি আছে।

ঢাকা ওয়াসার সরবরাহ করা পানি নিয়ে রাজধানীবাসীর অভিযোগের শেষ নেই। পুরনো সরবরাহ লাইন দিয়ে যে পানি আসে তাতে ময়লা আর দুর্গন্ধ থাকার কথা এবং সেই পানির কারণে অসুস্থতার খবর সংবাদমাধ্যমগুলোতে নিয়মিতই আসে।

কিন্তু তারপরও তাকসিম এ খান ওয়াসার পানিকে শতভাগ সুপেয় বলে দাবি করে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম তুমুল সমালোচনার মুখে পড়েছেন। 

টিআইবি গত ১৭ এপ্রিল ‘ঢাকা ওয়াসা: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে জানায়, ঢাকা ওয়াসার ৯১ শতাংশ গ্রাহকই পানি ফুটিয়ে পান করেন।

আর বাসাবাড়িতে এই পানি ফোটাতে বছরে পোড়াতে হয় ৩৬ কোটি ৫৭ লাখ ৩৭ হাজার ঘনমিটার গ্যাস, যার আর্থিক মূল্য ৩৩২ কোটি ৩৭ লাখ টাকা।

এরপর গত শনিবার সংবাদ সম্মেলন করে ওই প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করেন ওয়াসার এমডি তাকসিম। তিনি দাবি করেন, ওয়াসার সরবরাহ করা পানি শতভাগ সুপেয়।

তার ওই বক্তব্যের প্রতিবাদ জানাতে মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে স্ত্রী শামিম হাশেম খুকি, শিশুকন্যা আর বন্ধু মতিউর রহমানকে সঙ্গে নিয়ে কারওয়ান বাজারে ঢাকা ওয়াসার কার্যালয়ে হাজির হন মিজানুর রহমান।

জুরাইন থেকে কাচের জগে করে তারা নিয়ে এসেছিলেন ওয়াসার পানি, সঙ্গে ছিল প্যাকেট ভরা চিনি আর লেবু। তাদের ইচ্ছে ছিল, ওই পানি দিয়ে শরবত বানিয়ে ওয়াসার এমডিকে তা খাওয়াবেন।

কিন্তু উপস্থিত পুলিশ ও আনসার সদস্যরা মিজানুর ও তার সঙ্গীদের ওয়াসা ভবনে ঢুকতে বাধা দিয়ে জানান, এমডি সাহেব অফিসে নেই, তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হচ্ছে।

পুলিশের ওই বক্তব্য শুনে মিজানুর তার সঙ্গীদের নিয়ে ওয়াসা ভবনের সিঁড়িতে বসে পড়েন। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, জুরাইন এলাকায় ওয়াসার পাইপ ৪০ বছর আগের। ওই পাইপ দিয়ে যে পানি আসে, তা তারা খেতে পারেন না। বাধ্য ও নিরুপায় হয়ে অন্য কাজে ব্যবহার করেন।

কাচের জগে ময়লা ভাসতে থাকা পানি দেখিয়ে তিনি বলেন, “এটা মাঝারি ধরনের। এর থেকে খারাপ পানিও পাই।”

মিজানুর বলেন, নিরাপদ পানি সরবরাহের জন্য ২০১২ সালে সাড়ে তিন হাজার মানুষের স্বাক্ষর সংগ্রহ করে ওয়াসার এমডিকে চিঠি পাঠানো হয়েছিল।

“কিন্তু কোনো ব্যবস্থাই তিনি নেননি। আমাদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছিলেন। এখন তিনি কীভাবে বললেন, ওয়াসার পানি বিশুদ্ধ! আমরা ক্ষুব্ধ। উনার পানি উনাকে খাওয়াতে এসেছি। শতভাগ সুপেয় পানির কথা অসত্য। এই কথার জন্য উনাকে ক্ষমা চাইতে হবে এবং পদত্যাগ করতে হবে।”

বেলা ১১টা থেকে ২টা পর্যন্ত ওই সিঁড়িতে শরবত নিয়ে এমডির অপেক্ষা করেন মিজানুর। এক পর্যায়ে রামপুরা থেকে আসা মুনিরুল ইসলাম নামে একজন ওই প্রতিবাদে যোগ দেন।

তাকসিম এ খান (ফাইল ছবি)

ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খান নিজের কার্যালয়ে না এলেও দুপুরের দিকে টেলিফোনে তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হয়- ওয়াসার পানি যেহেতু ‘শতভাগ সুপেয়’, মিজানুরের বানানো ওই শরবত তিনি খাবেন কি না।

তাকসিম এ খান উত্তরে বলেন, “আমি তো কারো পানিতেই.. কারোই তো খাব না। আমি তো খাব আমার পানি। আমি কোনটা খাব না খাব; সেটা তো আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার।

“তাদের পানিতে যদি ময়লার অভিযোগ থাকে, তাহলে তারা পরিচালকের সাথে কথা বলতে পারে।”

মিজানুর শরবত দিয়ে ওয়াসা ভবনের সিঁড়িতে বসে আছেন। এই অবস্থায় সেখানে যাবেন কি না জানতে চাইলে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, “যাব তো বটেই। আমার তো ৪টার সময় মিটিং আছে একটা।”

এদিকে সিঁড়িতে এমডির অপেক্ষায় থাকা মিজানুরকে দুপুরে নিজের কক্ষে ডেকে নিয়ে যান ওয়াসার পরিচালক (টেননিক্যাল) প্রকৌশলী এ কে এম সহিদ উদ্দিন। গণমাধ্যম কর্মীরাও সেখানে উপস্থিত হন।

জুরাইন নাগরিক অধিকার বাস্তবায়ন পরিষদের সমন্বয়ক মিজানুর রহমান সেখানে বলেন, তার এলাকার পানি দূষিত, পানির সাথে ময়লা আসে।

“ওই পানি পান করার মতো অবস্থা থাকে না। এরপরও এমডি কীভাবে বলতে পারলেন যে ওয়াসার পানি শতভাগ সুপেয়?”

এমডির বক্তব্যের বিষয়টি পাশ কাটিয়ে গিয়ে ওয়াসার পরিচালক বলেন, “আপনার অভিযোগ আমরা শুনেছি। আমরা যখই কমপ্লেইন পাই, তখনই পানি টেস্ট করি। এরপর সে অনুযায়ী পানির লাইনগুলো চেক করে ব্যবস্থা নিয়ে থাকি।”

মিজানুর তখন সঙ্গে করে আনা পানির জগ তুলে ধরে বলেন, “এই দেখেন, এটা কী?”

ওয়াসার পরিচালক তখন বলেন, “না না ঠিক আছে, আপনি এই পানির স্যাম্পল নিয়ে এসেছেন, আমি অস্বীকার করছি না যে এই পানি আমাদের না।

“এখন আপনার সাথে আমাদের অফিসারসহ টিম যাবে, সেখানে গিয়ে পানি নিয়ে এসে আমরা পরীক্ষা করে দেখব কী সমস্যা, সমস্যা থাকলে অবশ্যই আমরা ব্যবস্থা নেব।”

মিজানুর রহমান বলেন, ২০১২ সালেও একইভাবে জুরাইন এলাকার সাড়ে তিন হাজার মানুষের স্বাক্ষর সম্বলিত চিঠি দিয়ে পানি সমস্যার সমাধানের দাবি জানানো হয়েছিল, আজকের এমডি তখনও দায়িত্বে ছিলেন, কিন্তু তিনি কোনো ব্যবস্থা নেননি।

প্রকৌশলী এ কে এম সহিদ উদ্দিন উত্তরে বলেন, “তখন তো আমি ছিলাম না। এমন অভিযোগ পাওয়া গেলে অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকি। আমি দেখব আপনার সেই আগের অভিযোগের ফাইল কোথায় আছে।”

ওয়াসার পানি নিয়ে এমডির দাবি ‘অসত্য’ মন্তব্য করে মিজানুর রহমান বলেন, এর জন্য তাকসিম এ খানকে পদত্যাগ করতে হবে।

পরিচালকের কক্ষ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “আমি সন্তুষ্ট হতে পারলাম না। আমার ইচ্ছে ছিল এমডি যেহেতু তার দেওয়া পানি শতভাগ বিশুদ্ধ বলেছেন, সেই পানি দিয়ে তাকেই শরবত বানিয়ে খাওয়াব। কিন্তু দুপুর ২টা পর্যন্ত অপেক্ষা করেও তার দেখা পেলাম না।”

মিজানুরের মত বেশিরভাগ মানুষই ওয়াসার এমডির দাবির সঙ্গে একমত নন। তার ওই বক্তব্য নিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের নিয়মিত মতামত জরিপে পাঠকদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল- তারা ওয়াসার পানি শতভাগ সুপেয় বলে মনে করেন কি না।

উত্তরে ৯৭ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, তারা তা মনে করেন না।