প্রতিটি অগ্নিকাণ্ডের পর যে বিষয়গুলোর উপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়ে আসছে, সেগুলোর অভাব দেখা গেল বনানীর বহুতল ভবন এফআর টাওয়ারেও।
Published : 28 Mar 2019, 10:38 PM
ঢাকার বনানীর ২৩ তলা এই ভবনে বৃহস্পতিবার দুপুরে আগুন লেগে চারটি তলা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়; অন্তত ১৯ জন নিহত এবং অর্ধ শতাধিক মানুষ আহত হন।
অনেকগুলো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় থাকলেও এই ভবনে অগ্নি নির্বাপনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা ছিল না বলে সংশ্লিষ্ট প্রতিমন্ত্রীর কথায় উঠে এসেছে। যেটুকু ছিল, সেগুলোও কার্যকর ছিল না বলে ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তাদের ভাষ্য।
সুউচ্চ এফআর টাওয়ার গড়তে ভবন নির্মাণের নীতিমালা মানা হয়নি বলেও দাবি করেছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম।
কামাল আতাতুর্ক এভিনিউয়ের ৩২ নম্বর হোল্ডিংয়ে ফারুক নামে এক ব্যক্তির জমিতে এই বাণিজ্যিক ভবনটি তৈরি করে রূপায়ন গ্রুপ। ভবন নির্মাণে অব্যবস্থাপনা নিয়ে তাদের কারও বক্তব্য তাৎক্ষণিকভাবে পাওয়া যায়নি।
ঢাকায় এর আগে বিভিন্ন অগ্নিকাণ্ডের পর সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো থেকে শুরু করে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে ভবন নির্মাণের নীতিমালা ও অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থা ও দুর্ঘটনা হলে বেরিয়ে আসার পথ রাখার উপর জোর দেওয়া হচ্ছে।
কিন্তু তাতে যে কাজ হচ্ছে না, পুরান ঢাকার চকবাজারে অগ্নিকাণ্ডের দেড় মাসের মধ্যে এফআর টাওয়ারের আগুনের ঘটনা তাই আবার প্রকাশ করল।
অগ্নিকাণ্ডে হতাহতদের দেখতে রাতে কুর্মিটোলা হাসপাতালে গিয়ে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান সাংবাদিকদের জিজ্ঞাসায় বলেন, এফআর টাওয়ারে অগ্নি নির্বাপণের নিজস্ব কোনো ব্যবস্থা ছিল না।
তিনি বলেন, “ফায়ার সার্ভিসের লোকজন আমাকে জানিয়েছে, এ টাওয়ারে অগ্নিনির্বাপনের নিজস্ব কোনো ব্যবস্থা ছিল না।”
ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. সাজ্জাদ হোসাইন অগ্নিকাণ্ডস্থলে সাংবাদিকদের বলেন, “আমি ভেতরে গিয়েছিলাম; দেখেছি কিছু যন্ত্রপাতি ছিল, কিন্তু সেগুলো ইউজেবল (ব্যবহার উপযোগী) ছিল না।”
২২ তলা এই ভবনের মাঝামাঝিতে সপ্তম ও অষ্টম তলায় প্রথম আগুন দেখা যায়। পরে তা আরও কয়েক তলায় ছড়ায়। ওই সময় ভবনে থাকা মানুষগুলোর কেউ কেউ সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে আসতে চেষ্টা করেন। কেউ বা ছুটে যান উপরের দিকে।
ভবনটির ১৩ তলায় থাকা ডার্ড নামে একটি পোশাক কারখানার কর্মী শফিকুল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সিকিউরিটি যখন বাঁশিতে ফুঁ মারছে, তখন সিঁড়ি দিয়া প্রথমে সাততলায় আইছি। আসার পর দেখি নামার মতো আর কোনো পথ নাই। ডাইরেক্ট যাইয়া উপরে উঠছি।”
প্রতিমন্ত্রী এনামুর বলেন, “বিল্ডিংয়ের এমার্জেন্সি কলাপসিবেল গেইট বন্ধ ছিল। সে কারণে উদ্ধার কাজ বিঘ্নিত হয়েছে। এছাড়া বিল্ডিংয়ের সিঁড়িটা ছিল সরু।”
এই ধরনের ঘটনায় ছাদে আশ্রয় নিলে তাদের উদ্ধার করতে পারেন উদ্ধারকর্মীরা। কিন্তু এফআর টাওয়ারের ছাদও খোলামেলা ছিল না বলে ডার্ডের কর্মী সাব্বির জানান।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, জমির মালিক আর নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের দ্বন্দ্বে ছাদও ভাগ করেছে তারা। সেখানে দাঁড়ানোর অবস্থাও ছিল না।
“দুই জনের বিল্ডিং এইটা। তাদের ঝামেলার কারণে ছাদটা পর্যন্ত ভাগ করে ফেলেছে। সেখানে সিকিউরিটিদের থাকার জায়গা করা হয়েছে। একটা ছাদে দেয়াল উঠাইছে প্রায় ১০ ফুট। এমন পরিস্থিতি যে ছাদে গিয়া একটু খোলা বাতাস খাওয়ার সুযোগ নাই।”
অগ্নিকাণ্ডস্থলে গিয়ে দেখে আসার পর ঢাকা উত্তরের মেয়র আতিক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘বিল্ডিং কোড’ মেনে ওই ভবনটি বানানো হয়নি।
“আমি প্রাথমিকভাবে বলছি, এই ভবনটি বাংলাদেশ জাতীয় বিল্ডিং কোডের সব শর্ত মেনে করা হয়নি। তাদের ইমার্জেন্সি এক্সিটও ঠিক ছিল না। ।”
নিজের পোশাক কারখানায় অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা রাখার অভিজ্ঞতা থেকে বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আতিক বলেন, “বিল্ডিং কোড মেনে বানানো হলে তাদের ফায়ার ফাইটিং ব্যবস্থা পুরোটা থাকত। তাদের ফায়ার হাইড্রেন্ট থাকত, তাতে পানি উপরের ফ্লোর পর্যন্ত কাভার করতে পারত।”
আগুন নেভাতে যাওয়া অগ্নিনির্বাপক বাহিনীর কর্মকর্তারাও পানি না পাওয়ার কথা বলেছিলেন।
কীভাবে আগুনের সূত্রপাত ঘটেছে, সে বিষয়ে কিছু জানাতে না পারলও আগুন ছড়িয়ে পড়ার কারণ দেখাতে পেরেছেন ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক।
তিনি বলেন, “ভেতর তো সাধারণত ভিনাইল বোর্ড দিয়ে ডেকোরেট করা থাকে, এখানেও তাই ছিল, তার সঙ্গে প্লাস্টিক বোর্ডও ছিল। যেগুলো ফুয়েল হিসেবে কাজ করছে এবং দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ে।”
অগ্নিকাণ্ডের কারণ উদঘাটনের জন্য তদন্তের জন্য অপেক্ষা করার কথা জানিয়েছেন সাজ্জাদ হোসাইন।
এই অগ্নিকাণ্ড তদন্তে কয়েকটি কমিটি করা হয়েছে। এর একটি করেছে অগ্নিনির্বাপক বাহিনী। এছাড়া দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় একটি, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় আরেকটি কমিটি গঠন করেছে।
রাতে অগ্নিকাণ্ডস্থলে গেলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব-উল আলম হানিফকে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেন এই ভবনেই এক দশক আগে সংঘটিত আরেক অগ্নিকাণ্ডের বিষয়ে।
তখন গঠিত তদন্ত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল- প্রশ্ন করা হল তিনি বলেন, “তখন কী ঘটেছিল, তা এখন আমি স্পষ্ট কিছু বলতে পারছি না। যদি কারও গাফিলতি পাওয়া যায়, ব্যবস্থা নেওয়া হবে।"
বহুতল ভবনের জন্য প্রণীত নকশা অনুসরণ করেই এখন থেকে ভবন নির্মাণ করতে হবে বলে কড়া সতর্কবার্তা দেন হানিফ।
এফআর টাওয়ারের অনুমোদনের ক্ষেত্রে রাজউকের কোনো গাফিলতি ছিল কি না- প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “ভবনের নকশাগুলোতে কী ছিল-কী ছিল না, তা এখন দেখার সময় নয়। এখন আগুনের ঘটনায় আগে হতাহতদের উদ্ধার গুরুত্বপূর্ণ।
“প্রধানমন্ত্রী নিজে মনিটরিং করেছেন। তিনি নির্দেশ দিয়েছেন। সেই অনুযায়ী আমরা কাজ করে যাচ্ছি। বহুতল ভবন যারা শর্ত না মেনে নির্মাণ করছে, তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
এফআর টাওয়ারের ক্ষেত্রেও তদন্ত কমিটিগুলো বিষয়গুলো দেখবে বলে জানান হানিফ।
অগ্নিকাণ্ডস্থলে যাওয়ার আগে কুর্মিটোলার হাসপাতালে গিয়েছিলেন হানিফ। সেখানে তাকে পাশে রেখে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী এনামও সাংবাদিকদের বলেন, তদন্ত কমিটির সুপারিশ খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।