ইঁদুর ধরতে না পারলে সেই বিড়ালের কী দরকার: ‍দুদক প্রসঙ্গে হাই কোর্ট

বিনা অপরাধে জাহালমের কারাবাসের দায় দুদকের এড়ানোর সুযোগ নেই বলে মনে করে হাই কোর্ট।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 March 2019, 11:54 AM
Updated : 6 March 2019, 12:52 PM

বুধবার এই বিষয়ক শুনানিতে এই ঘটনা নিয়ে দুদকের কার্যক্রমে উষ্মা প্রকাশ করে এই মন্তব্যও করে যে ইঁদুর ধরতে না পারলে সেই বিড়ালের প্রয়োজন নেই।

জাহালমের (সালেক) বিরুদ্ধে দুদকের করা সব মামলার প্রাথমিক তথ্য বিবরণী (এফআইআর), অভিযোগপত্র (সিএস)সহ যাবতীয় নথিও চেয়েছে হাই কোর্ট।

আগামী ১০ এপ্রিল পরবর্তী শুনানির তারিখ রেখে এই সময়ের মধ্যে তা আদালতে নিয়ে আসতে দুদককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকসহ পাঁচটি বাণিজ্যিক ব্যাংককে এই মামলায় পক্ষভুক্ত করার আবেদন গ্রহণ করে আদালত জাহালমকাণ্ডে সম্পৃক্ত বাকি ব্যাংকগুলোকেও পক্ষভুক্ত করতে নির্দেশ দিয়েছে দুদককে।

আসামি না হয়েও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় পাটকলকর্মী জাহালমের তিন বছর কারাবাসের ঘটনায় মঙ্গলবার দুদক হলফনামা আকারে ব্যাখ্যা দাখিল করে।

তার উপর শুনানির পর বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কামরুল কাদেরের হাই কোর্ট বেঞ্চ বুধবার এসব আদেশ দেয়।

গত ৩ ফেব্রুয়ারি জাহালমের জামিন আদেশের পর দুদকের আইনজীবী এ বিষয়ে সবিস্তার ব্যাখ্যা দাখিলের জন্য চার সপ্তাহের সময় নিয়েছিলেন। মঙ্গলবার আদালতে ব্যাখ্যা দাখিল করে দুদক এই ঘটনায় ব্যাংক কর্মকর্তাদের দায়ী করেন।

তার আগে সোমবার বাংলাদেশ ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক, সিটি ব্যাংক লিমিটেড, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংককে এ রিট মামলায় পক্ষভুক্ত করতে আবেদন করে দুদক।

তার মধ্যে সোনালী ব্যাংক আগেই এ মামলায় পক্ষভুক্ত থাকায় বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বাকি চারটিকে বুধবার পক্ষভূক্ত করে নেয় আদালত।

টাঙ্গাইলের নাগরপুর উপজেলার ধুবুড়িয়া গ্রামের জাহালম নরসিংদীর একটি পাটকলে কাজ করতেন। স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে থাকতেন সেখানে।

২০১৬ সালে দুর্নীতি দমন কমিশনের এক মামলার আসামি ‘আবু সালেক’ হিসেবে গ্রেপ্তার করা হয় জাহালমকে। জাহালমের ভাষ্য, তখন তিনি বারবার বলছিলেন যে তিনি সালেক নন, কিন্তু তাতে কান দেননি দুদক কর্মকর্তারা।

বিনা অপরাধে জাহালমের কারবাসের ঘটনা গণমাধ্যমে দেখে তাকে মুক্তি দিতে আদেশ দেয় হাই কোর্ট। ওই আদেশে গত মাসে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে মুক্তি পান তিনি।

আসামি না হয়েও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় পাটকলকর্মী জাহালমের তিন বছর কারাবাসের ঘটনায় মঙ্গলবার দুদক হলফনামা আকারে ব্যাখ্যা দাখিল করে।

কীভাবে একজন নির্দোষ ব্যক্তি কারাগারে গেলেন এবং তার দায় কার, এখন তা বের করতে চাইছে আদালত।

দুদককেও ‘ক্লিন’ হতে হবে

বুধবার শুনানির শুরুতেই দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান প্রথম আলো পত্রিকায় জাহালমের ঘটনায় দুদকের ব্যাখ্যা সংক্রান্ত প্রকাশিত খবর আদালতে তুলে ধরেন।

এসময় তিনি আদালতের কাছে নির্দেশনা চান, ‘কোর্ট প্রসেডিংসের বাইরে সাংবাদিকরা যাতে কিছু না লেখে।  

তখন এক বিচারক জানতে চান, “প্রকাশিত খবরে যে উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে, সেটা কি আপনি দিয়েছেন?”

জবাবে খুরশীদ বলেন, “হ্যাঁ, বক্তব্যটা আমি দিয়েছি। কিন্তু এটাও বলেছি যে, এটা সাবজুডিস মেটার। আপনি নিউজটা দেখেন, লিখেছে, দুদক এখন দায় নিচ্ছে না। একটা পারসেপশন দাঁড় করানো হচ্ছে। একটি বিচারাধীন বিষয়ে ডিসিশন দিয়ে দিচ্ছে।

“দায় কার? এটা তো এখনও আমরা বলতে পারছি না। তাই কোর্ট প্রসেডিংসের বাইরে না লেখার বিষয়ে কিছু বলুন।”

বিচারক কোনো নির্দেশনা না দিয়ে বলেন, “কোর্ট প্রসেডিংসের বাইরের আসলে লেখা যায় না।”

খুরশীদ আলম তখন বলেন, “এটা তো তারা মানছে না।”

ফাইল ছবি

আদালত তখন বলে, “মতামত বা পারসেপশন তৈরি হয় এমন মন্তব্য করবেন না। দুদক একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। দুদক সম্পর্কে খারাপ পারসেপশন হোক, আমরা তা চাই না।

“তবে দুদককেও ক্লিন হতে হবে। দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হচ্ছে। আগে দুর্নীতিবাজদের মানুষ ঘৃণা করত। আমাদের নৈতিক অধঃপতন হয়েছে।”

তখন দুদকের আইনজীবী বলেন, “আমরা স্বাধীন, কিন্তু কিছু শিডিউল দিয়ে তো আমাদের হাত-পা বাঁধা। শিডিউলের মধ্যে থেকেই তো আমাদের কাজ করতে হয়।”

এ পর্যায়ে বিচারক বলে, “যেটুকুই আছে সেটুকুই করেন। সেটুক করলেই তো হয়। স্বাধীনতা পাবেন, আর সেভাবে কাজ করতে পারবেন না, এটা তো হতে পারে না।”

শুনানিতে দুদকের আইনজীবী জাহালমকাণ্ডে পাঁচটা ব্যাংককে পক্ষভুক্ত করা হয়েছে উল্লেখ করলে আদালত অন্য ব্যাংকগুলোকে না করা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।

“পিক অ্যান্ড চুজ করছেন না কি”- বিচারকের এই প্রশ্নে খুরশীদ আলম বলেন, “অগ্রণী ব্যাংকের একটি শাখা ছিল, ওটাকে করিনি।”

আদালত বলে, অগ্রণী ব্যাংককে কেন বাদ দেওয়া হল?

জবাবে খুরশীদ আলম বলেন, “যে কয়টা ব্যাংককে পক্ষভুক্ত করেছি, এদের মধ্যে দিয়ে পুরো ঘটনাটা বোঝা সম্ভব মনে করেছি, তাই।”

বিচারক তখন বলেন, “মিস্টার খান, স্ট্রেট কোশ্চেন টু ইউ- মামলা যেহেতু করেছেন তাহলে অগ্রণী ব্যাংককে কেন পার্টি করলেন না? ইসলামী ব্যাংককে বাদ দিলেন কেন? ব্যাংক কয়টা?”

জবাবে খুরশীদ আলম খান বলেন, “১৮টা। সময়ের কারণে আমি গোছাতে পারিনি। সব আমি দেব।”

তখন বিচারক বলেন, “আজ কেন দেওয়া হয়নি? তাহলে আজ কেন এসেছেন? চার্জশিট কোথায়?”

দুদক আইনজীবী বলেন, “কমপ্লায়েন্স দিতে হবে, তাই তাড়াহুড়া করে দিয়েছি। আমাকে একটু সময় দেন, সব দেব।”

বিচারক তখন বলেন, “কত সময়? তাহলে কেন আমাদের সময় নষ্ট করছেন?”

‘দায় দুদককে নিতেই হবে’

জাহালমের ঘটনায় দুদক কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে তা খুরশীদ আলম আদালতে তুলে ধরতে চাইলে বিচারক বলেন, “কোনো স্টেপ নেননি। ১৬৪ ধারায় এক আসামি যে জবানবন্দি দিয়েছে, সেটা কেন চার্জশিটে অন্তর্ভূক্ত করা হয়নি। হাউ ডেঞ্জেরাস!”

খুরশীদ আলম তখন বলেন, একটা তদন্ত কমিটি হয়েছে। সোনালী ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতি সংক্রান্ত মামলাগুলোর অধিকতর তদন্ত প্রতিবেদন বিচারিক আদালতে জমা দেওয়া হয়। একই সঙ্গে জাহালমের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রত্যাহার চেয়েও বিচারিক আদালতে আবেদন করা হয়।

খুরশীদ আলম হলফনামা থেকে তথ্য তুলে ধরে আদালতকে বলেন, ব্যাংক কর্মকর্তাসহ সাক্ষীরা জাহালমকে সালেক বলে শনাক্ত করেন। তবে অধিকতর তদন্তে জানা যায়, প্রকৃত আসামি সালেকের বাড়ি ঠাকুরগাঁও।

আদালত তখন দুদক আইনজীবীর কাছে জানতে চায়, কবে দুদক জানতে পারল যে জাহালম সালেক নন।

উত্তরে খুরশীদ আলম বলেন, “গত বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি জানতে পেরেছি। চ্যানেল টোয়েন্টিফোরে জাহালমের বিষয়ে রিপোর্ট আসার পর জাহালম যে নির্দোষ সে বিষয়ে দুদক তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়।

“সে তদন্তে জাহালম যে নির্দোষ তা উঠে আসে। তদন্তে দেখা গেছে যে, সে অভিযুক্ত না। তাই আমরা তো বিষয়টি নিয়ে সঠিক পথেই আছি।”

বিচারক তখন বলেন, “চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের রিপোর্ট হওয়ার আগে তিনি (তদন্ত কর্মকর্তা) কী করেছেন? দুদক একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান, আপনাদের অনেক স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। যে বিড়াল ইঁদুর ধরতে পারে না সেই বিড়াল থাকার দরকার কী?”

জবাবে দুদক আইনজীবী বলেন, “আমাদেরও তো সীমাবদ্ধতা আছে।”

মুক্তির পর কাশিমপুর কারাগারের সামনে জাহালম

বিচারক তখন জানতে চান, “কবে আপনারা জানলেন জাহালম নির্দোষ আর কবে আদালতে অধিকতর তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিলেন?”

খুরশীদ আলম তখন বলেন, অধিকতর তদন্ত প্রতিবেদন তিনি আদালতে নিয়ে এসেছেন। এগুলো সবই তিনি আদালতে জমা দেবেন।

বিচারক তখন দুদক আইনজীবীকে বলেন, “যখন আপনারা জানতে পারলেন জাহালম নির্দোষ, তখন আপনাদের উচিৎ ছিল জাহালমের জামিনের ব্যবস্থা করা। জাহালম বলে আসছেন, সে নির্দোষ। কিন্তু কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এর দায় আপনাদের নিতেই হবে।

“যখন জানতে পারলেন সে নিরাপরাধ। জানার পরেও কেন তার জামিনের ব্যবস্থা করলেন না? এটার দায় আপনাদের নিতে হবে।”

দুদকের আইনজীবী তখন বলেন, জাহালমকে যে ২৬ মামলার আসামি করা হয়, সে–সংক্রান্ত সব কাগজপত্র আদালতে জমা দেওয়া হবে।

দুদকের তদন্ত ‘যথাযথ হয়নি’

সোনালী ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতির ঘটনার ৩৩টি মামলার সব কাগজপত্র আদালতে জমা দিতে দুদককে নির্দেশ দিয়েছে আদালত।

বিচারক বলেন, “আমরা সব দেখব। এই যে ভুলভাবে মামলার আসামি করলেন এটা স্পেসিফিকভাবে হলফনামায় নাই কেন “

খুরশীদ আলম বলেন, “দেব, সব দেব। সবাইকে পার্টি করব। চার্জশিট দেব।”

বিচারক তখন বলেন, “পিক অ্যান্ড চুজ করছেন? ১৩ টা চেক তো ইসলামী ব্যাংকের। কতগুলো ব্যাংক অফিসিয়ালের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়েছেন? এটা দেখা দরকার। আমারা তো দেখছি ব্র্যাক ব্যাংকের যাকে আসামি করার তাকে সাক্ষী বানিয়েছেন। ১৮টি ব্যাংকের পক্ষভূক্ত করবেন।

“মিস্টার খান, এটি প্রমাণিত যে দুদক প্রোপার ইনভেস্টিগেশন করেনি।”

দুদকের তদন্ত কমিটি আরও সময় চায়

বিনা অপরাধে পাটকল শ্রমিক জাহালমের কারাভোগের ঘটনায় দুদকের তদন্ত কমিটি নির্ধারিত সময়ে প্রতিবেদন জমা দিচ্ছে না।

তদন্ত কমিটি সময় বাড়াতে কমিশনে আবদন করেছে বলে বুধবার দুদকের সচিব মুহাম্মদ দিলোয়ার বখ্ত সাংবাদিকদের জানিয়েছেন।

জাহালমের ঘটনায় দুদকের গাফিলতি রয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে গত ৪ ফেব্রুয়ারি দুদকের পরিচালক (লিগ্যাল) আবুল হাসনাত মো. আবদুল ওয়াদুদকে প্রধান করে তদন্ত কমিটিটি গঠন করা হয়।

২০ কর্মদিবসের মধ্যে কমিটি তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা ছিল। বৃহস্পতিবার সময় শেষ হচ্ছে, কিন্তু তদন্ত কাজ শেষ না হওয়ার কমিটি সময় চেয়েছে বলে জানান দুদক সচিব।

দিলোয়ার বখত্ বলেন, কমিটির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সময় বাড়ানো হবে।

“কতদিন সময় বৃদ্ধি করা হবে, এটা কমিশন সিদ্ধান্ত নেবে। আমরা আশা করছি, আগামী ১০ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন পেয়ে যাব।”

তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশ অনুয়ায়ী দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে, বলেন দুদক সচিব।

জাহালমের ঘটনায় ব্যাংক কর্মকর্তাদের দায়ী করে আদালতে দুদকের দেওয়া প্রতিবেদন নিয়ে প্রশ্ন করা হয় দিলোয়ারকে।

তিনি বলেন, “আমরা প্রতিবেদন দিয়েছি। সে বিষয়ে মহামন্য হাই কোর্টের বক্তব্য দিয়েছেন। তবে (অসন্তুষ্ট) এ ধরনের কোনো বক্তব্য আমরা পাইনি। আমাদের জানা নেই। আমরা যেটা জানতে পেরেছি- মহামান্য হাই কোর্টে বলেছে যেহেতু বিষয়টি বিচারাধীন রয়েছে সুতারাং কোনো পক্ষকে কথা না বলাটা ভালো।”