জেলের তিনটা বছর কে ফেরত দেবে, প্রশ্ন জাহালমের

নিরাপরাধ হয়েও দুদকের মামলায় তিন বছর কারাবাসের পর মুক্ত হয়ে জাহালম যখন টাঙ্গাইলের বাড়িতে পৌঁছলেন, তখন ভোররাত; তার মধ্যেই ছুটে বেরিয়ে এলেন মনোয়ারা বেগম, সন্তানকে দেখতে।

টাঙ্গাইল প্রতিনিধিএম এ রাজ্জাকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 Feb 2019, 12:31 PM
Updated : 4 Feb 2019, 12:31 PM

ছেলেকে পেয়ে আনন্দঅশ্রুতে ভাসছিলেন জাহালমের মা মনোয়ারা; আর বলছিলেন, “কার মাথায় বাড়ি দিছিলাম যে আমার এত বড় সর্বনাশ করছিল।”

পাড়া-প্রতিবেশীও ছুটে এসেছিলেন গণমাধ্যমের কল্যাণে সারাদেশে পরিচিত হয়ে ওঠা তাদের গ্রামের জাহালমকে দেখতে।

সাত বছর বয়সী সন্তান চাঁদনীকে কোলে নিয়ে জাহালমের মুখে তখন একটিই প্রশ্ন, তার জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া এই তিন বছর কে ফেরত দেবে?

টাঙ্গাইলের নাগরপুর উপজেলার ধুবুড়িয়া গ্রামের মৃত ইউসুফ আলীর ছেলে জাহালম নরসিংদীর একটি পাটকলে কাজ করতেন। স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে থাকতেন সেখানে।

২০১৬ সালে দুর্নীতি দমন কমিশনের এক মামলার আসামি ‘আবু সালেক’ হিসেবে গ্রেপ্তার করা হয় জাহালমকে। জাহালমের ভাষ্য, তখন তিনি বারবার বলছিলেন যে তিনি সালেক নন, কিন্তু তাতে কান দেননি দুদক কর্মকর্তারা।

এরপর থেকে কারাগারে থাকা জাহালমের ঘটনা জেনে তাকে মুক্তি দিতে আদেশ দেয় হাই কোর্ট। ওই আদেশে সোমবার প্রথম প্রহরে গাজীপুরের কাশিমপুর মুক্তি পান তিনি।

রাত ১টায় মুক্তি পাওয়ার পর ভাই জাহালমকে নিয়ে বাড়ির পথে রওনা হন বড় ভাই শাহানূর। ভোররাত ৪টার দিকে বাড়ি পৌঁছেন তারা।

বাড়ি ফেরার পরপরই মা ও পাঁচ ভাইবোনের আলিঙ্গনে আটকা পড়েন জাহালম। এরপর দুধ দিয়ে গোসল করিয়ে ছেলেকে ঘরে তোলেন মা মনোয়ারা।

জাহালমকে দেখতে ওই রাতেও প্রতিবেশীদের ভিড় ছিল ধুবুড়িয়া গ্রামের সেই বাড়িতে। সকাল হতে ভিড় বাড়তে থাকে, উপস্থিত হন গণমাধ্যমকর্মীরাও।

জাহালম তখন তার মেয়ে চাঁদনীকে কোলে নিয়ে আছেন; চার বছর বয়সে বাবাকে প্রায় হারিয়ে ফেলা চাঁদনী কোল থেকে নামছিলই না।

জাহালম তখন সাংবাদিকদের বলছিলেন তার জীবন থেকে তিন বছর হারিয়ে যাওয়ার গল্প; বিচার চাইছিলেন এরজন্য দায়ীদের।

“আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি জানাই, আমি তিনটা বছর বিনা অপরাধে জেল ঘাটছি। এই তিনটা বছর আমারে কেউ ফেরত দিতে পারবে না, কিন্তু এই তিনটা বছরের ক্ষতিপূরণ যেন আমারে দেওয়া হয়।”

যেভাবে হল?

গরিব ঘরের ছেলে জাহালম ২০০৩ সাল থেকে নরসিংদীর জুট মিলে চাকরি করতেন। স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে থাকতেন সেখানে, মাঝে-মধ্যে নাগরপুরের বাড়িতে আসতেন।

জাহালম বলেন, নরসিংদীতে থাকা অবস্থায় তার এলাকার ইউপি চেয়ারম্যান একদিন ফোন করেন তাকে, দেন মামলার খবর।

“চেয়ারম্যান সাব আমাকে ফোন করে ডেকে বলল, ‘ভাইগনা, এলাকায় আসো, তোমার নামে একটা মামলা হইছে’। আমি উনাকে বলি, আমার নামে তো কোনো মামলা-টামলা নাই। উনি বলেন, ‘না, মনে হয় আছে, তুমি এলাকায় আস’।

“বাড়িতে আসার পর তিনি আমাকে একটা লোকের ছবি দেখিয়ে বলেন, ‘এই ছবি কি তোমার?’ আমি বলি, না, এইটা তো আমার ছবি না। তখন তিনি বলেন, ‘কিন্তু চেহারা তো এক রকমই দেখা যায় বলে সবাই বলে’। তখন আমি উনাকে বলি, এইটা আমার ছবি না, আমি পড়ালেখা জানি না, তাই কোনোদিন টাই-টুই পরেও ছবি তুলি নাই।”

বিষয়টি নিয়ে সোমবার ধুবুরিয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মতিয়ার রহমানের মোবাইল ফোনে অসংখ্যবার কল করেও তার সাড়া পাওয়া যায়নি।

সেবার চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করে জাহালম পুনরায় নরসিংদী ফিরে গিয়েছিলেন। তার দুদিন পর দুদকের চিঠি আসে তার বাড়ির ঠিকানায়।

“আমার বড় ভাই আমাকে ফোন করে দুদকের চিঠির কথা জানায়। পরে দুই ভাই মিলে সেগুনবাগিচায় দুদকের অফিসে যাই। সেখানে যাওয়ার পর তারা আমাকে একটি ছবি দেখিয়ে বলে, ‘এই ছবিটা দেখছেন? এই ছবিটা তো আপনার।’

“তখন আমি বলি, জ্বি না স্যার, এই ছবিটা আমার না। তখন তারা একটা ব্যাংক একাউন্টের ছবি দেখায়। তখন উনাদের বলি, স্যার, আমি তো জীবনেও কোনো একাউন্ট করি নাই। আমি তাদের আমার আইডি কার্ড দেখাই। আমার চাকরির কাগজপত্র দেখাই। উনারা সেগুলোর ফটোকপি রাখে।”

এরপর ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঘোড়াশাল থেকে জাহালমকে গ্রেপ্তার করে দুদক। আদালতে তোলা হলেও জাহালম বলেছিলেন, তিনি সালেক নন। কিন্তু কাজ হয়নি। সালেক হিসেবে কারাবাস শুরু হয় জাহালমের।

দুর্ভোগের উপর দুর্ভোগ

জাহালমের মা মনোয়ারা অন্যের বাড়িতে কাজ করে তিন ছেলে ও তিন মেয়েকে বড় করেন। তার বড় ছেলে শাহানূর একজন বিদ্যুৎ মিস্ত্রি, নাগরপুরে ছোট একটি দোকান আছে তার।

মুক্তির পর কাশিমপুর কারাগারের সামনে জাহালম

শাহানূর জানান, তাদের ছোট বোন তাসলিমার বয়স যখন তিন বছর (এখন বয়স ২৩ বছর) তখন তার বাবা আরেকটি বিয়ে করেন। এরপর মনোয়ারায় সংসারের হাল ধরেন। বছর কয়েক আগে ধারদেনা করে ১০ শতাংশ জায়গা কেনেন। সেখানে টিনের দোচালা দুটি ঘর তোলেন।

দুঃখের সঙ্গে বসবাসকারী মনোয়ারা বলেন, যেদিন ছেলে জাহালমকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হয়, সেদিন তার আরেক কষ্ট শুরু হয়েছিল।

জাহালমকে মুক্ত করতে বড় ছেলে শাহানূরের প্রাণান্ত চেষ্টার কথা বলেন মনোয়ারা।

তিনি বলেন, মামলার শুনানির দিনে জাহালমকে দেখার জন্য টাঙ্গাইল থেকে ঢাকার আদালতে যেতেন শাহানূর। এজন্য অন্যের কাছ থেকে টাকা ধার করতে হত।

অনেকের কাছ থেকে সুদেও টাকা নিয়েছেন মনোয়ারা, নিয়েছেন এনজিওর ঋণ। এখনও প্রায় প্রতিদিন পাওনাদাররা বাড়িতে ভিড় করে বলে জানান মনোয়ারা। তার ভাষায়, একজনের কাছ থেকে ধার করে আরেকজনের ধার পরিশোধ করছেন তিনি।

কী বলছে এখন দুদক

সোনালী ব্যাংকের প্রায় সাড়ে ১৮ কোটি ৪৭ লাখ টাকা জালিয়াতির অভিযোগে আবু সালেক নামে এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে ৩৩টি মামলা করে দুদক। সেই সালেক হিসেবে দুদক কর্মকর্তারা চিহ্নিত করার পর জাহালমকে গ্রেপ্তার করা হয়।

গত ৩০ জানুয়ারি প্রথম আলোয় ‘স্যার, আমি জাহালম, সালেক না' শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনটি সেদিন বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহসান ও বিচারপতি কামরুল কাদেরের হাই কোর্ট বেঞ্চের নজরে আনেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অমিত দাশ গুপ্ত।

পরে আদালত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুল জারি করে। জাহালমের আটকাদেশ কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, জানতে চাওয়া হয় রুলে।

সেই সঙ্গে ‘ভুল আসামির’ কারাগারে থাকার ব্যাখ্যা জানতে দুদক চেয়ারম্যানের প্রতিনিধি, মামলার বাদী দুদক কর্মকর্তা, স্বরাষ্ট্র সচিবের প্রতিনিধি ও আইন সচিবের প্রতিনিধিকে তলব করে হাই কোর্ট।

রোববার সেই রুলের শুনানিতে হাই কোর্ট দুদকের প্রতি উষ্মা প্রকাশ করে রোববারই সোনালী ব্যাংকের ওই অর্থ জালিয়াতির মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়ে জাহালমকে মুক্তি দেওয়ার নির্দেশ দেন।

আদালত বলে, “কোনো নির্দোষ ব্যক্তিকে এক মিনিটও কারাগারে রাখার পক্ষে আমরা না। এই ভুল তদন্তে কোনো সিন্ডিকেট জড়িত কি না, সিন্ডিকেট থাকলে কারা এর সঙ্গে জড়িত, তা চিহ্নিত করে আদালতকে জানাতে হবে। না হলে আদালত এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে।”

আসামি না হয়েও জাহালমের তিন বছর কারাগারে থাকার ঘটনায় তদন্ত কর্মকর্তাদের গাফিলতি ছিল কি না, তা খতিয়ে দেখতে একটি কমিটি করেছে দুদক।

কমিশনের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেছেন, “জাহালমের ঘটনায় দুদকের তদন্তকারী কর্মকর্তাদের যদি কোনো গাফিলতি থেকে থাকে, তাহলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”