৭ খুন: খালাস চেয়ে আপিল ফাঁসির আসামি নুর হোসেন-তারেক সাঈদের

মৃত্যুদণ্ডাদেশ থেকে খালাস চেয়ে হাই কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছেন নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুন মামলার আসামি কাউন্সিলর নূর হোসেন ও র‍্যাব কর্মকর্তা তারেক সাঈদ মোহাম্মদ।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 March 2019, 04:28 PM
Updated : 3 March 2019, 04:32 PM

তাদের পাশাপাশি ফাঁসির আসামি র‌্যাবের সাবেক কর্মকর্তা আরিফ হোসেন ও মাসুদ রানাও সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় আপিল দায়ের করেছেন।

সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা নুর হোসেনের আইনজীবী এস আর এম লুৎফর রহমান আকন্দ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “হাই কোর্টের রায় বহাল থাকা মৃত্যুদণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিল দায়ের করা হয়েছে। শুনেছি আসামি তারেক সাঈদ, মাসুদ রানার পক্ষেও আপিল হয়েছে।”

আরিফের আইনজীবী এস এম শাহজাহান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, হাই কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছেন তার মক্তেল।

নারায়ণগঞ্জের কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম, আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজনকে খুনের মামলায় নূর হোসেন ও র‌্যাবের তৎকালীন তিন  কর্মকর্তাসহ ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রেখে রায় দিয়েছিল হাই কোর্ট।

তার আগে বিচারিক আদালতের রায়ে ২৬ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। তাদের মধ্যে ১১ জনের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় হাই কোর্ট। তাদের প্রত্যেককে আবার ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়; যা না দিলে আরও দুই বছরের সাজা ভোগ করতে হবে।

নিম্ন আদালতে নয়জনকে দেওয়া বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ডের রায়ের কোনো পরিবর্তন হয়নি হাই কোর্টের রায়ে।

আসামিদের করা আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের শুনানি শেষে বিচারপতি ভবানী প্রসাদ সিংহ ও বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলামের বেঞ্চ রেখে ২০১৭ সালের ২২ অগাস্ট এই রায় দেয়।

পরে গত বছরের ১৯ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে সাত খুনের ঘটনায় করা দুটি মামলার রায় আলাদাভাবে প্রকাশ করা হয়। একটি রায় ৭৮৩ পৃষ্ঠার; আরেকটি ৭৮১ পৃষ্ঠার।

সেদিন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেছিলেন, “বিধান অনুযায়ী কোনো ব্যক্তির ফাঁসি বা যাবজ্জীবন হলে তিনি যদি আপিল বিভাগে আপিল করেন, এজ অ্যা মেটার অব লাইফ শুনানির অধিকার তার আছে। সুতরাং আপিল ফাইল করলেই আপিল হিসেবে ট্রিট করা হবে এবং শুনানি হবে।”

দণ্ডিত তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, আরিফ হোসেন ও এম এম রানা

নারায়ণগঞ্জে ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল কাউন্সিলর নজরুলসহ পাঁচজনকে তুলে নেওয়ার সময় দেখে ফেলায় ধরে নেওয়া হয় আইনজীবী চন্দন ও তার গাড়িচালককে। পরে তাদের খুন করে লাশ ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছিল শীতলক্ষ্যা নদীতে।

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর নজরুলের সঙ্গে দ্বন্দ্বের জের ধরে আরেক কাউন্সিলর নুর হোসেন র‌্যাব-১১ এর কয়েকজন কর্মকর্তার মাধ্যমে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিলেন বলে তদন্তে উদ্ঘাটিত হয়।

রায়ের পর্যবেক্ষণ

ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ডাদেশের অনুমোদন) ও আসামিদের করা আপিলের উপর প্রকাশ্য আদালতে ঘোষিত রায়ের পর্যবেক্ষণে হাই কোর্ট বলেছিল, “আসামিরা যে ধরনের অপরাধ করেছে, যদি তারা ছাড়া পেয়ে যায়, তাহলে বিচার বিভাগের প্রতি জনগণ আস্থাহীনতায় ভুগবে।”

চার বছর আগেও এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা পুরো বাংলাদেশকে নাড়িয়ে দিয়েছিল; সরকারি বাহিনীর কর্মকর্তাদের ব্যবহার করে হত্যা্কাণ্ডের বিষয়টি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেরও শিরোনাম হয়েছিল।

হাই কোর্টে মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকা ১৫ আসামির মধ্যে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন ছিলেন সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি। পরে তাকে বহিষ্কার করা হয়।

সর্বোচ্চ সাজার আদেশ পাওয়া সামরিক বাহিনীর সাবেক তিন কর্মকর্তার মধ্যে লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ ওই হত্যাকাণ্ডের সময় র‌্যাব-১১ এর অধিনায়ক ছিলেন। তিনি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার জামাতা।

র‌্যাবের ক্যাম্প কমান্ডার আরিফ হোসেন ছিলেন সেনাবাহিনীর একজন মেজর। আর মাসুদ রানা ছিলেন নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট কমান্ডার।

মামলার ৩৫ আসামির মধ্যে ২৫ জনই ছিলেন সশস্ত্র ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তা ও সদস্য।

নূর হোসেনকে ওই হত্যাকাণ্ডের ‘মাস্টারমাইন্ড’ হিসেবে বর্ণনা করে হাই কোর্টের রায়ে বলা হয়, তার সঙ্গে তিন র‌্যাব কর্মকর্তার অবৈধ অর্থিক লেনদেন হয়েছিল।

রায়ের পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়, “কিছু উচ্ছৃঙ্খল র‌্যাব সদস্যের কারণে এ বাহিনীর গৌরবোজ্জ্বল অর্জন ম্লান হয়ে যেতে পারে না। তাদের সন্ত্রাসবিরোধী গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা ধূলিস্যাৎ হতে পারে না।

“কিন্তু এই বাহিনীর কতিপয় সদস্যের অপরাধবৃত্তি মানব সভ্যতায় আতঙ্কজনক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। তারা এতটাই পাশবিকতা দেখিয়েছে, যা ছিল নিষ্ঠুরতার সর্বোচ্চ প্রকাশ।”

হাই কোর্ট বলেছিল, “র‌্যাব রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলারক্ষাকারী বিশেষ বাহিনী। তাদের দায়িত্ব হল জনগণের জানমাল রক্ষা করা এবং নিরাপত্তা দেওয়া। কিন্তু এ বাহিনীর কিছু সদস্য নৃসংশ হত্যাকাণ্ডে জড়িয়ে পরে অপরাধ ঘটিয়েছে। ফলে তাদের বিচার হয়েছে।”

নিহত ৭ জন

র‌্যাব হেফাজতে সাতজনকে হত্যার বিষয়ে পর্যবেক্ষণে বলা হয়, “তাদের মৃত্যু যন্ত্রণা ছিল ‘ভয়াবহ, অচিন্তনীয়। র‌্যাব সদস্যরা এতটাই নির্দয় ছিল যে, হত্যার পর তাদের তলপেট ছুরি দিয়ে কেটে বস্তাবন্দি করে তার সঙ্গে ১০টি করে ইট বেঁধে দেওয়া হয়, যেন বস্তাবন্দি লাশ নদীর পানিতে তলিয়ে যায়।”

আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি থেকে উদ্ধৃত করে রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, “এই হত্যাকাণ্ড ছিল সুপরিকল্পিত ও ষড়যন্ত্রমূলক। তাদের নৃশংসতা প্রমাণ করে, মৃতদেহের উপরও তারা কতটা নির্দয় ছিল।”

র‌্যাবের কয়েকজন সদস্য অপরাধ করলেও নিরাপত্তা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে এ বাহিনীর ওপর দেশের মানুষের ‘যথেষ্ট আস্থা’ রয়েছে মন্তব্য করে রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, “কতিপয় সদস্যের কারণে সামগ্রিকভাবে গোটা বাহিনীকে দায়ী করা যায় না।”

১১ জনের সাজা কমানোর বিষয়ে পর্যবেক্ষণে বলা হয়, “অপরাধের ধরন বিবেচনায় নিয়ে তাদের মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে যাবজ্জীবন দেওয়া হয়েছে। অপরাধের সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতা হয়েছে। কিন্তু তারা যে অপরাধ করেছে, তাতে যাজজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়াই যুক্তিযুক্ত। মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলে তা হত কঠোর শাস্তি।”

সাত খুনের ঘটনাক্রম

২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল দুপুরে নারায়ণগঞ্জ আদালতে একটি মামলায় হাজিরা দিয়ে ঢাকার ফেরার পথে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের ফতুল্লার লামাপাড়া থেকে অপহরণ করা হয় সিটি করপোরেশনের তৎকালীন প্যানেল মেয়র ও ২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম, তার বন্ধু সিরাজুল ইসলাম লিটন, সহযোগী মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, স্বপনের গাড়ি চালক জাহাঙ্গীরকে।

ওই ঘটনা দেখে ফেলায় নজরুলের গাড়ির পেছনে থাকা আইনজীবী চন্দন সরকার ও তার গাড়িচালক ইব্রাহিমও অপহৃত হন।

তিন দিন পর শীতলক্ষ্যা নদীতে মেলে ছয়জনের লাশ। ১ মে নজরুলের বন্ধু সিরাজুল ইসলাম লিটনের লাশও নদীতে ভেসে ওঠে।

লাশগুলো উদ্ধার করা হয়েছিল শীতলক্ষ্যা নদীতে

লাশ উদ্ধারের পর নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি এবং চন্দন সরকারের জামাতা বিজয় কুমার পাল দুটি মামলা করেন, যার তদন্ত চলে একসঙ্গে।

দুই মামলার তদন্ত শেষে নারায়ণগঞ্জের সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন ও র‌্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তাসহ ৩৫ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেন তদন্ত কর্মকর্তা মামুনুর রশিদ মণ্ডল।

আসামিদের মধ‌্যে র‌্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তাসহ ১৭ জন এবং নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের তৎকালীন ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নূর হোসেনের পাঁচ সহযোগীকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয় পুলিশ। ঘটনার ১৭ মাস পর মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেনকে ভারত থেকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়।

আসামিদের মধ‌্যে ২১ জন ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। তদন্ত চলাকালে নূর হোসেন ভারতে থাকায় তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের সুযোগ পায়নি পুলিশ। 

গ্রেপ্তার র‌্যাব সদস্য আদালতে যে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন, তাতে হত‌্যাকাণ্ডের ভয়ঙ্কর বিবরণ উঠে আসে। তারা জানান, অপহরণের পর সাতজনকে চেতনানাশক ইনজেকশন দিয়ে অচেতন করা হয়। পরে মুখে পলিথিন পেঁচিয়ে হত্যা করা হয় শ্বাস রোধ করে।

লাশগুলো শীতলক্ষ্যায় ফেলে দেওয়ার সময় ডুবে যাওয়া নিশ্চিত করতে বেঁধে দেওয়া হয় ইটের বস্তা। আর লাশ যাতে ফুলে না ওঠে সেজনন্য চিরে ফেলা হয় লাশ।

জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত হোসেন ২০১৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি অভিযোগ গঠনের মধ‌্য দিয়ে এ মামলার আসামিদের বিচার শুরু করেন।

পরের বছরের ১৬ জানুয়ারি তিনি যে রায় দেন, তাতে নূর হোসেন ও সাবেক তিন র‌্যাব কর্মকর্তাসহ ২৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং নয়জনকে বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্য থেকে যারা কারাগারে আছেন তারা হাই কোর্টে ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন। এছাড়া নিম্ন আদালতের মৃত্যুদণ্ডের রায় অনুমোদনের জন্য ডেথ রেফারেন্স আকারে নথি আসে হাই কোর্টে। ৩৩ কার্য দিবস শুনানির পরই রায় দেয় হাই কোর্ট।