সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালের এয়ার অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে ঢাকায় আসা তিনজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রোববার রাতে ওবায়দুল কাদেরের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন।
পরে তাদের সঙ্গে আলোচনা করে সংবাদ মাধ্যমের সামনে সিদ্ধান্ত জানান বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের উপাচার্য কনক কান্তি বড়ুয়া।
তিনি বলেন, “সকাল এবং দুপুরের চেয়ে এখনকার অবস্থার উন্নতি হয়েছে। উনি চোখ খুলে তাকান, উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেন। উনাকে জিজ্ঞাসা করা হল পানি খাবেন কি না, উনি মাথা নেড়ে উত্তর দিয়েছেন এবং হাত পা নাড়ছেন। উনার প্রস্রাবও হচ্ছে। দুপুরের দিকে প্রস্রাব একেবারে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এখন প্রস্রাব হচ্ছে। ব্লাড প্রেশার অনেকটা স্টেবল হয়েছে।
“উনার অবস্থার উন্নতির ধারা যেহেতু অব্যাহত হয়েছে, সেহেতু সিঙ্গাপুরের টিমের সাথে আলোচনা করে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আপাতত উনি এখানেই থাকবেন। পরবর্তীতে অবস্থার ওপর নির্ভর করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।”
মেডিকেল বোর্ডের প্রধান বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের কার্ডিওলজির অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান বিকালে এক ব্রিফিংয়ে বলেন, কাদেরের তিনটি রক্তনালীতে ব্লক ধরা পড়েছে, যার একটি স্টেন্টিংয়ের মাধ্যমে তারা অপসারণ করেছেন।
“উনি এখন হেমোডাইনামিক্যালি স্টেবল আছেন।… এই স্টেবিলিটি যদি কিছুক্ষণ থাকে, তাহলে আমাদের সিদ্ধান্ত দুটো হবে। আমরা মেডিকেল থেরাপি দিতে পারি অথবা ব্লকড থাকা অন্য নালীগুলো খুলে দিতে বাইপাস করতে পারি।”
তবে সেই সিদ্ধান্ত নিতে ২৪ থেকে ৭২ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে মন্তব্য করে অধ্যাপক আলী আহসান বলেন, “এখনও উনি ক্রিটিক্যাল অবস্থায় আছেন।”
তবে সিঙ্গাপুর থেকে যে এয়ার অ্যাম্বুলেন্স এবং চিকিৎসকরা এসেছেন, তাদের সোমবার সকাল ১০টা পর্যন্ত ঢাকাতেই রাখা হচ্ছে বলে জানান সেলিম।
ওবায়দুল কাদের ২০১৬ সালের ২৩ অক্টোবরে আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তার আগে ২০১১ সালের শেষ দিকে তাকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেন প্রধানমন্ত্রী।
তখন থেকেই ওই মন্ত্রণালয়ের দেখভাল করছেন ওবায়দুল কাদের। বর্তমানে এ মন্ত্রণালয়ের নাম সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়।
আওয়ায়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রোববার ভোরের দিকে ‘হার্ট অ্যাটাক’ হলে ওবায়দুল কাদেরের শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। দ্রুত তাকে বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের কার্ডিওলজি বিভাগে নিয়ে যান তার স্ত্রী ইশরাতুন্নেসা কাদের। খবর পেয়ে আওয়ামী লীগ নেতারাও সকালে হাসপাতালে ছুটে যান।
হাসপাতালে আনার পর প্রথমে কাদেরের ইসিজি করা হয়। রক্তচাপ কিছুটা স্থিতিশীল হলে করা হয় এনজিওগ্রাম। তাতে তিনটি আর্টারিতে ব্লক ধরা পড়ে। এর মধ্যে একটি অপসারণ করা হয়।
তারপর কয়েক ঘণ্টায় অবস্থার কিছুটা উন্নতি দেখা গেলে কাদেরকে দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা। আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ তাকে সিঙ্গাপুর জেনারেল হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনার কথা বলেন। সে অনুযায়ী প্রস্তুতি নিতে বাসায় ফিরে যান কাদেরের স্ত্রী ইশরাতুন্নেসা।
কিন্তু দুপুরের দিকে নতুন করে কিছু জটিলতা দেখা দেয়, পরিস্থিতি ওঠানামা করতে থাকলে বিদেশে নেওয়ার বিষয়টি অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে।
এরইমধ্যে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে এসে সিসিইউতে থাকা ওবায়দুল কাদেরকে দেখে যান।
কাদের হাসপাতালে ভার্তি হওয়ার ১০ ঘণ্টার মাথায় পরিস্থিতি জানাতে বিকালে বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের ডা. মিল্টন হলে ব্রিফিংয়ে আসেন চিকিৎসকরা।
অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসানের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের উপাচার্য কনক কান্তি বড়ুয়া এবং কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক অসিত বরণ অধিকারী ব্রিফিংয়ে উপস্থিত ছিলেন।
কাদেরের ঠিক কী ঘটেছিল, তার চিকিৎসায় কী কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, ভবিষ্যতে কী করণীয় সেসব বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করা হয় ওই ব্রিফিংয়ে।
ডা. সৈয়দ আলী আহসান বলেন, ওবায়দুল কাদেরের ‘হার্ট অ্যাটাক’ হয় রাত ৩টার দিকে। ভোরে তাকে হাসপাতালে এনে সিসিইউতে রাখা হয়।
“আমি যখন কল পাই তখন সকাল ৮টা। তখন উনার ইসিজি চলছিল। ইসিজিতে দেখা গেল তেমন কোনো চেইঞ্জ নাই। কিন্তু ইসিজি করতে করতে দেখা গেল উনার হার্ট ধীরে ধীরে স্লো হয়ে যাচ্ছে। উনি আর শ্বাস নিতে পারছিলেন না।
“তার মানে আমি বুঝলাম কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়েছে। তখন উনাকে ভেন্টিলেশনে নিয়ে উনার হার্টটা আবার চালু করা হয়। যা যা ওষুধ দেওয়ার ওগুলো আমরা দিয়েছি। তারপর উনাকে আমরা এনজিওগ্রাম করি। এনজিওগ্রামে দেখা গেলো উনার তিনটা আর্টারি ব্লকড।”
সৈয়দ আলী আহসান বলেন, তারা তখন এলএডি খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কাজটি করা হয় স্টেন্টিংয়ের মাধ্যমে, যাকে সাধারণ ভাষায় রিং পড়ানো বলা হয়।
“ওই নালীটা খোলার পর ঘণ্টা দুয়েক উনি খুব ভালো ছিলেন। তারপর দেখা গেল প্রেসার কিছুটা কমে যাচ্ছে। অনেক রকম প্রবলেম দেখা দিল।”
ওই অবস্থায় চিকিৎসকরা নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে কৃত্রিমভাবে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের সিদ্ধান্ত নেন। তা করার পর কাদেরের রক্তচাপ কিছুটা স্থিতিশীল হয়।
“উনি এখন হেমোডাইনামিক্যালি স্টেবল আছেন। চোখ খুলছেন। কথা বলছেন। কিন্তু ক্রিটিক্যাল স্টেজই বলব এখনও।”
বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের উপাচার্য কনক কান্তি বড়ুয়া এক প্রশ্নের জবাবে ব্রিফিংয়ে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিসিইউতে দেখতে এসে নাম ধরে ডাকলে কাদের চোখ মিটমিট করছিলেন।
পরে রাষ্ট্রপতি যখন ডাকলেন চোখ মেলে তাকান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মো. নাসিম যখন দেখতে গিয়েছিলেন, তখনও চোখ মেলেছিলেন কাদের।
অধ্যাপক অসিত বরণ ব্রিফিংয়ে বলেন, “উইথ হাই সাপোর্ট… উনি স্টেডিলি ইমপ্রুভ করছেন। কিন্তু আমরা এখনও শতভাগ বলতে পারব না যে উনি আউট অব ডেঞ্জার।
“এখনও ইমপ্রুভ করছে, এর গতিটা যদি থাকে আরও ১০-১২ ঘণ্টা, তাহলে আমরা ধরে নেব আমরা বোধ হয় বিপদমুক্ত হতে যাচ্ছি। আর সুস্থ হয়ে বাড়ি গেলে বলব, উনি ভালো হয়ে গেলেন।”
এই অবস্থায় কাদেরকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেওয়া সম্ভব কি না তা জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের কার্ডিওলজি বিভাগের প্রধান সে সময় বলেন, বিষয়টি নির্ভর করবে যে হাসপাতালের এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে নেওয়া হবে তাদের ব্যবস্থাপনার ওপর।
পথে কোনো জটিলতা দেখা দিলে তা সামাল দেওয়ার ব্যবস্থা যদি এয়ার অ্যাম্বুলেসে থাকে, দক্ষ চিকিৎসক ও কর্মী যদি সেখানে থাকে, কেবল তখনই কাদেরকে বিদেশে নেওয়ার অনুমতি দেবেন তারা।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের অসুস্থতার খবরে সকালেই বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের ডি ব্লকের নিচে সংবাদকর্মী ও দলের নেতাকর্মীদের ভিড় জমে যায়।
অনেকেই দোতলায় কার্ডিওলজি বিভাগের করোনারি কেয়ার ইউনিটের দড়জার সামনে যাওয়ার চেষ্টা করেন, যেখানে ভর্তি আছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী কাদের।
চিকিৎসকরা বার বার ভিড় কমানোর চেষ্টা করলেও লাভ হয়নি। তাদের মধ্যে কেউ বা আওয়ামী লীগের কোনো জ্যেষ্ঠ নেতাকে ভবনের সামনে দেখা গেলেই সাংবাদিকরা তাকে ঘিরে ধরে ওবায়দুল কাদেরের অবস্থা জানতে চাইছিলেন।
বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের উপাচার্য কনক কান্তি বড়ুয়া বিকালে ব্রিফিংয়ে এসে বলেন, আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের স্বাস্থ্য পরিস্থিতি নিয়ে যে সবাই উদ্বিগ্ন তা তারা এই ভিড় দেখেই বুঝতে পারছেন। কিন্তু এতে তাদের কাজের যেমন বিঘ্ন ঘটছে, ওবায়দুল কাদের এবং হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অন্য রোগীদের জন্যও ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।
“অনেক ধরনের জটিলতা হয়। সেই জটিলতা থেকে মুক্ত থাকার জন্য আমাদেরকে নিরিবিলি চিকিৎসা সেবা দেওয়ার পরিবেশ করে দিতে হবে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সেটা আপনারাই পারেন।
“মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদের স্ট্রিক্টলি বলেছেন, ‘যদি আমিও আসি, আমাকেও ঢুকতে দিও না।’… আমরা একটা বই রেখেছি ডি ব্লকের নিচে। যাতে নেতৃবৃন্দ আসেন, সেখানে উনাদের নামটা লিখে দিয়ে যাবেন। কিন্তু আমরা পারছি না। শত শত লোক গিয়ে ওখানে দরজার উপরে হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন। তাতে উনার (কাদের) শারীরিক জটিলতাটাই বাড়বে।”
এরপর সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহমান ডি-ব্লকের নিচে নেতাকর্মীদের বলেন, চিকিৎসকদের মনোযোগ নষ্ট হয়- এমন কিছু যেন তারা না করেন।
“আমাদের প্রিয় নেতা মুমূর্ষু অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।… দয়া করে আপনারা হাসপাতালের ভেতরে কেউ প্রবেশ করবেন না। যারা চিকিৎসার সাথে সম্পৃক্ত তাদের সহযোগিতা করবেন সবাই।”
এরপরও আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা ভিড় করে ছিলেন হাসপাতাল প্রাঙ্গণে। রাতে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়ার হস্তক্ষেপে জটলা কমে।
জটলার কারণে সাধারণ মানুষের যেন চিকিৎসা নিতে কোনো সমস্যা না হয়, সেজন্য কমিশনার নিজে এসে হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজনের ভিড় কমান, বলেন সেখানে থাকা পুলিশ সদস্য ছরোয়ার ই দ্বীন।
রাত পৌনে ১০টার দিকে পুলিশ যখন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সরিয়ে দিচ্ছিল, তখন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরহ তিন নেতা অসুস্থ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদককে দেখতে হাসপাতালে ঢোকেন।