সাড়া দিয়ে চোখ মেললেও ‘শঙ্কা কাটেনি’ কাদেরের

হৃদরোগে আক্রান্ত আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের অবস্থার সামান্য উন্নতি হওয়ায় ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি চোখ মেলতে পারছেন, তবে এখনও তার অবস্থা শঙ্কামুক্ত নয় বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।    

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 March 2019, 12:06 PM
Updated : 3 March 2019, 05:04 PM

সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী কাদের গুরুতর অসুস্থ হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের করোনারি কেয়ার ইউনিটে ভর্তি হওয়ার দশ ঘণ্টা পর রোববার বিকালে চিকিৎসকদের পক্ষ থেকে এক ব্রিফিংয়ে এ কথা জানানো হয়।   

তার চিকিৎসার জন্য গঠিত মেডিকেল বোর্ডের প্রধান বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের কার্ডিওলজির অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান বলেন, কাদেরের তিনটি রক্তনালীতে ব্লক ধরা পড়েছে, যার একটি স্টেন্টিংয়ের মাধ্যমে তারা অপসারণ করেছেন।

“উনি এখন হেমোডাইনামিক্যালি স্টেবল আছেন। চোখ খুলছেন। কথা বলছেন। কিন্তু ক্রিটিক্যাল স্টেজই বলব এখন। উনি পা নাড়াচ্ছেন, চেষ্টা করছেন কথা-বার্তা বলার।

“আমরা আরও কিছুক্ষণ দেখব। হেমোডাইনামিক্যালি স্টেবিলিটি যদি কিছুক্ষণ থাকে, তাহলে আমাদের সিদ্ধান্ত দুটো হবে। আমরা মেডিকেল থেরাপি দিতে পারি অথবা ব্লকড থাকা অন্য নালীগুলো খুলে দিতে বাইপাস করতে পারি।”

তবে সেই সিদ্ধান্ত নিতে ২৪ থেকে ৭২ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে মন্তব্য করে অধ্যাপক আলী আহসান বলেন, “এখনও উনি ক্রিটিক্যাল অবস্থায় আছেন।”

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের

এই পরিস্থিতিতে কাদেরকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে নেওয়া সম্ভব কি না জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের কার্ডিওলজি বিভাগের প্রধান বলেন, বিষয়টি নির্ভর করবে যে হাসপাতালের এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে নেওয়া হবে তাদের ব্যবস্থাপনার ওপর। 

পথে কোনো জটিলতা দেখা দিলে তা সামাল দেওয়ার ব্যবস্থা যদি এয়ার অ্যাম্বুলেসে থাকে, দক্ষ চিকিৎসক ও কর্মী যদি সেখানে থাকে, কেবল তখনই কাদেরকে বিদেশে নেওয়ার অনুমতি দেবেন তারা। 

আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রোববার ভোরের আগে ৬৭ বছর বয়সী ওবায়দুল কাদেরের শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। অবস্থার দ্রুত অবনতি হতে থাকলে তাকে বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের কার্ডিওলজি বিভাগে নিয়ে আসেন তার স্ত্রী ইশরাতুন্নেসা কাদের। খবর পেয়ে আওয়ামী লীগ নেতারাও সকালে হাসপাতালে ছুটে আসেন।       

হাসপাতালে আনার পর প্রথমে কাদেরের ইসিজি করা হয়। রক্তচাপ কিছুটা স্থিতিশীল হলে করা হয় এনজিওগ্রাম। তাতে তিনটি আর্টারিতে ব্লক ধরা পড়ে। এর মধ্যে একটি অপসারণ করা হয়।

তারপর কয়েক ঘণ্টায় অবস্থার কিছুটা উন্নতি দেখা গেলে কাদেরকে দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা। আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ তাকে সিঙ্গাপুর জেনারেল হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনার কথা বলেন। সে অনুযায়ী প্রস্তুতি নিতে বাসায় ফিরে যান কাদেরের স্ত্রী ইশরাতুন্নেসা।

কিন্তু দুপুরের দিকে নতুন করে কিছু জটিলতা দেখা দেয়, পরিস্থিতি ওঠানামা করতে থাকলে বিদেশে নেওয়ার বিষয়টি অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে।

এরইমধ্যে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে এসে সিসিইউতে থাকা ওবায়দুল কাদেরকে দেখে যান।

পরে কাদেরের সর্বশেষ পরিস্থিতি জানাতে বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের ডা. মিল্টন হলে ব্রিফিংয়ে আসেন চিকিৎসকরা। অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসানের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের উপাচার্য কনক কান্তি বড়ুয়া এবং কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক অসিত বরণ অধিকারী ব্রিফিংয়ে উপস্থিত ছিলেন। 

ব্রিফিংয়ে বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের চিকিৎসরা

ভোরে ‘হার্ট অ্যাটাক’

ওবায়দুল কাদের ২০১৬ সালের ২৩ অক্টোবরে আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তার আগে ২০১১ সালের শেষ দিকে তাকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেন প্রধানমন্ত্রী।     

তখন থেকেই ওই মন্ত্রণালয়ের দেখভাল করছেন ওবায়দুল কাদের। বর্তমানে এ মন্ত্রণালয়ের নাম সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়।

কাদেরের ঠিক কী ঘটেছিল, তার চিকিৎসায় কী কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে- সেসব বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করা হয় চিকিৎসকদের ব্রিফিংয়ে।

ডা. সৈয়দ আলী আহসান বলেন, ওবায়দুল কাদেরের ‘হার্ট অ্যাটাক’ হয় রাত ৩টার দিকে। ভোরে তাকে হাসপাতালে এনে সিসিইউতে রাখা হয়।

“আমি যখন কল পাই তখন সকাল ৮টা। তখন উনার ইসিজি চলছিল। ইসিজিতে দেখা গেল তেমন কোনো চেইঞ্জ নাই। কিন্তু ইসিজি করতে করতে দেখা গেল উনার হার্ট ধীরে ধীরে স্লো হয়ে যাচ্ছে। উনি আর শ্বাস নিতে পারছিলেন না।

“তার মানে আমি বুঝলাম কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়েছে। তখন উনাকে ভেন্টিলেশনে নিয়ে উনার হার্টটা আবার চালু করা হয়। যা যা ওষুধ দেওয়ার ওগুলো আমরা দিয়েছি। তারপর উনাকে আমরা এনজিওগ্রাম করি। এনজিওগ্রামে দেখা গেলো উনার তিনটা আর্টারি ব্লকড।”

এই চিকিৎসক জানান, ওবায়দুল কাদেরের ডায়াবেটিস সে সময় নিয়ন্ত্রণে ছিল না। তিনটি রক্তনালীর মধ্যে একটি আগে এক সময় হার্ট অ্যাটাকে ১০০ শতাংশ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বাকি দুটি রক্তনালীর মধ্যে একটি ৮০ শতাংশ বন্ধ। আর এলএডি (লেফট এন্টেরিয়র ডিসেন্ডিং) নামের যে আর্টারি হার্টের দুই তৃতীয়াংশে রক্ত সরবরাহ করে, তার ৯৯ শতাংশ ছিল বন্ধ।

সৈয়দ আলী আহসান বলেন, তারা তখন এলএডি খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কাজটি করা হয়  স্টেন্টিংয়ের মাধ্যমে, যাকে সাধারণ ভাষায় রিং পড়ানো বলা হয়।

“ওই নালীটা খোলার পর ঘণ্টা দুয়েক উনি খুব ভালো ছিলেন। তারপর দেখা গেল প্রেসার কিছুটা কমে যাচ্ছে। অনেক রকম প্রবলেম দেখা দিল।”

ওই অবস্থায় চিকিৎসকরা নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে কৃত্রিমভাবে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের সিদ্ধান্ত নেন। তা করার পর কাদেরের রক্তচাপ কিছুটা স্থিতিশীল হয়। 

সাড়া দিয়েছেন কাদের

বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের উপাচার্য কনক কান্তি বড়ুয়া এক প্রশ্নের জবাবে ব্রিফিংয়ে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিসিইউতে দেখতে এসে নাম ধরে ডাকলে কাদের চোখ মিটমিট করছিলেন।

পরে রাষ্ট্রপতি যখন ডাকলেন চোখ মেলে তাকান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মো. নাসিম যখন দেখতে গিয়েছিলেন, তখনও চোখ মেলেছিলেন কাদের।

অধ্যাপক অসিত বরণ অধিকারী ব্রিফিংয়ে বলেন, “উইথ হাই সাপোর্ট… উনি স্টেডিলি ইমপ্রুভ করছেন। কিন্তু আমরা এখনও শতভাগ বলতে পারব না যে উনি আউট অব ডেঞ্জার।

“এখনও ইমপ্রুভ করছে, এর গতিটা যদি থাকে আরও ১০-১২ ঘণ্টা, তাহলে আমরা ধরে নেব আমরা বোধ হয় বিপদমুক্ত হতে যাচ্ছি। আর সুস্থ হয়ে বাড়ি গেলে বলব, উনি ভালো হয়ে গেলেন।”