মিয়ানমারের নিষ্ক্রিয়তায় জাতিসংঘে প্রধানমন্ত্রীর হতাশা

বিশ্বকে নাড়িয়ে দেওয়া রোহিঙ্গা সঙ্কটের শান্তিপূর্ণ সমাধানে মিয়ানমার সরকারের নিষ্ক্রিয়তার কথা জাতিসংঘে তুলে ধরে এক বছরেও প্রত্যাবাসন শুরু না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

সুমন মাহবুব নিউ ইয়র্ক থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 Sept 2018, 11:28 PM
Updated : 27 Sept 2018, 11:28 PM

এ বিষয়ে মিয়ানমারের উপর চাপ প্রয়োগের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি বলেছেন, রোহিঙ্গা সমস্যার উদ্ভব হয়েছে মিয়ানমারে, তাই এর সমাধান সেখানেই হতে হবে।

“জাতিসংঘের সঙ্গে মিয়ানমারের যে চুক্তি হয়েছে- আমরা তার আশু বাস্তবায়ন ও কার্যকারিতা দেখতে চাই। আমরা দ্রুত রোহিঙ্গা সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান চাই।”

বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের নেতা হিসেবে বৃহস্পতিবার নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৩তম অধিবেশনে দাঁড়িয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “আমরা আশাহত হয়েছি, কেননা আমাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও আজ পর্যন্ত মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের স্থায়ী ও টেকসই প্রত্যাবাসন শুরু করা সম্ভব হয়নি।”

সরকার ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আন্তরিক চেষ্টার পরও বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে থাকা ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা কতটা মানবেতর জীবনযাপন করছে, সেই চিত্র প্রধানমন্ত্রী ১৯৩ দেশের এই বিশ্বসভায় তুলে ধরেন।

রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার মধ্যে একাধিক চুক্তি হয়েছে, সে অনুযায়ী বাংলাদেশ সব প্রস্তুতিও নিয়েছে। কিন্তু তারপরও মিয়ানমার যে নানা কৌশলে প্রত্যাবাসন বিলম্বিত করছে- সে বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘে বলেন।

তিনি বলেন, “মিয়ানমার মৌখিকভাবে সব সময়ই রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবে বলে অঙ্গীকার করলেও বাস্তবে তারা কোনো কার্যকর ভূমিকা নিচ্ছে না।”

মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের উপর জাতিগত নিপীড়ন চলে আসছে কয়েক দশক ধরে। বিভিন্ন সময়ে সহিংসতার মুখে সেখান থেকে পালিয়ে এসে পাঁচ লাখের বেশি মানুষ বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে আছে। তাদের ফিরিয়ে নিতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বার বার আহ্বান জানানো হলেও মিয়ানমার সাড়া দেয়নি।

২০১৭ সালের ২৫ অগাস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে কয়েকটি পুলিশ পোস্ট ও একটি সেনা ঘাঁটিতে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের হামলার পর সেখানে নতুন করে সেনা অভিযান শুরু হয়।

এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ সীমান্তে নতুন করে রোহিঙ্গাদের ঢল নামে। জাতিসংঘের হিসাবে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা গত এক বছরে বাংলাদেশে এসেছে।

 

ব্যাস্তচ্যুত এই রোহিঙ্গাদের মানবিক কারণে বাংলাদেশে আশ্রয় দেওয়ার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা জাতিসংঘে তার ভাষণে বলেন, “একজন মানুষ হিসেবে রোহিঙ্গাদের দুঃখ-দুর্দশাকে আমরা যেমন অগ্রাহ্য করতে পারি না, তেমনি পারি না নিশ্চুপ থাকতে।”

গতবছর এই শরণার্থী সঙ্কট শুরুর পরপরই নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন বসায় সেখানে এ সমস্যার স্থায়ী ও শান্তিপূর্ণ সমাধানে পাঁচ-দফা প্রস্তাব তুলে ধরেছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।

সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, মিয়ানমার প্রতিবেশী দেশ হওয়ায় প্রথম থেকেই তিনি আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ সমাধানের চেষ্টা চালিয়ে আসছেন। কিন্তু পরিস্থিতির দৃশ্যমান কোনো পরিবর্তন হয়নি।  

বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া মিয়নমারের এই নাগরিকদের মৌলিক চাহিদা পূরণের চেষ্টার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমরা সাধ্যমত তাদের জন্য খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা, নিরাপত্তা, শিশুদের যত্নের ব্যবস্থা করেছি।”

এই কাজে জাতিসংঘ, কমনওয়েলথ, ওআইসিসহ বিভিন্ন সংস্থা ও দেশ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ায় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন শেখ হাসিনা।

তিনি বলেন, রোহিঙ্গারা যতদিন তাদের দেশে ফেরত যেতে না পারছে, ততদিন তাদের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সকল ধরনের সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা রেখে নতুন আবাসন নির্মাণের কাজে সরকার হাত দিয়েছে।

“আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে এ কাজে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। একইসঙ্গে রোহিঙ্গারা যাতে সেখানে যেতে পারেন তার জন্যও আমি আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহযোগিতা চাচ্ছি।”

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর প্রায় ছয় বছর শেখ হাসিনাকে যে দেশের বাইরে নির্বাসিত জীবন কাটাতে হয়েছিল, সে কথা বক্তৃতায় স্মরণ করেন। আর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের মধ্যে বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি মানুষকে শরণার্থী হিসেবে ভারতে আশ্রয় নিতে হয়েছিল, সে কথাও বলেন।

রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সরকারি বাহিনীর নির্যাতনের প্রসঙ্গ টেনে শেখ হাসিনা বলেন, “গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের যে বিবরণ জাতিসংঘের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, তাতে আমরা হতভম্ব। আমরা আশা করি, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিশেষ করে জাতিসংঘ রোহিঙ্গাদের উপর ঘটে যাওয়া অত্যাচার ও অবিচারের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখবে।”

সন্ত্রাসবাদসহ সকল সংঘবদ্ধ অপরাধের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের অবস্থানের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “বাংলাদেশের ভূখণ্ডে প্রতিবেশী দেশগুলোর স্বার্থবিরোধী কোনো কার্যক্রম বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড আমরা পরিচালিত হতে দেব না। সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় আমাদের জিরো টলারেন্স নীতি অব্যাহত থাকবে।”

সহিংস উগ্রবাদ, মানবপাচার ও মাদক প্রতিরোধে বাংলাদেশের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষকে সম্পৃক্ত করার নীতি যে বিশেষ সুফল দিয়েছে, সে কথাও জাতিসংঘ অধিবেশনে তিনি জানান।

শেখ হাসিনা বলেন, জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীর কার্যক্রমে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা পেশাদারিত্ব, সাহস ও সাফল্যের জন্য প্রশংসিত হয়েছেন। বাংলাদেশ গত ত্রিশ বছরে ৫৪টি শান্তি মিশনে এক লাখ আটান্ন হাজার ৬১০ জন শান্তিরক্ষী পাঠিয়ে বিশ্ব শান্তি রক্ষায় বিশেষ অবদান রেখেছে। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বাংলাদেশের ১৪৫ জন শান্তিরক্ষী জীবন দিয়েছেন।

ফিলিস্তিনিদের স্বাধীন আবাসভূমির দাবির বিষয়টিও প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে উঠে আসে। তিনি ফিলিস্তিন সমস্যার আশু নিষ্পত্তির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।

শেখ হাসিনা বলেন, “ভ্রাতৃপ্রতীম ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন আজও অব্যাহত রয়েছে যা আমাদের মর্মাহত করে।”

ওআইসির পররাষ্ট্র মন্ত্রীদের কাউন্সিলের সভাপতি হিসাবে বাংলাদেশ এ সংস্থার মাধ্যমে ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধানে কাজ করে যাবে বলে প্রতিশ্রুতি দেন তিনি। 

শেখ হাসিনা বলেন, “মানব সভ্যতার অগ্রগতিতে তিনটি মৌলিক উপাদান বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে, তা হল - শান্তি, মানবতা ও উন্নয়ন। তাই মানব সমাজের কল্যাণে আমাদের মানবতার পক্ষে সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে হবে।”

‘সমস্যা-সঙ্কুল’ পৃথিবীতে সকলের সম্মিলিত স্বার্থ, সমন্বিত দায়িত্ব ও অংশীদারিত্বই মানব সভ্যতাকে রক্ষা করতে পারে বলে মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী।

বাংলাদেশের জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনে তার সরকার ‘নিঃস্বার্থভাবে’ কাজ করে যাচ্ছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “গত সাড়ে নয় বছরে আর্থ-সামাজিক বিভিন্ন খাতে বাংলাদেশ বিস্ময়কর সাফল্য অর্জন করেছে। যে বাংলাদেশকে বলা হত দুর্যোগ, বন্যা-খরা-হাড্ডিসার মানুষের দেশ, তা এখন বিশ্বশান্তি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, নারীর ক্ষমতায়ন ওউন্নয়নের ক্ষেত্রে বিশ্বে চমক সৃষ্টি করেছে।”

উন্নয়নের এই পথ ধরে বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উত্তরণের যাত্রা এবং বিশ্বে ‘উন্নয়নের রোল মডেল’ হিসেবে প্রসংশিত হওয়ার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “আমাদের পথচলা এখনও শেষ হয়নি। এ পথচলা ততদিন চলবে, যতদিন না আমরা আমাদের জাতিরপিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষুধা, দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা এবং শোষণমুক্ত সোনার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে পারব।”

কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব যে বাংলাদেশকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দিয়েছে, বাংলাদেশ যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মুখে থাকা দশটি দেশের একটি, সে কথাও বিশ্ব নেতাদের মনে করিয়ে দেন তিনি।

জাতিসংঘের ৭৩ বছরের ইতিহাসে চতুর্থ নারী হিসেবে সাধারণপরিষদের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ায় মারিয়া ফের্নান্দা এসপিনোসা গার্সেসকে বক্তব্যের শুরুতেই অভিনন্দন জানান প্রধানমন্ত্রী।

তিনি বলেন, “জাতিসংঘের প্রতি আপনার অঙ্গীকার সুরক্ষায় আপনার যে কোনো প্রচেষ্টায় আমার প্রতিনিধিদলের পক্ষ থেকে থাকবে অকুণ্ঠ সহযোগিতা।” 

বিশ্ব শান্তি, নিরাপত্তা ও টেকসই উন্নয়ন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ‘সাহসী ও দৃঢ় নেতৃত্বের’ জন্য জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসকেও অভিনন্দন জানান শেখ হাসিনা।