প্রধানমন্ত্রীর কাছে ঠিক খবরটি যায় না: অধ্যাপক কামাল

কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন নিয়ে ‘সঠিক’ খবরটি প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছনো হচ্ছে না বলে দাবি করেছেন অধ্যাপক আহমেদ কামাল।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 July 2018, 02:19 PM
Updated : 19 July 2018, 07:22 PM

আন্দোলনকারীদের উপর নিপীড়নের প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার শিক্ষকদের মধ্য থেকে আয়োজিত এক সংহতি সমাবেশে বক্তব্যে এই দাবি করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের এই অধ্যাপক।

প্রখর রোদের মধ্যে অসুস্থতা নিয়েও এই কর্মসূচিতে যোগ দিয়ে অধ্যাপক কামাল বলেন, “প্রধানমন্ত্রীর আশেপাশে যারা থাকে, তারা তাকে প্রকৃত খবর পৌঁছে দেন না। খবর যদি রাষ্ট্রপ্রধান পেত, তাহলে বঙ্গবন্ধু কি সপরিবারে নিহত হত? খবর যদি রাষ্ট্রপ্রধানরা পেতই, তাহলে জিয়াউর রহমান কি নিহত হত?”

সরকারি চাকরিতে কোটা ৫৬ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনার দাবিতে ‘বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’ ব্যানারে গত কয়েক মাস ধরে আন্দোলন করছে। আন্দোলনের নানা পর্যায়ে তাদের উপর হামলার ঘটনাও ঘটছে। 

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন নেতা বলে আসছেন, আন্দোলনকারীরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধীদের ইন্ধনে দেশে অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা করছে।

শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা, মামলা এবং শিক্ষক লাঞ্ছনার বিচারসহ বিভিন্ন দাবিতে বুধবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনে মানববন্ধন করে নিপীড়নবিরোধী শিক্ষকবৃন্দ।

অধ্যাপক আহমেদ কামাল বলেন, “এই আন্দোলন নিয়ে একটাই সরকারি পদ্ধতি; আন্দোলনকে একটা ‘নাম দেওয়া’, যে নাম দিয়ে আন্দোলনকে দমন করা যায়। গত কয়েক বছরে এই ট্যাকটিসটা খুব পুরনো হয়ে গেছে। এই শব্দটা এখন আর খায় না লোকে।”

প্রবীণ এই অধ্যাপক শিক্ষার্থীদের ‘ন্যায়সঙ্গত’ আন্দোলন নিয়ে সরকারের প্রতিক্রিয়ার সমালোচনাও করেন।

“একটা গণতান্ত্রিক আন্দোলন, একটা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করার পরও তাদের (সরকার) মনে হয়েছে, তাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করে এই দাবিটা আদায় করা হচ্ছে। সেই ক্ষোভে প্রধানমন্ত্রী পুরোটাই দিয়ে দিলেন।

“আমি তো দেই নাই, আমার কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে- এই মনোভাব হচ্ছে জমিদারি মনোভাব। এই জমিদারি মনোভাব তখনই দেখা যায় যখন নাগরিকরা প্রজায় রূপান্তরিত হয়। আমরা আজকে প্রজা হয়ে গেছি, আমরা নাগরিক নাই। আমাদের সেই অধিকার নাই যে অধিকারের বলে আমি সরকারকে, প্রধানমন্ত্রীকে, সরকারের এমপিকে প্রশ্ন করতে পারি।”

“যখনি সরকার জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করে, তখনি তারা বিচ্ছিন্নতা ঠেকানোর জন্য পদ্ধতি গ্রহণ করে। সেই পদ্ধতির মধ্যেই যে তার মৃত্যুশেল, তা কোনো সরকার বুঝতে পারে না,” মন্তব্য করেন তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সমালোচনা করে তিনি বলেন, “আমার একটা অনুরোধ প্রক্টরের কাছে। আপনাকে ভুলে যেতে হবে যে আপনি ছাত্রলীগের কর্মী ছিলেন। একটু ভুলে যান। আপনি প্রশাসনের সাথে জড়িত, শিক্ষকতার সাথে জড়িত, কিন্তু আপনার ওই পরিচয়টা তো আপনি ভুলতে পারছেন না। শিক্ষকতা করতে গেলে এটা ভুলতে হবে।”

গত ১ জুলাই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে হামলার শিকার কোটা সংস্কার দাবির একজন আন্দোলনকারী (ফাইল ছবি)

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সারাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিপীড়ন ও হয়রানি বন্ধ, গ্রেপ্তার ছাত্রদের মুক্তি, হামলাকারীদের গ্রেপ্তার ও শিক্ষক লাঞ্ছনার প্রতিবাদে অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে ‘নিপীড়নবিরোধী শিক্ষকবৃন্দ’ ব্যানারে আয়োজিত এই সমাবেশে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত ৭০ জন শিক্ষক যোগ দেন। কয়েকশ শিক্ষার্থীও ছিলেন এই কর্মসূচিতে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, চাকরি প্রার্থী শিক্ষার্থীদের ‘ধূমায়িত অসন্তোষের প্রকাশ’ হচ্ছে এই আন্দোলন।

“প্রধানমন্ত্রী বলছেন, শিক্ষকরা কেন এই আন্দোলনে সমর্থন দিচ্ছে, সেটা তিনি বুঝতে পারছেন না। বুঝতে পারতেন খুব সহজেই। ছাত্র-ছাত্রী যারা আন্দোলন করছে তাদের সাথে যদি আপনি একটা ঘণ্টা সময় দিতেন, কিংবা আপনি যদি শিক্ষকদের সাথে কিছু সময় কথা বলতেন, তাহলে বুঝতে পারতেন, এই দাবিগুলো কতটা ভেতর থেকে এসেছে, কত দিনের জমানো ক্ষোভ থেকে এসেছে।”

আন্দোলনকারীদের পক্ষে অবস্থান জানিয়ে  তিনি বলেন, “শিক্ষার্থীদের দেখে আমরা সাহস পাই। কারণ বাংলাদেশ যে একটা ভয়াবহ বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে কিংবা ভয়ংকর যে অনিশ্চয়তার মধ্যে বাংলাদেশ পড়েছে, তা স্থায়ী হবে না, কারণ এই শিক্ষার্থীরাই সেই ভবিষ্যত আমাদের সামনে নিশ্চিত করে।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারপার্সন অধ্যাপক নাসরীন ওয়াদুদ ছাত্রলীগের সমালোচনা করে বলেন, “গতকাল ছাত্রলীগরা এসে মনোবিজ্ঞান বিভাগের যিনি প্রতিষ্ঠাতা, তার নামের ওপরে, ডিপার্টমেন্টের নামের ওপরে কালো কালি মেরে গেছে। তাদের মুখের কী হাসি! আমি ছবিসহ চিঠি পাঠালাম প্রক্টরকে, ভাইস-চ্যান্সেলরকে, কিন্তু এখন পর্যন্ত একটা টেলিফোন কলও আমি পাইনি?

“তাহলে আমরা কোথায় আছি? তাহলে আমাদের অভিভাবক কে? ভাইস-চ্যান্সেলর? আমি বলবো- ছি! ছি! উনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক হওয়ার যোগ্য না।”

আন্দোলনকারীদের অভিযোগ প্রশাসনের বিরুদ্ধেও (ফাইল ছবি)

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক এম এম আকাশ বলেন, “আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বৈত প্রশাসন দেখতে পাচ্ছি। প্রথমটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং অন্যটি হল, হলে যারা আধিপত্য বিস্তার করে গেস্টরুমে শিক্ষার্থীদের   নানারকমের নির্যাতন করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের

“ভিসি যদি হলের কর্তৃত্ব হল প্রশাসনকে দিতে ব্যর্থ হয়, যদি তিনি ক্ষমতাসীনদের চাপে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হন তাহলে আপনাকে বলব যে, আপনি নিজ ইচ্ছায় পদত্যাগ করুন।”

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক হাসিবুর রশিদ সংহতি জানিয়ে বলেন, “আমি একটি ন্যায্য আন্দোলনে সংহতি জানাতে এসেছি। আমি শিক্ষার্থীদের বলব তোমরা প্রশাসনের মতো ভয় পেয় না। আন্দোলনকারীদের যারা দমিয়ে রাখতে আসবে, তাদেরকেও আমরা প্রতিহত করতে তোমাদের পাশে দাঁড়াতে প্রস্তুত আছি।”

গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরিনের সভাপতিত্বে ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তানজীম উদ্দিন খানের সঞ্চালনায় সমাবেশে ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক তাসনীম সিরাজ মাহবুব, সমাজবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক সামিনা লুৎফা, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ফাহমিদুল হক, সহযোগী অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক খানসহ আরও কয়েকজন শিক্ষক বক্তব্য রাখেন।

অধ্যাপক গীতি আর নাসরিন তাদের পরবর্তী কর্মসূচি হিসেবে আগামী সোমবার কলাভবনের সামনে ‘নিপীড়নবিরোধী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান’র ঘোষণা দেন। সমাবেশ শেষে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের একটি ‘মৌন মিছিল’ কলাভবন এলাকা প্রদক্ষিণ করে।