এপারে নতুন বাংলাদেশ সৃষ্টির জন্য প্রাণপণে লড়ছেন মুক্তিকামী বাঙালিরা, ওপারে ভারত সীমান্তে মানবেতর জীবনযাপন করছে এক কোটি শরণার্থী; তাদের দুর্দশা দেখে কিছু করতে উদ্যোগী হন বিশ্বখ্যাত সেতারবাদক পণ্ডিত রবি শঙ্কর।
Published : 25 Mar 2018, 01:29 PM
নিজের ভাবনার কথা তিনি প্রকাশ করেন দীর্ঘদিনের বন্ধু বিটলস তারকা জর্জ হ্যারিসনের কাছে; দুজনের অক্লান্ত পরিশ্রমে একাত্তরের ১ অগাস্ট নিউ ইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে অনুষ্ঠিত হয় ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’।
ওই বেনিফিট কনসার্ট থেকে পাওয়া অর্থ একটি চেকের মাধ্যমে পাঠানো হয় জাতিসংঘ শিশু তহবিলে (ইউনিসেফ)। সেই চেকের একটি ছবি প্রকাশ করা হয়েছে ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ নিয়ে প্রকাশিত ছবির অ্যালবামের শেষ পাতায়।
দুই লাখ ৪৩ হাজার ৪১৮ ডলার ৫০ সেন্টের ওই চেকের একটি অংশে লেখা ছিল ‘বাংলাদেশের শরণার্থী শিশুদের ত্রাণের জন্য’।
এছাড়া ক্যাপিটল রেকর্ডস কনসার্ট ফর বাংলাদেশ লাইভ অ্যালবামের আগাম বিক্রি বাবদ ৩৭ লাখ ৫০ হাজার ডপলারের আরেকটি চেক অ্যাপলকে দেয়। পরে অ্যালবাম বিক্রি থেকে আরও অর্থ আসে।
১৯৭২ সালে ইউনিসেফের মাধ্যমে ২০ লাখ ডলার শরণার্থীদের কাছে পৌঁছায়। আর ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত ১ কোটি ২০ লাখ ডলারের মত বাংলাদেশে পাঠানো হয় বলে লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমসের তথ্য।
জর্জ হ্যারিসন ১৯৯০ এর দশকে এ বিষয়ে বলেছিলেন, বিষয়টি মিটে গেছে এবং পুরো স্বত্ত্ব এখন জাতিসংঘের হাতে।
কনসার্ট ফর বাংলাদেশের ডিভিডি ও সিডি বিক্রি করে পরে আরও সাড়ে ৪ কোটি ডলার আয় হয়, যা দিয়ে গঠিত হয় ‘জর্জ হ্যারিসন ফান্ড ফর ইউনিসেফ’
ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ-ইউল্যাবের শিক্ষক ইমরান রহমান কনসার্ট থেকে পাওয়া অর্থের চেক ও চেকের অ্যাডভাইস নোটের একটি ছবি সম্প্রতি ফেইসবুকে পোস্ট করেন।
ইউল্যাবের স্কুল অব বিজনেসের ডিন অধ্যাপক ইমরান বিডিডনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অনেক বাংলাদেশির মধ্যে এমন ভুল ধারণা রয়েছে যে কনসার্ট ফর বাংলাদেশ থেকে পাওয়া অর্থ সঠিকভাবে ব্যয় করা হয়নি এবং সেটা কখনো বাংলাদেশে আসেনি। এই চেকটি প্রমাণ করে কনসার্ট থেকে পাওয়া অর্থ বাংলাদেশের জন্যই পাঠানো হয়েছিল।”
টাইম ম্যাগাজিনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বেনেফিট কনসার্টের ধারণা একেবারে নতুন না হলেও কনসার্ট ফর বাংলাদেশকেই বিশ্বের প্রথম রক এ রোল বেনিফিট শো হিসেবে বর্ণনা করেন অনেকে।
বিপদগ্রস্ত মানুষদের সাহায্যের জন্য অর্থসংগ্রহের উদ্দেশ্যে এমন কনসার্টের আয়োজন পরে নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়।
কনসার্ট ফর বাংলাদেশের আয়োজনে একাত্তরের পুরো জুন আর জুলাইয়ের অর্ধেক সময় বিভিন্ন শিল্পীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে কাটান জর্জ হ্যারিসন।
তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বিখ্যাত শিল্পীদের একজন বব ডিলান কনসার্টে অংশ নিতে সম্মত হন। প্রাক্তন বিটলস সদস্য রিঙ্গো স্টারও রাজি হন কনসার্টে অংশ নিতে। এগিয়ে আসেন আরও দুই বিখ্যাত মার্কিন গায়ক বিলি প্রেস্টন ও লিওন রাসেল এবং তখনকার দিনের অন্যতম সেরা গিটারিস্ট এরিক ক্ল্যাপটন।
ব্রিটিশ রক ব্যান্ড ব্যাডফিঙ্গার, জার্মান মিউজিশিয়ান ক্লাউস ভুরম্যান, মার্কিন ড্রামার জিম কেল্টনার, জিম হর্নসের নেতৃত্বে ‘হলিউড হর্নস’ দলের সদস্যরা, গিটারিস্ট জেসি এড ডেভিস, কার্ল রেডল এবং আরও অনেক শিল্পী অংশ নেন বাংলাদেশের জন্য কনসার্টে।
আর কনসার্টের প্রথম অংশে ভারতীয় সংগীতপর্বে রবি শঙ্করের সঙ্গে অংশ নেন বিখ্যাত দুই ভারতীয় শিল্পী, ওস্তাদ আলী আকবর খান আর আল্লাহ রাখা।
কনরার্টের বিকালের ভাগের শেষ গানটি ছিল জর্জ হ্যারিসনের ‘বাংলাদেশ’। ওই গানের শুরুর কথায় পণ্ডিত রবি শঙ্করের সঙ্গে তার কথোপকথনটিই যেন ফুটে ওঠে।
৪০ হাজার দর্শকের সামনে জর্জ হ্যারিসন গেয়ে ওঠেন-
“মাই ফ্রেন্ড কেইম টু মি, উইদ স্যাডনেস ইন হিজ আইজ;
টোল্ড মি দ্যাট হি ওয়ান্টেড হেল্প, বিফোর হিজ কান্ট্রি ডাইজ।
অলদো আই কুডন্ট ফিল দ্য পেইন, আই নিউ আই হ্যাড টু ট্রাই;
নাউ আই অ্যাম আসকিং অল অব ইউ টু হেল্প আস সেইভ সাম লাইভস।
বাংলাদেশ বাংলাদেশ...”
হ্যারিসনের আবেগময় কণ্ঠের ওই গানে বাংলাদেশের নাম রাতারাতি পৌঁছে যায় পৃথিবীর বহু মানুষের কাছে।