ঢাকার আর্মি স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে চিৎকার করে কাঁদছিলেন সেলিনা পারভীন ঝর্ণা; একজন পুলিশ কর্মকর্তা তাকে একটি ফরমে সই করতে অনুরোধ করছিলেন, কিন্তু তাতে রাজি হচ্ছিলেন না ষাটোর্ধ্ব এই নারী। সই করলেই যে তাকে নিজের ছেলে রকিবুল হাসানের লাশ বুঝে নিতে হবে!
Published : 19 Mar 2018, 08:48 PM
সন্তানহারা এই মায়ের মত আরও অনেক স্বজনের আহাজারিতে সোমবার বিকালে ভারী হয়ে উঠছিল ঢাকার আর্মি স্টেডিয়ামের বাতাস।
ঢাকা আর্মি স্টেডিয়ামের পশ্চিম গ্যালারির সামনে সাদা শামিয়ানায় ছাওয়া মঞ্চটি সাজানো ছিল ফুল দিয়ে। সারি বেঁধে তাতে সাজানো ছিল সারি সারি কফিন।
ঠিক এক সপ্তাহ আগে নেপালে ইউএস-বাংলার উড়োজাহাজ দুর্ঘটনায় নিহতদের মধ্যে ২৩ জনের মরদেহ দেশে আনার পর ওই স্টেডিয়ামেই তা হস্তান্তর করা হয় পরিবারের সদস্যদের কাছে।
রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হাসির অবস্থা এখনও ভালো নয়। উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে নেওয়া হয়েছে সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে।
সোমবার বিকালে স্বজনদের সঙ্গে আর্মি স্টেডয়ামে এসে রকিবের মা কাঁদতে কাঁদতে বার বার বলছিলেন, “আমার একটাই ধন ছিলি তুই, আমাকে না বলে চলে গেলি! আমার আর কিছু থাকল না গো…।”
নয় বছর আগে স্বামীকে হারানো এই নারী এখন পড়েছেন বড় অসহায়ত্বের মধ্যে।
তার ভাইয়ের স্ত্রী শাহী নূর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, রকিবদের গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জে। রকিবের একটি বোন আছে, কিন্তু সেও থাকে বিদেশে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুরের রফিকুল ইসলাম পেশকারের মেয়ে আঁখির সঙ্গে গত ৩ মার্চ যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী মিনহাজ বিন নাসিরের বিয়ে হয়। বিয়ের ১৩ দিনের মাথায় হানিমুনে নেপালে যাওয়ার পথে ইউএস-বাংলার ওই উড়োজাহাজ দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় তাদের।
আঁখির মা কাঁদতে কাঁদতে বলেন, “আমার একমাত্র মেয়ে। আমার অনেক আদরের ছিল ও। সুখ, দুঃখ সবকিছু ওর সঙ্গে শেয়ার করতাম। প্রত্যেকটা কাজ ওর সঙ্গে শেয়ার করতাম। ও অনেক কঠিন জিনিস সহজে নিতে পারত। আমার সেই মেয়ে চলে গেল।”
কান্নাভেজা কণ্ঠে রাফেজা বলেন, “আমার মেয়েকেতো হারিয়েছি। আরও অনেককে হারাইছি আমরা। যারা মারা গেছে সবার জন্য দোয়া চাই। এর বেশি আমি বলতে পারব না।”
মামা সাইফুর রহমান জানান, সন্ধ্যায় শ্যামলীর আশা টাওয়ারে পৃথুলার জানাজা শেষে মিরপুরে তাকে দাফন করেছেন তারা।
পাইলট আবিদ সুলতানের মরদেহ নিতে এসেছিলেন তার বড় ভাই অধ্যাপক খুরশিদ মাহমুদ, খালাতো ভাই মোস্তাফিজুর রহমান এবং ভায়রা ওয়ালিউর রহমান।
মোস্তাফিজুর রহমান এ জানান, বিমান বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা আবিদের মরদেহ বনানীর সামরিক কবরস্থানে দাফন করা হবে।
নুরুজ্জামান বাবুর গ্রামের বাড়ি পাবনায়। পরিবার নিয়ে তিনি থাকতেন মিরপুর এলাকায়। তার মরদেহ নিতে আর্মি স্টেডিয়ামে গিয়েছিলেন তার মা নূর জাহান বেগম, স্ত্রী সুলতানা বেগম আর ছেলে হামিম জামান নিশাত।
বাবুর সহকর্মীরা যখন সান্ত্বনা দিয়ে ধৈর্য্য ধরতে বলছিলেন, নূর জাহান তখন বলছিলেন,“ক্যামনে ধৈর্য্য ধরুম, এই দিনে বেটা আমার গেছে। আবার এই দিনে কফিন হইয়া ফির্যা আসছে। ওরে আল্লাহ তুমি ক্যামন কইরা তুইল্লা নিলা।”
তাদের মরদেহ নিতে আর্মি স্টেডিয়ামে এসেছিলেন তাদের দুই মেয়ে নারগিস আক্তার কনক ও নাজনীন আক্তার কাঁকন। বাবা-মায়ের লাশ নিয়ে তারা ফিরে গেছেন রাজশাহীতে।
ওই উড়োজাহাজের কেবিন ক্রু খাজা হোসেন মো. শফির স্ত্রী সাদিয়া রহমান ও আত্মীয়-স্বজনরা লাশ নিতে আসেন আর্মি স্টেডিয়ামে। সাদিয়া নিজেও ইউএস-বাংলার ক্রু।
খাজার খালা শাশুড়ি সুরাইয়া আব্বাসী জানান, সাদিয়া যখন দোহা ফ্লাইটের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখনই দুর্ঘটনার খবর আসে। এক বছর দুই মাস আগে খাজার সঙ্গে সাদিয়ার বিয়ে হয়।
ঢাকার বেগম বাজারে পারিবারিকভাবে খাজার দাফন হতে পারে বলে জানান তিনি।