‘সভ্যতার চাপে’ মাতৃভাষা যেন হারিয়ে না যায়: হাসিনা

নিত্যনতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন নিয়ে অগ্রসরমান বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে মাতৃভাষা যেন হারিয়ে না যায় সেজন্য সবাইকে সচেতন থাকার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। 

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 Jan 2018, 12:41 PM
Updated : 13 Jan 2018, 12:47 PM

আন্তর্জাতিক বাংলা সাহিত্য সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, “যুগের পরিবর্তন হচ্ছে, বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে, নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হচ্ছে। সভ্যতা অগ্রসরমান। কিন্তু সভ্যতার চাপে মাতৃভাষা হারিয়ে যাক সেটা কখনও আমরা চাই না।”

শনিবার বিকালে ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে বাংলা ১৪২৪ সালের বাংলা সাহিত্য  সংশ্লিষ্টদের এই সম্মেলনের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। 

এই সাহিত্য সম্মেলন বাংলাদেশের মানুষকে ভাষা সম্পর্কে আরও সচেতন করবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

বিকাল সাড়ে ৫টায় বাংলা একাডেমিতে শুরু হয়েছে এই সম্মেলনের কার্যক্রম। বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের দুই শতাধিক কবি, লেখক, সাহিত্যিক ও গবেষক তিন দিনের এই বাংলা সাহিত্য সম্মেলনে অংশ নিচ্ছেন। সোমবার সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়।

আন্তর্জাতিক বাংলা সাহিত্য সম্মেলন পরিষদের এ আয়োজনে নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন ও ফ্রেন্ডস অফ বাংলাদেশ সহযোগিতা করছে।

বিষয়ভিত্তিক ছয়টি সেমিনারের সঙ্গে সম্মেলনে থাকছে দুটি মঞ্চনাটক, সংগীত, গল্প ও কবিতাপাঠ, চলচ্চিত্র প্রদর্শনী ও আবৃত্তির আয়োজন।

স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক বাংলা সাহিত্য সম্মেলন হয়েছিল ১৯৭৪ সালে। সেই সম্মেলনের উদ্বোধনে প্রধান অতিথি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর ১৯২২ সালে ভারতের বেনারসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে প্রথম ‘নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন’ হয়। এরপর ৯৪ বছরে ৮৯ বার এ সম্মেলন বসেছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমিতে সাহিত্য সম্মেলনে বলেছিলেন, “আমি বিশ্বাস করি যে, জনগণই সব সাহিত্য ও শিল্পের উৎস। জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কোনো দিন কোনো মহৎ সাহিত্য বা উন্নত শিল্পকর্ম সৃষ্টি হতে পারে না। আমি সারাজীবন জনগণকে সাথে নিয়ে সংগ্রাম করেছি, এখনও করছি। ভবিষ্যতে যা কিছু করব জনগণকে নিয়েই করব।”

তার ওই বক্তব্য উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেন, “আমি একজন সাধারণ মানুষ। যেহেতু আমার পিতা দেশ স্বাধীন করে গেছেন, আমি সব সময় এটাই মনে করি যে, এই দেশকে আমার উন্নত সমৃদ্ধ করে গড়ে তুলতে হবে। যেন বাঙালি বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে সম্মানের সাথে চলতে পারে- এটাই আমার লক্ষ্য।” 

সাহিত্য চর্চা মানুষের মধ্যে শুভবোধের বিকাশ ঘটায় বলে মন্তব্য করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্য পড়ে আসা শেখ হাসিনা।

তিনি বলেন, “সাহিত্য মানুষের অমিত সম্ভাবনার দ্বারকে উন্মোচিত করে। ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে। অন্যায়-অসত্যের বিরুদ্ধে লড়তে শেখায়।”

“যে সমাজের সাহিত্য যত ঋদ্ধ, সেই সমাজ ততো বেশি সভ্য। আমাদের বাংলা সাহিত্যের ভিত্তিও অনেক সুদৃঢ়। আর সে কারণেই বাংলা ভাষা আজ বিশ্বের অন্যতম মর্যাদার আসনে আসীন।”

‘বিশ্বমানব হবি যদি কায়মনে বাঙালি হ’-  গুরুসদয় দত্তের এই অমিয় বাণীকে ধারণ করে এবারের আন্তর্জাতিক বাংলা সাহিত্য সম্মেলন হচ্ছে। 

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসরত সব বাঙালির দৃষ্টি আকর্ষণ করে শেখ হাসিনা বলেন, “বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে অবস্থানরত সব বাঙালির মনে রাখতে হবে যে, আমাদের শেকড় হচ্ছে বাংলা, বাংলা ভাষা, বাংলা সাহিত্য।”

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এই বাংলা ভাষাকে ভিত্তি করেই কিন্তু আমাদের স্বাধীনতা, আমাদের আত্মপরিচয়ের ঠিকানা। বাঙালি কখনও কারও কাছে মাথা নত করে না, মাথা নত করতে জানে না। কাজেই বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করেই আমাদের চলতে হবে।” 

আন্তর্জাতিক পরিসরে বাঙালির অভিজ্ঞতা ও দৃষ্টিভঙ্গির আদান-প্রদানের মাধ্যমে জ্ঞানের পরিধি আরও বিস্তৃত হবে বলে আশা প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী।

তিনি বলেন, “আমাদের সাহিত্য আরও গতিশীল ও সহজ হয়েছে। আমাদের সাহিত্য আরও ঋদ্ধ হবে। এই আয়োজন একদিকে নতুন সম্ভাবনাকে উন্মোচিত করবে, অন্যদিকে নিজেদের সামর্থ্যকে তুলে ধরবে।” 

অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন কথাসাহিত্যিক রাবেয়া খাতুন, নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের সাধারণ সম্পাদক জয়ন্ত ঘোষ ও জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য এবং ফ্রেন্ডস অফ বাংলাদেশের সহ-সভাপতি সত্যম রায় চৌধুরী। 

স্বাগত বক্তব্য রাখেন এই সম্মেলনের প্রধান সমন্বয়কারী নাসিরউদ্দিন ইউসুফ।

সম্মেলনের প্রথম দিন বিকাল সাড়ে ৫টায থেকে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, কবিতাপাঠ, গল্পপাঠ, আবৃত্তি ও সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। পাশাপাশি সম্মেলন স্থলে তিনটি মঞ্চে যুগপৎ পরিবেশিত হবে নৃত্য ও নাটক।

সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন রোববার সকাল ১০টায় হবে ‘বাংলা সাহিত্যে দেশভাগের অভিঘাত’ শিরোনামে একটি সেমিনার। সেদিন ‘সাহিত্য ও চলচ্চিত্র’ এবং ‘সাম্প্রতিককালের সাহিত্য’ শিরোনামে আরও দুটি সেমিনার হবে। পাশাপাশি কবিতা ও গল্প পাঠ, আবৃত্তি, সংগীত, নৃত্যানুষ্ঠান ও নাটকের পরিবেশনা থাকছে।

সমাপনী দিন সোমবার থাকছে ‘ভাষা আন্দোলন ও বাঙালি জাতিসত্তা’, ‘অনুবাদের সাহিত্য, সাহিত্যের অনুবাদ’ এবং ‘প্রযুক্তির বিশ্বে সাহিত্যের সঙ্কট ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক তিনটি সেমিনার।

ওই দিন বিকাল ৫টায় সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দেবেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। 

সাহিত্য সম্মেলন সুষ্ঠুভাবে আয়োজনে ২০১ সদস্যের যে আয়োজক পরিষদ গঠন করা হয়েছে, তার প্রধান পৃষ্ঠপোষক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।

পৃষ্ঠপোষক হিসেবে আরও আছেন ভারতের ঝাড়খণ্ড রাজ্য সরকারেরর মন্ত্রী সরযু রায়। প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে আছেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর।