এমনকি নিজ স্বার্থ রক্ষা ও ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাকারী নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা আইনটির অপব্যহার করছেন বলেও মন্তব্য করেছে আদালত।
সাবেক ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জনের সঙ্গে হাতাহাতি এবং পরে তাকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে সাজার ঘটনায় লক্ষ্মীপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) শেখ মুর্শিদুল ইসলাম এবং ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাকারী সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ নুরুজ্জামানের বিষয়ে আদেশের পর্যবেক্ষণে হাই কোর্টের এই মন্তব্য আসে।
হাতাহাতির ঘটনায় জারি করা রুল নিষ্পত্তি করে বুধবার বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি মোহাম্মদ উল্লাহ বেঞ্চ আদেশ দেয়।
এক রিটের আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গত মঙ্গলবার আদালত সাবেক ঘটনার ব্যাখ্যা শুনতে শেখ মুর্শিদুল ইসলাম এবং মোহাম্মদ নুরুজ্জামানকে তলব করে। সাবেক ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন সালাহ উদ্দিন শরীফকেও আদালতে থাকতে বলা হয়।
বুধবার শেখ মুর্শিদুল ইসলাম এবং মোহাম্মদ নুরুজ্জামান আদালতে হাজির হয়ে আইনজীবীর মাধ্যমে ঘটনার ব্যাখ্যা দিয়ে নিঃশর্ত ক্ষামা প্রার্থণা করলে আদালত তাদের ব্যক্তিগত হাজিরা থেকেও অব্যাহতি দেয়।
আদালতে লক্ষ্মীপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের পক্ষে শুনানি করেন আব্দুল বাসেত মজুমদার। সঙ্গে ছিলেন সাঈদ আহমেদ রাজা। আর সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ নুরুজ্জামানের পক্ষে শুনানি করেন ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন।
এছাড়া শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তাপস কুমার বিশ্বাস এবং রিটকারী আইনজীবী হাসান এম এস আজিম।
এ ঘটনায় সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইএনও) মো. নূরুজ্জামান ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে সালাহ উদ্দিন শরীফকে ‘অসদাচরণের দায়ে’ তিন মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন।
সালাহ উদ্দিন শরীফকে পরে পাঁচ হাজার টাকার মুচলেকায় জামিন দেন লক্ষ্মীপুর জেলা হাকিম আদালতের বিচারক মীর শওকত হোসেন।
বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে লক্ষ্মীপুরের ঘটনার ওপর প্রকাশিত প্রতিবেদন যুক্ত করে ৫ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী কামাল হোসেন মিয়াজী এবং আশফাকুর রহরমান একটি রিট দায়ের করেন।
দুই কর্মকর্তাকে তলবের পাশাপাশি গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের জেরে নির্বাহী কর্মকর্তার পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রমের অপব্যবহার কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল দেয় আদালত।
আইন সচিব, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব, লক্ষ্মীপুরের জেলা প্রশাসক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, সিভিল সার্জনকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়।
আদালতের পর্যবেক্ষণ
হাতাহাতির পর সাজা দেওয়ার ঘটনাটি ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ক্ষমতার অপব্যবহারের প্রকৃষ্ট উদহারণ উল্লেখ করে আদালত তার পর্যবেক্ষণে বলে, “একটি সভ্য সমাজে সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এমন কর্মকাণ্ড সম্পূর্ণ অনভিপ্রেত ইতিপূর্বে দেখা গিয়েছে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার জন্য প্রণীত আইন অমান্য করে নিজ ইচ্ছামত ক্ষমতার অপব্যবহার করে ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
আদালত বলে, “মোবাইল কোর্ট অবশ্যই রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে অতিব প্রয়োজন। কিন্তু এর অপব্যবহার কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আদালত আশা করে প্রতিদিন মোবাইল কোর্ট পরিচালনায় দায়িত্বরতরা মোবাইল কোর্ট আইন অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করবে।”
আদেশের বাইরে এসময় আদালতের জ্যেষ্ঠ বিচারক বলেন, “বাড়িতে বসে ভ্রাম্যমাণ আদালত চালানো হবে না। ম্যাজিস্ট্রেট বাড়িতে বসে আদেশ দিচ্ছেন, চলবে না।”
এরপর আদেশে আদালত আরও বলে, “সিভিল সার্জন একজন অবসরপ্রাপ্ত উচ্চ পদস্ত সরকারি কর্মকর্তা। তার আচরণ অনেক বেশি সহনশীল, গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে থাকবে বলে আশা করি।”
হাতাহাতি ও সাজা দেওয়ার ঘটনায় এডিসি ও ইউএনওকে নিঃশর্ত ক্ষমা করলেও তাদের বিষয়ে সরকারকে সতর্ক করে আদালত আদেশে বলে, “অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের এহেন কর্মকাণ্ডের জন্য তাদের ভবিষ্যতে এমন কোনো পর্যায়ে নিয়োগ দেওয়া না হয়, যেন তারা ক্ষমতার অপব্যবহার করতে না পারেন। সে জন্য আইন সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব ও জনপ্রশাসন সচিবকে নির্দেশ দেওয়া হল।”
আদালতে দেওয়া ঘটনার ব্যাখ্যায় লক্ষ্মীপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক শেখ মুর্শিদুল ইসলাম দাবি করেন, ডিসি কলোনির ভেতরে জেলা প্রশাসকের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত কাকলি শিশু অঙ্গন বিদ্যালয়ে পরীক্ষায় তিনি দায়িত্ব পালন করছিলেন। স্কুল কর্তৃপক্ষের আবেদনেই জেলা প্রশাসক সেদিন তাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন।
আদালত এ ব্যাখ্যা গ্রহণ না করে বলে, প্রাথমিক একটি বেসরকারি বিদ্যালয়ে পরীক্ষা তদারকীর জন্য একজন এডিসিকে নিযোগ করেন, যা আদালতের কাছে সম্পূর্ণরূপে মিথ্যা-বানোয়াটরূপে প্রতিয়মান হয়েছে। কোথাও কোনো বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নকল তদারকীর জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বলে কখনোই দেখা যায়নি। তাছাড়া কাকলি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি জেলা প্রশাসকের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত। পরীক্ষা তত্ত্বাবধানের জন্য বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষই যথেষ্ট।
আদালত বলে, স্বীয় স্বার্থের কারণে ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক টেলিফোনে তাকে (সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ নুরুজ্জামানকে) তলব করেন। পরে তিনি ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে দণ্ডবিধি ১৮৬ ধারা অনুযায়ী ডাক্তার সালাহ উদ্দিনকে অযৌক্তিক শাস্তি প্রদান করেন। ফলে স্পষ্ট হয় যে, ঘটনা চলাকালে তিনি ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন না। তার সামনে ঘটনা ঘটেনি।
এতে স্পষ্ট টেলিফোনের প্রেক্ষিতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ঘটনাস্থলে উপস্থিত না থেকেই এবং তার নির্দেশমত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে ডাক্তার সালাহ উদ্দিনকে শাস্তি প্রদান করেন।
এর আগে শুনানির এক পর্যায়ে এডিসির ব্যাখ্যায় বিষ্ময় প্রকাশ করে আদালত বলে, “এটা প্রাইমারি স্কুল। যে স্কুলে প্রথম শ্রেণি থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা হবে। আর সেই পরীক্ষায় নকল ধরতে একজন এডিসিকে পাঠানো হয়েছে, কি চমৎকার! আগে বলেননি কেন? আগে বললে আপনাদের জন্য কামানসহ সেনাবাহিনী পাঠিয়ে দিতাম।”
এছাড়া এমন দায়িত্বে থেকে হাতহাতির ঘটনাতেও বিষ্ময় প্রকাশ করে আদালত।
আদালত এসময় সিভিল সার্জন ও এডিসিকে উদ্দেশ্য করে বলে, “আপনারা উচ্চশিক্ষিত লোক। সমাজ কি বলে যখন দেখে ডাক্তার এবং এডিসি হাতাহাতি করে? এ লজ্জা কার? এটা আমাদের হতাশ করেছে। আশা করি ভবিষ্যতে এমনটি হবে না।”