জেএসসি পরীক্ষা: প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে তো হচ্ছেই

জেএসসি পরীক্ষার অন্যান্য বিষয়ের মতো গণিতের প্রশ্নও ফাঁস হয়েছে, অনেক অভিভাবক সন্তানকে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন-উত্তর দেখতে সহায়তা করলেও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন কেউ কেউ।

কাজী নাফিয়া রহমানও সাজিয়া আফরিনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 Nov 2017, 03:03 PM
Updated : 12 Nov 2017, 08:00 PM

এভাবে পরীক্ষা নেওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলে একজন অভিভাবক বলেছেন, পরীক্ষার নামে জীবনের শুরুর দিকেই ছেলে-মেয়েদের অনৈতিক পথে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

আরেক অভিভাবক বলেছেন, তার ছেলে প্রথম দিকে পড়ে পরীক্ষা দিলেও প্রশ্ন ফাঁসের জন্য এখন বেকে বসেছে, অসহায় হয়ে পড়েছেন তারা।  

রোববার রাজধানীর কয়েকটি পরীক্ষা কেন্দ্রে সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, পরীক্ষা শুরুর ঘণ্টাখানেক আগে সকাল ৯টার পর থেকে শিক্ষার্থীদের মাঝে প্রশ্ন খোঁজার ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেছে। পরীক্ষার্থীদের অনেকেই জটলা করে প্রশ্ন ও এর উত্তর দেখতে থাকেন। অনেকে আবার হন্যে হয়ে গাইডে খুঁজতে থাকেন প্রশ্নের উত্তর। অনেক শিক্ষার্থীকে সহায়তা করছিলেন তাদের অভিভাবকরাই।

মিরপুর গার্লস আইডিয়াল ল্যাবরেটরি ইনস্টিটিউট পরীক্ষা কেন্দ্রের বাইরে অপেক্ষমাণ শিক্ষার্থীদের অনেককে স্মার্টফোনে প্রশ্ন খুঁজতে দেখা যায়। ওই কেন্দ্রের সামনে সকাল ৯টা ১০মিনিটে মিরপুর ল্যাবরেটরি স্কুলের এক শিক্ষার্থী গণিত পরীক্ষার ‘খ সেট’র প্রশ্ন এবং এর বহুনির্বাচনী প্রশ্নের উত্তর পেয়ে বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে তা দেখতে থাকেন।

প্রশ্ন কীভাবে পেয়েছেন জানতে চাইলে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পরিচিত ভাইয়া আছে, তার কাছ থেকেই প্রশ্ন পাই।”

এ প্রশ্ন পরীক্ষায় আসবে কি না- প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “ভাইয়া শিওর হয়েই প্রশ্ন দেয়।”

পাশেই দাঁড়ানো এই জটলার আরেক শিক্ষার্থীর অভিভাবক প্রশ্ন ফাঁসের কথা স্বীকার করে বলেন, “আমরা কেউই তো চাই না আমার বাচ্চাটা পরীক্ষায় খারাপ করুক। সবাই তো প্রশ্ন পাচ্ছে। যা পড়ার আগেই তো পড়ছে, কিন্তু এখন একটু চোখ বুলিয়ে যাওয়া।”

এর ফলে সন্তানের ‘নৈতিক অবক্ষয়’ হচ্ছে জেনেও এ অভিভাবক বলেন, “আমি তো ওকে মোবাইল দিচ্ছি না। ওর বন্ধুরা পাচ্ছে, সেখান থেকে ও দেখে নিচ্ছে।”

এ কেন্দ্রে পরীক্ষা দিতে আসা পুলিশ স্মৃতি স্কুল অ্যান্ড কলেজ, নবাবেরবাগ সেন্ট্রাল হাই স্কুল, মিরপুর ল্যাবরেটরি হাই স্কুলের কয়েকজন শিক্ষার্থীর কাছে তাদের স্মার্টফোনে পরীক্ষার প্রশ্ন দেখা যায়।

নবাবেরবাগ সেন্ট্রাল হাই স্কুলের এক শিক্ষার্থীর কাছে প্রশ্নের কপিও দেখা গেছে, যা নিয়ে পরীক্ষাকেন্দ্রে ঢোকেন তিনি। পরে পরীক্ষা শেষে দেখা যায়, সেই ফাঁসকৃত প্রশ্নের সাথে পরীক্ষার প্রশ্ন হুবহু মিলে গেছে।

একই চিত্র দেখা গেছে খিলগাঁও মডেল হাই স্কুল কেন্দ্রে। পরীক্ষা শুরুর ঘণ্টাখানেক আগে থেকে জটলা করে মোবাইলে প্রশ্ন খুঁজছিলেন কয়েকজন পরীক্ষার্থী।

এই কেন্দ্রে মেয়েকে পরীক্ষা দিতে নিয়ে আসা স্থানীয় ব্যবসায়ী মকবুল হোসেন বলেন, ফাঁসকৃত প্রশ্ন ছেলেদের হাতে আগে আসে।

“আমার মেয়ে প্রশ্ন পাইছে স্বীকার যাই। কিন্তু প্রশ্নটা পাইছে তার ছেলে বন্ধুর কাছে। ওদের গ্রুপ আছে, এক বন্ধু আরেক বন্ধুকে দেয়, এইভাবেই ছড়িয়ে পড়ে সবার কাছে। ছেলেরাই বেশি দুষ্ট হয় এসব ক্ষেত্রে। আর বাচ্চারা বন্ধুর কথায় প্রভাবিত হয় বেশি।” 

এই কেন্দ্রে জটলা করে প্রশ্নোত্তর দেখতে থাকা শিক্ষার্থীদের একটু দূরে দাঁড়ানো একজন অভিভাবক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “আমার ছেলে প্রথম কয়েকটা পরীক্ষা পড়েই দিসিল। আইসিটি পরীক্ষার পর থেকে বাসায় হুলস্থূল করে ফেলছে সবাই প্রশ্ন পায়, ও কেন পাবে না তা নিয়ে। অনেক বুঝিয়েও কুল পাইতেসি না আপা। আমরা এক রকম অসহায় এই সিস্টেমের কাছে।” 

বিগত পরীক্ষাগুলোর ফাঁস হওয়া প্রশ্নও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের হাতে এসেছিল সকাল ৯টা থেকে সাড়ে ৯টার মধ্যে। 

নিয়মিত প্রশ্ন ফাঁস হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন অনেক অভিভাবক।

মিরপুর গার্লস আইডিয়াল ল্যাবরেটরি ইনস্টিটিউট কেন্দ্রে ছেলেকে নিয়ে আসা আব্দুল মাজিদ নামে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রশ্ন ফাঁস যেহেতু বন্ধ করা যাচ্ছে না, তাহলে পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে কেন?

“পরীক্ষার নামে জীবনের শুরুর দিকেই আমরা বাচ্চাদের অনৈতিক পথে নিয়ে যাচ্ছি। আর উত্তরসহ প্রশ্ন পাওয়া গেলে মেধাবী ও মেধাহীনের পার্থক্য কী হবে ফলাফলে?”

নিয়মিত প্রশ্ন ফাঁস হলেও তা ঠেকাতে কী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে জানতে চাইলে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক তপন কুমার সরকার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস বন্ধে আমাদের পক্ষ থেকে যা যা করার আমরা তা করছি। ব্যবস্থা নিচ্ছি না তা তো না। গোয়েন্দা সংস্থা ও বিটিআরসিকে তথ্য দিয়েছি। তারাও কাজ করছে।”

এদিকে পরীক্ষা শুরুর আধা ঘণ্টা আগে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা কেন্দ্রে ঢোকার নিয়ম থাকলেও তা হচ্ছে না। এই ফাঁকে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন এর উত্তর দেখে নিচ্ছেন শিক্ষার্থীরা।

খিলগাঁও মডেল হাই স্কুল কেন্দ্রের পরীক্ষার্থী গভর্নমেন্ট কলোনি হাই স্কুলের একজন শিক্ষার্থী বলেন, সকাল ১০টা ২০ মিনিট পর্যন্ত এই কেন্দ্রে পরীক্ষার্থীরা ঢুকতে পারে।

 

“প্রশ্নোত্তর দেখার জন্য আধা ঘণ্টা হলেই যথেষ্ট।” 

নির্ধারিত সময়ের পরেও শিক্ষার্থীদের ঢুকতে দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে সেখানকার কেন্দ্র সচিব মো. আসলাম উদ্দীন মোল্লা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মানবিক দিক বিবেচনা করে অনেক সময় বাচ্চারা দেরি করে আসলেও ঢুকতে দিতে হয়। 

“রাস্তায় যানজট, অনেকের বাসা দূরে ইত্যাদি কারণে একটা বাচ্চার বোর্ড পরীক্ষা নিয়ে সমস্যা হলে কী করার থাকতে পারে! দেরি করে ঢোকার পেছনে যদি অন্য কোনো উদ্দেশ্য থাকে, তবে এগুলো রাষ্ট্রীয়ভাবে খতিয়ে দেখা উচিত বলে আমি মনে করি।”

এ বিষয়ে মিরপুর গার্লস আইডিয়াল ল্যাবরেটরি ইনস্টিটিউট  কেন্দ্রের সহকারী সচিব জিনাত ফারহানা বলেন, “এটা তো পাবলিক পরীক্ষা। বাচ্চারা রিকোয়েস্ট করলে তাদের ঢুকতে দেই। অনেকে তো আবার যানজটের কারণে দেরি করে ফেলে। সেজন্য মানবিক দিক বিবেচনায় তাদের সুযোগটা দেই।”