পরীক্ষার আগে প্রশ্ন ছড়িয়ে পড়ছে ফেইসবুক গ্রুপ-পেইজে

এতদিন টাকার বিনিময়ে মেসেঞ্জার ও হোয়াটস অ্যাপে বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করা হলেও এখন বিনামূল্যে তা উন্মুক্ত করে দেওয়া হচ্ছে ফেইসবুক গ্রুপ ও পেইজে, যা হুবহু মিলছে পরীক্ষার প্রশ্নের সাথে।

কাজী নাফিয়া রহমান নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 Nov 2017, 06:30 PM
Updated : 12 Nov 2017, 06:45 PM

রোববার সকাল ১০টায় জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেটের (জেএসসি) গণিত পরীক্ষা শুরু হওয়ার ঘণ্টাখানেক আগে প্রশ্ন ও তার উত্তর ছড়িয়ে পড়ে, বিভিন্ন কেন্দ্রের সামনে দাঁড়িয়ে তাতে চোখ বুলিয়ে নেন শিক্ষার্থীরা।

এর আগের পরীক্ষাগুলোতে নির্দিষ্ট অংকের টাকা দিয়ে মেসেঞ্জার ও হোয়াটস আপের মাধ্যমে প্রশ্ন পাওয়ার কথা জানান শিক্ষার্থীরা।

তবে এদিন সকাল ৮টা ৫৮মিনিটে ‘সকল পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের সমাহার’ নামের একটি ফেইসবুকে পেইজে প্রশ্ন ফাঁস করা হয়েছে।

সকাল ১০টায় পরীক্ষা শুরুর কিছু সময় পর থেকে ওই পেইজটি আর দেখা যাচ্ছে না। প্রশ্ন ফাঁস করা ওই পোস্টের স্ক্রিনশট বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কাছে রয়েছে।সেখানে তুলে দেওয়া প্রশ্ন হুবহু মিল গেছে পরীক্ষার প্রশ্নের সঙ্গে। 

এর বাইরে ‘psc jsc ssc hsc question suggestion. all board examinee 2018+2019+20+21 bd’ নামের একটি ফেইসবুক গ্রুপেও সকাল ৯টার দিকে প্রশ্নপত্র তুলে দেন কয়েকজন ব্যবহারকারী। পরীক্ষা শেষে এই প্রশ্নের সঙ্গে পরীক্ষার প্রশ্নের হুবহু মিল পাওয়া যায়।

‘Tanvir Hossen’ নামের এই ফেইসবুক গ্রুপের একজন সদস্য পরীক্ষার আগের রাত ১২টায় একটি পোস্টে প্রশ্ন ফাঁসের আগাম খবর দেন। প্রতারিত না হয়ে বিনা টাকায় প্রশ্ন নেওয়ার অনুরোধ করে তিনি লেখেন, সকাল ৮টা ৪৫ মিনিটে প্রশ্ন ফাঁস হবে।

ফেইসবুকে ঘোরা এসব প্রশ্ন ও উত্তরের সন্ধানে পরীক্ষা শুরুর আগে বিভিন্ন কেন্দ্রের সামনে শিক্ষার্থীদের স্মার্টফোনে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়।

সকাল ৯টার দিকে মিরপুর গার্লস আইডিয়াল ল্যাবরেটরি ইনস্টিটিউট কেন্দ্রে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী ও অভিভাবককে স্মার্টফোনে প্রশ্ন দেখতে দেখেন এই প্রতিবেদক।

প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে এই পরীক্ষা কেন্দ্রের সহকারী কেন্দ্র সচিব জিনাত ফারহানা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা শিক্ষকরাই প্রশ্ন ফাঁসের জন্য দায়ী। বিভিন্ন স্কুলগুলো তাদের সুনাম ধরে রাখতে প্রশ্ন ফাঁসে জড়িয়ে পড়ছে। প্রশ্ন তো শিক্ষকদের কাছেই আসে। তারা আগেভাগে প্রশ্ন খুলে তা ছড়িয়ে দেন। আর অভিভাবকরাও প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে সন্তানদের সাহায্য করছেন।"

কেন্দ্র থেকেই প্রশ্নগুলো ফাঁস হচ্ছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “আমরা সাড়ে ৯টার আগে প্রশ্ন খুলি না। এমনকি কেন্দ্র সচিব, সহকারী কেন্দ্র সচিব, তিনজন হল সুপারকে নিয়ে আমরা প্রশ্ন খুলি। আমাদের কেন্দ্র থেকে কেউ বলতে পারবে না যে, প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে। আর আমরা শিক্ষার্থীদের এসবে সহযোগিতা করতে পারি না বলে আমরা তাদের কাছে খারাপ। অভিভাবকরাও অভিযোগ করেন আমাদের কাছে। কিন্তু নৈতিকতাবিরোধী এসব কাজ শিক্ষকরা করে কী করে?

“কী ভয়াবহ পরিস্থিতিতে আমরা। প্রতিদিন প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে, এটা এখন ওপেন সিক্রেট।”

এভাবে প্রশ্ন ফাঁস হলেও তা বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ না থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন অনেক অভিভাবক।

সোহরাব হাসান নামে একজন  বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ফেইসবুকের বিভিন্ন গ্রুপে মোবাইল নম্বর দিয়ে টাকা পাঠিয়ে প্রশ্নের জন্য যোগাযোগ করতে বলা হচ্ছে। এখন তো সব সিম বায়োমেট্রিক করা, তাহলে এরা কারা? এদের বের করা কি কঠিন? নাকি বড় রাঘববোয়ালরাই প্রশ্ন ফাঁস করছে?"

আরেক অভিভাবক নাসরীন নাহার বলেন, “কয়টা প্রশ্ন কোন কেন্দ্রে যাচ্ছে সেটা হিসাব করে তৈরি হওয়ার কথা। তাহলে উপরের লোকজন জড়িত না থাকলে উত্তরে টিক চিহ্ন দিয়ে প্রশ্ন ফাঁস করা সম্ভব হয় কীভাবে?

“এই কেন্দ্রে প্রকাশ্যে সবাই প্রশ্ন ও উত্তর দেখছে। কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা থাকলে তো এখানে অভিযান চালিয়েই কারা ফাঁস করছে,তা বের করা সম্ভব।”

প্রশ্ন ফাঁস রোধে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে জানতে চাইলে ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক তপন কুমার সরকার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আপনারা তো আমাদের তথ্য দিয়েছেন, সেটা আমরা গোয়েন্দা সংস্থাকে দিয়েছি। তারা কাজ করছেন।”

বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে আলোচনা চলছে অনেক দিন থেকে। এজন্য শিক্ষকদের দায়ী করে হুঁশিয়ার করেছিলেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ।

গত ২৪ অক্টোবর সচিবালয়ে সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে এক সভায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি মোখলেছুর রহমান বলেন, “পরীক্ষার দিন সকালে কেন্দ্র সচিব ছাড়া কারও কাছেই মোবাইল থাকবে না- এটা নিশ্চিত করতে পারলেই প্রশ্ন ফাঁস হবে না। কারণ ফোনে ছবি তুলে তারা বাইরে প্রশ্ন পাঠিয়ে দেন।”

সকাল ১০টায় পরীক্ষা শুরু হলে তার এক ঘণ্টা আগে প্রশ্ন বাইরে চলে আসে জানিয়ে মোখলেছুর পরীক্ষার্থীদের আগেই পরীক্ষা কেন্দ্রে ঢুকিয়ে তারপর প্রশ্নের প্যাকেট খোলার পরামর্শ দেন।

ওই সভায় মেজর রাহাত নামে র‌্যাবের একজন কর্মকর্তা বলেছিলেন, পরীক্ষা শুরুর ৩০ মিনিট আগে হাতে হাতে প্রশ্ন দেখা যায়। বৃষ্টি না হলেও হাতে হাতে ছাতা নিয়ে শিক্ষার্থী-অভিভাবক প্রশ্নের সমাধান দেখেন।