ঢাকার মিরপুরের মাজার রোডের জঙ্গি আস্তানায় আরও কিছু বিস্ফোরক থাকার কথা জানিয়ে র্যাব কর্মকর্তা মুফতি মাহমুদ খান বলেছেন, অভিযান শেষ করতে তাদের আরও সময় লাগবে।
Published : 07 Sep 2017, 04:24 PM
জঙ্গি আস্তানায় বিস্ফোরণ: গ্রেপ্তার ২, অপমৃত্যু মামলা
এদিকে এক দম্পতি ওই বাড়ির সামনে এসেছেন তাদের ছেলের খোঁজে, যিনি আবদুল্লাহর কবুতরের খামারে কাজ করতেন।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তৃতীয় দিনের অভিযান শেষে মুফতি মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, “ছয় তলার একটি অংশে তল্লাশি সম্পন্ন করেছি।”
“ছয় তলার অরেকটি অংশে ২৩টি ফ্রিজ রয়েছে, সেখানে কী আছে, তা আগামীকাল বলা যাবে। আগামীকাল আমরা ছয়তলার ওই অংশে অভিযান চালাব।”
বৃহস্পতিবারের তল্লাশিতে ১০টি উচ্চ ক্ষমতার বোমা, বিভিন্ন রাসায়নিক দিয়ে তৈরি এক ধরনের বোমা, ৩০টি বোতল বোমা, ৫০টি দেশীয় অস্ত্র পাওয়ার কথা জানান তিনি।
সেই সঙ্গে বোমা তৈরির সরঞ্জাম সালফারসহ ১০ কেজি গান পাউডার পাওয়া গেছে বলে জানান তিনি।
এই আস্তানায় একটি বহুতল ভবনের নকশা পাওয়া গেছে জানিয়ে মুফতি মাহমুদ বলেন, “ওই নকশায় বিভিন্ন মার্কিং করা। তার যে পেশা, সেখানে বহুতল ভবনের মার্কিং করার নকশা থাকার কথা নয়। আমরা ধারণা করছি, কোনো বহুতল ভবনে নাশকতা করার জন্য এ ধরনের ছক করা হয়েছিল।”
সকালে ছয় তলা ওই বাড়িতে আবার তল্লাশি শুরুর পর দুপুরে তিনি জানিয়েছিলেন, ওই বাসার বিভিন্ন কক্ষে কার্টনের মধ্যে কবুতরের খাবার ও বিভিন্ন ‘ডিভাইস’সহ বিভিন্ন সামগ্রী থাকায় তল্লাশির সময় সাবধানতা অবলম্বন করতে হচ্ছে।
সকাল সাড়ে ৮টার দিকে ওই বাড়িতে তল্লাশি শুরুর পর বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সেখানে ফায়ার সার্ভিসের একটি গাড়ি প্রবেশ করে। কিছুক্ষণ পর সংবাদকর্মীদের ভেতরে গিয়ে ছবি তোলার সুযোগ দেওয়া হয়।
তখন র্যাবের বোমা নিষ্ক্রিয়কারী ইউনিট ষষ্ঠ তলায় কাজ করছিল।
মাজার রোডের পাশে বর্ধনবাড়ি ভাঙ্গা ওয়ালের গলির ওই ছয় তলা ভবনের প্রতিটি তলায় চারটি করে ইউনিট। তার মধ্যে পঞ্চম তলার দুটি ইউনিটে সন্দেহভাজন জঙ্গি আবদুল্লাহ পরিবার নিয়ে ভাড়া থাকতেন। ষষ্ঠ তলার অর্ধেক অংশে তিনি কবুতর পুষতেন। বাকি খোলা জায়গাও কবুতর রাখতে ব্যবহার করা হত।
টাঙ্গাইলের এলেঙ্গায় সোমবার একটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে ‘জেএমবির জঙ্গি’ দুই ভাইকে ড্রোন ও দেশীয় অস্ত্রসহ আটকের পর তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সেদিন মধ্যরাতে মিরপুরের ওই বাড়িতে অভিযান শুরু করে র্যাব।
ভবনটি থেকে বাসিন্দাদের সরিয়ে নেওয়া হয় পাশের একটি স্কুলে। র্যাবের পক্ষ থেকে বলা হয়, ওই বাড়ির পঞ্চম তলায় ‘দুর্ধর্ষ জঙ্গি’ আবদুল্লাহ, তার দুই স্ত্রী, দুই সন্তান ও দুই কর্মচারী আছেন।
মঙ্গলবার সারাদিন র্যাবের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করে আবদুল্লাহকে আত্মসমর্পণে রাজি করানোর চেষ্টা চলে। সন্ধ্যায় জানানো হয়, আবদুল্লাহ আত্মসমর্পণ করতে রাজি হয়েছেন। কিন্তু রাত পৌনে ১০টার দিকে ওই ভবনে বিকট শব্দে তিনটি বিস্ফোরণ ঘটে।
বুধবার সকাল থেকে সারাদিন তল্লাশি চালিয়ে বিকালে পঞ্চম তলার ওই বাসা থেকে সাতজনের খুলি ও পোড়া অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পাওয়ার কথা জানায় র্যাব।
এ বাহিনীর মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ বুধবার বিকালে সাংবাদিকদের বলেন, “জঙ্গি আবদুল্লাহ নিজেই বিস্ফোরণ ঘটায় এবং তাতে তারা নিহত হয়।”
র্যাবের ভাষ্য অনুযায়ী, আবদুল্লাহ ২০০৫ সাল থেকে জেএমবিতে জড়িত। তার বাসায় জঙ্গিদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হত, বিভিন্ন সময়ে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছে। সারোয়ার জাহান, তামিম চৌধুরী, সোহেল মাহফুজের মতো বড় বড় জঙ্গিরাও বিভিন্ন সময়ে আবদুল্লাহর বাসায় থেকে গেছেন।
আবদুল্লাহর সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে ওই বাড়ির মালিক হাবিবুল্লাহ বাহার আজাদ এবং ওই এলাকার নৈশপ্রহরী সিরাজুল ইসলামকে ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব।
‘জঙ্গি আস্তানায়’ বিস্ফোরণের পর লাশ উদ্ধারের ঘটনায় দারুস সালাম থানায় দায়ের করা হয়েছে একটি ‘অপমৃত্যু’ মামলা।
আজাদ ও সিরাজকে সাভার থানায় করা একটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে বলে মুফতি মাহমুদ জানান।
তিনি বলেন, “একজন দুর্ধর্ষ জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, ওই মামলায় তাদের গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।”
তবে সেই জঙ্গি কে বা কী মামলায় এই দুজনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে, সে বিষয়ে কিছু বলেননি র্যাব মুখপাত্র।
এদিকে ভোলা থেকে আব্দুল মালেক নামের এক ব্যক্তি ও তার স্ত্রী নূরজাহান বেগম বৃহস্পতিবার মিরপুরের ওই বাড়ির সামনে আসেন তাদের ছেলে কামালউদ্দিনের (২২) খোঁজে।
নূরজাহান বেগম সাংবাদিকদের জানান, গত ৬ মাস ধরে আব্দুল্লাহর কবুতরের খামারে কাজ করে আসছিলেন কামালউদ্দিন। রাতে থাকতেন মিরপুরের হরিরামপুরে বোনের বাসায়।
“ঈদের আগের রাতে তার ভোলায় যাওয়ার কথা ছিল। পরে বলেছিল মাংস নিয়ে আসবে। কিন্তু শনিবার দিনের বেলায় জানায়, এখনো বেতন হয়নি, বেতন হলে বাড়িতে যাবে।”
আব্দুল মালেক বলেন, শনিবার রাত থেকেই কামালউদ্দিনের ফোন বন্ধ। রোববার ও সোমবারও বন্ধ ছিল। পরদিন টেলিভিশনে আব্দুল্লাহর বাড়িতে র্যাবের অভিযানের কথা জানতে পারেন।
কামালউদ্দিন গত রোজার ঈদে শেষবার বাড়ি গিয়েছিলেন জানিয়ে তার বাবা বলেন, “আমার ছেলেটা কাজ করতে এসে মারা গেল। তারে এখন কই পামু?”
ওই বাড়িতে যে সাতজনের মৃতদেহ পাওয়া গেছে, র্যাবের ধারণা অনুযায়ী তারা হলেন- সন্দেহভাজন জেএমবি সদস্য আবদুল্লাহ, তার দুই স্ত্রী নাসরিন ও ফাতেমা, তিন থেকে নয় বছর বয়সী দুই ছেলে ওমর ও ওসামা এবং আবদুল্লাহর দুই কর্মচারী, যাদের নাম র্যাব জানাতে পারেনি।
মুফতি মাহমুদ খান বলেন, “সাতটি মৃতদেহ সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে কয়লার মতো। তাদের ময়নাতদন্ত হয়েছে। আইডেন্টিফাই করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।… সবাইকে শনাক্ত করতে সময় লাগবে।”
নিহত সাতজনের পোড়া দেহাবশেষ দেখে দুজনকে শিশু হিসেবে শনাক্ত করলেও বাকিদের লিঙ্গ পরিচয় বুঝতে পারেননি ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের সোহেল মাহমুদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখানে এসেছে সাতটি মাথার খুলি এবং কয়েকটি পুড়ে যাওয়া শরীরের বিভিন্ন অংশের হাড়। কোথাও মাংস ছিল না।
“সাতটি খুলির মধ্যে দুটি ছোট হওয়ায় সহজে বোঝা যায় এগুলো শিশুর। তবে বাকি পাঁচটির মধ্যে কোনটি নারীর এবং কোনটি পুরুষের তা বোঝার উপায় নেই।”
ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে পরিচয় শনাক্তের জন্য ওই দেহাবশেষ থেকে নমুনা সংগ্রহ করে দেওয়া হয়েছে বলে সোহেল মাহমুদ জানান।