‘হেফাজতের ধন্যবাদেই বেরিয়েছে থলের বেড়াল’

পাঠ্যপুস্তকে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পরিপন্থি’ পরিবর্তন এনে ‘সাম্প্রদায়িকতা’ প্রবেশ করানো হয়েছে অভিযোগ করে ঢাকায় এক গোলটেবিল সভার আলোচকরা বলছেন, হেফাজতে ইসলামের মতো ‘ধর্মান্ধ গোষ্ঠীকে’ তুষ্ট করতেই এ পরিবর্তন আনা হয়েছে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 Jan 2017, 11:12 AM
Updated : 25 Jan 2017, 01:55 PM

ঢাকার মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট আয়োজিত এই গোলটেবিল আলোচনা থেকে ‘পাঠ্যপুস্তকে সাম্প্রদায়িকীকরণ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পরিপন্থি পরিবর্তন প্রতিরোধে’ সারাদেশে বৃহত্তর শিক্ষা আন্দোলনেরও ডাক এসেছে।

জোটের সাবেক সভাপতি নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু অভিযোগ করেন, শিক্ষাক্ষেত্রে সামন্তবাদী ও সাম্প্রদায়িক চেতনার বিস্তার ঘটেছে।

“আমাদের দেশে তিন ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা-বাংলা মাধ্যম, ইংরেজি মাধ্যম ও মাদ্রাসা। ছোটবেলা থেকেই তাদের আমরা বিভক্তি, বিভাজন শেখাচ্ছি। এখন শেখাচ্ছি সাম্প্রদায়িকতা। এই দ্বিধাবিভক্ত প্রজন্ম কি করে ঐক্যবদ্ধ হবে?”

গত ১ জানুয়ারি শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই যাওয়ার পর তাতে বিভিন্ন ভুল-ক্রটির পাশাপাশি বেশ কয়েকজন লেখক-কবির রচনা বাদ দেওয়ার বিষয়টি জানা যায়। ভুল-ত্রুটি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যমে সমালোচনার পাশাপাশি লেখা বাদ দেওয়ার পেছনে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি থাকার অভিযোগ ওঠে।

‘হেফাজতে ইসলামের মতো ধর্মীয় গোষ্ঠীর’ দাবি বিবেচনায় নিয়েই সরকার পাঠ্যবইয়ে এবারের পরিবর্তন এনেছে বলে গোলটেবিল বৈঠকে অভিযোগ করেন অভিনেতা ও নাট্য সংগঠক রামেন্দু মজুমদার।

তিনি বলেন, “থলের বেড়াল তো হেফাজত নিজেই বের করে ফেলেছে। প্রেস কনফারেন্স করে সরকারকে যখন ধন্যবাদ দিল, তখনই বুঝতে আর বাকি থাকল না। শিক্ষামন্ত্রী সুস্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা না দিলে তিনি পদত্যাগ করুন।”

এ বিষয়ে পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন কমিটির সদস্য নাট্য সংগঠক ইনামুল হক এবং শিক্ষাবিদ অধ্যাপক শাহীন মাহমুদের ‘আশ্চর্য নীরবতার’ সমালোচনা করেন রামেন্দু মজুমদার।

গত ১৪ জানুযারি গণমাধ্যমে বিবৃতি পাঠিয়ে পাঠ্যবইয়ে পরিবর্তনের জন্য সরকারকে ধন্যবাদ জানায় যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চের বিপরীতে দাঁড়িয়ে আলোচনায় আসা হেফাজতে ইসলাম।

পাঠ্যবই থেকে বাদ দেওয়া রচনাগুলোকে ‘নাস্তিক্যবাদ ও হিন্দু তত্ত্বের বিষয়বস্তু সমৃদ্ধ’ ছিল- এমন মন্তব্য করে সংগঠনটির আমির শাহ আহমদ শফী বলেন, হেফাজতের দাবি মেনে স্কুলের এসব রচনা বাদ দেওয়ার ‘প্রশংসনীয় ও ইতিবাচক’ উদ্যোগে ইসলামবিদ্বেষী গোষ্ঠীর গায়ে জ্বালা ধরেছে।

গোলটেবিলে অভিনেতা সৈয়দ হাসান ইমাম অভিযোগ করেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পরিপন্থি শক্তি কৌশলে আওয়ামী লীগে প্রবেশ করে নীতিনির্ধারণে ভূমিকা রাখছে।

“মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাদের কথা শুনবেন? নাকি দুর্দিনে, সংগ্রামে পরীক্ষিত সৈনিক এই সাংস্কৃতিক জোটের কথা শুনবেন,” প্রশ্ন রাখেন তিনি।

নাট্যকার মামুনুর রশীদ বলেন, “প্রাথমিকের পাঠ্যপুস্তক শিশুদের মনে কেমন ইমপ্যাক্ট ফেলে এটা কি সরকার জানে না? এই যে পরিবর্তন, এটা একেবারেই একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। কমিটির দুজনকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। কিন্তু এটা যথেষ্ট নয়, কমিটির সব সদস্যকেই সাসপেন্ড করতে হবে।”

সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুসের সভাপতিত্বে এই গোলটেবিল আলোচনায় ‘পাঠ্যপুস্তকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পরিপন্থি পরিবর্তন প্রতিরোধ’ শীর্ষক ধারণাপত্র পাঠ করেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক।

তিনি বলেন, “গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার তোয়াক্কা না করে শিক্ষা বিশেষজ্ঞ কিংবা গ্রন্থ সম্পাদনায় যুক্ত বিশেষজ্ঞ কারও মতামত না নিয়ে পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তন আনা হয়েছে। ধর্মান্ধ গোষ্ঠীকে তুষ্ট করার লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রতিফলনকারী রচনাগুলো বর্জন করা হয়েছে।”

পাঠ্যপুস্তকের এসব পরিবর্তন জাতিসংঘের স্থায়ী উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ধারা-৪ এর ‘পরিপন্থি’ দাবি করে তিনি বলেন, “এসব পরিবর্তন সুচিন্তা-উদ্ভূত নাগরিক গড়ে তোলার প্রয়াস বিনষ্ট করবে।”

শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী বলেন, “জামায়াত তো সেদিনই স্লোগান দিয়েছে ‘বাংলা হবে আফগান, আমরা হব তালেবান’। সেদিকেই কি দেশ চলে যাবে? প্রশাসনের মধ্যে জামায়াত-বিএনপির চক্রটি টাকা দিয়ে সব কিনে নিচ্ছে। এভাবেই তো এসব হচ্ছে।”

কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ আলোচনায় যোগ দিয়ে প্রাথমিক পর্যায়ের পাঠ্যপুস্তক প্রণেতা, সম্পাদক ও নিরীক্ষকদের নিয়ে একটি গণশুনানি করার দাবি জানান।

পাঠ্যপুস্তকে ‘সাম্প্রদায়িকীকরণের’ ব্যাখ্যা চেয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে ৭২ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়ে তিনি বলেন, “এ সময়ের মধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় যদি কোনো স্পষ্ট ব্যাখ্যা দিতে না পারে, তবে আমরা ভেবে নেব সরকার হেফাজতের দাবি পূরণেই পাঠ্যপুস্তকে এমন পরিবর্তন এনেছে।”

শিক্ষাবিদ ও পেশাজীবীদের সমন্বয়ে একটি বৃহত্তর শিক্ষা আন্দোলন গড়ে তোলার ডাক দিয়ে সাংস্কৃতিক সংগঠক কামাল লোহানী বলেন, “স্বাধীনতার ৪৫ বছর পেরিয়ে গেছে। চিন্তার পরিবর্তনগুলো কেমন করে এলো, তা এখন আমাদের খতিয়ে দেখতে হবে। সর্বজনীন একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ণের দাবি আরও জোরালো করতে হবে।”

সংবাদ সম্মেলনে শেষে পাঁচ দফা দাবি উত্থাপন করেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ।

অবিলম্বে পাঠ্যপুস্তক সংশোধন করে পূর্ববর্তী পাঠ প্রতিস্থাপনে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ, পাঠ্যবই পরিবর্তনের তদন্ত করতে নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন গঠন, দেশের প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বার্ষিক সাংস্কৃতিক সপ্তাহ পালন বাধ্যতামূলক করার দাবি রয়েছে এর মধ‌্যে।