শিশুর চপলতা হারায়নি বায়েজিদ

চার বছরের শিশুর যে স্বাভাবিক আচরণ, কথা বলার ধরন আর দুষ্টুমি, তার সব কিছুই রয়েছে মাগুরার শিশু বায়েজিদ শিকদারের মধ্যে; কেবল তার চেহারায় রয়েছে বুড়িয়ে যাওয়া অস্বাভাবিকতা।

মাগুরার চিকিৎসকের ধারণা, বায়েজিদ ‘প্রোজেরিয়া’ বা ‘হাচিনসন-গিলফোর্ড প্রোজেরিয়া সিনড্রোম’ নামের বিরল এক ধরনের ‘জেনেটিক ডিজঅর্ডারে’ আক্রান্ত।

‘প্রোজেরিয়া’ রোগে আক্রান্তরা স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় আটগুণ দ্রুত বুড়িয়ে যেতে থাকে। বিশ্বে এ রোগে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা দেড়শর কাছাকাছি।

চিকিৎসার জন্য মাগুরার এই শিশু গত শনিবার থেকে ঢাকা মেডিকলে কলেজ হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে। সঙ্গে আছে তার বাবা লাভলু শিকদার, মা তৃপ্তি খাতুন ও নানা মুসিয়ার মেম্বার।

সোমবার সন্ধ্যায় ঢাকা মেডিকেলে কথা হয় শিশু বায়েজিদ ও তার স্বজনদের সঙ্গে।

যে কক্ষে বায়েজিদকে রাখা হয়েছে, সেখানে শিশুদের খেলার বলসহ অন্যান্য সরঞ্জাম রয়েছে। নাম জানতে চাইলে সঙ্গে সঙ্গে নাম বলছে; সঙ্গে বাবা-মার ও গ্রামের নাম, এমনকি থানা ও জেলার নামও বলতে পারছে সে।

বায়েজিদের কণ্ঠস্বরেও তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি; কেবল একটু যেন ভারী।

কয় ভাই-বোন জানতে চাইলে বায়েজিদ উত্তর দেয়- “আমি এক। বাড়ি খালিয়া, থানা মোহাম্মদপুর।”

শিশুটির বাবা-মাও বলছেন, সবকিছুই তার স্বাভাবিক। কোনো জড়তা নেই, চঞ্চলতার ঘাটতি নাই। ক্রিকেট ও ফুটবল বায়েজিদের দারুণ পছন্দ। সন্ধ্যা হলেই চোখে ঘুম নেমে আসে... ঘুম থেকে উঠে পড়ে সকাল ৭টায়।

বায়েজিদের রং মিস্ত্রী বাবা লাভলু শিকদার বলেন, ২০১২ সালের ১৪ মে মাগুরার মেটারনিটি হাসপাতালে তার ছেলে জন্ম। তখন থেকেই তার শরীরের চামড়া ঢিলা দেখা যায়।

পরে মাগুরা সদর হাসপাতালে দেখাতে নিয়ে গেলে সেখানকার চিকিৎসক ঢাকায় আনার পরামর্শ দেন।

একটি শিশুর যতটুকু খাবারের চাহিদা থাকে, বায়েজিদের তাই রয়েছে বলে জানান মা তৃপ্তি খাতুন।

“বাচ্চাদের যেসব অসুখ ঠাণ্ডা জ্বর হয়- আমার ছেলেরও তাই। গ্রামের দোকান থেকে ওষুধ খাওয়ালেই ভালো হয়ে যায়।”

পাশে বসে থাকা নানা মুসিয়ার মেম্বার বলেন, “বায়েজিদ গ্রামে আমার সঙ্গে ঘুরতে বের হয়। তাকে দেখতে বুড়া দেখায়, কিন্তু তার সবকিছুই স্বাভাবিক।”

বাবা লাভলু বলেন, “সেতো আমার সন্তান, আমাকে বাবা বলে ডাকে, তাতেই আমি তৃপ্ত। ভাল হোক আর না হোক, আমাদের ভালোবাসার কমতি নাই।”

তিনি বলেন, “চিকিৎসা করে ভালো হলে ভালো লাগবে... কারণ সে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে।”

বায়েজিদের রোগ সম্পর্কে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চিকিৎসার জন্য  ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদকে প্রধান করে আট সদস্যের একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে বলে ইউনিটের সমম্বয়ক সামন্ত লাল সেন জানান।

তিনি বলেন, “কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা দেওয়া হয়েছে। এই মুহূর্তে কিছু বলা যাবে না, পরীক্ষার ফলাফল এলে পরবর্তীতে তার সম্পর্কে বলা যাবে।”

বায়েজিদকে মাগুরায় দেখেছিলেন সদর হাসপাতালের মেডিসিন কনসালটেন্ট দেবাশীষ বিশ্বাস। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, প্রোজেরিয়া হলে বয়সের তুলনায় আটগুণ বেশি বয়সী দেখায়।

“যে শিশুর বয়স চার, তাকে বত্রিশ বছর বয়সী দেখাবে। আর এই রোগের লক্ষণ সাধারণত জন্মের এক মাস পর থেকে শুরু হয়।”

কিন্তু বায়েজিদের মায়ের কথায়, জন্মের পর থেকেই তার ছেলের চামড়া টিলা বা বেশি বয়সী দেখাচ্ছে।

এ সম্পর্কে দেবাশীষ বলেন, “ধারণা করছি প্রোজেরিয়া রোগেরই অন্য কোনো জেনেটিক ফর্মের কারণে বায়েজিদের এ অবস্থা। তার জন্য জেনেটিক পরীক্ষা প্রয়োজন, এজন্যই তাকে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।”

বিশ্বে ১৪০ জনের মতো প্রোজেরিয়া রোগে আক্রান্ত শিশু রয়েছে জানিয়ে এই চিকিৎসক বলেন, “সাধারণত এই রোগে আক্রান্ত হলে শিশুটি ১০ থেকে ১২ বছর বাঁচে, আর প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে আক্রান্ত হলে ত্রিশ পয়ঁত্রিশ বছর বাঁচে।”