যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেম আলী তার মৃত্যুদণ্ডের চূড়ান্ত রায় পুনর্বিবেচনার যে আবেদন করেছিলেন, তার শুনানি এক মাস পিছিয়ে গেছে আসামিপক্ষের সময়ের আবেদনের কারণে।
Published : 25 Jul 2016, 12:16 PM
ওই রিভিউ আবেদন সোমবার সুপ্রিম কোর্টে শুনানির জন্য এলেও জামায়াতের শুরা সদস্য মীর কাসেমের প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন আদালতের কাছে প্রস্তুতির জন্য দুই মাস সময় চান।
শুনানি শেষে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ সময়ের আবেদন মঞ্জুর করে ২৪ অগাস্ট শুনানির দিন ঠিক করে দেয়। আদেশে বলা হয়, এরপর আর সময় দেওয়া হবে না।
বেঞ্চের অন্য সদস্যরা হলেন- বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার ও বিচারপতি মোহাম্মদ বজলুর রহমান।
মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে আপিলের পূর্ণাঙ্গ রায় ৬ জুন প্রকাশের পর তা পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে ১৯ জুন আবেদন করেন মীর কাসেম। রিভিউ আবেদন শুনানির দিন ধার্যের জন্য আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ।
এ ধারাবাহিকতায় ২১ জুন চেম্বার বিচারপতি বিষয়টি ২৫ জুলাই নিয়মিত বেঞ্চে শুনানির জন্য পাঠান এবং মামলাটি সোমবারের দৈনন্দিন কার্যতালিকায় ৬৩ নম্বর ক্রমিকে আসে।
তবে শুনানির জন্য আরও সময়ের আবেদন করা হবে জানিয়ে মীর কাসেমের ছেলে মীর আহমেদ বিন কাসেম রোববার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, “প্রস্তুতির জন্য দুই মাস সময়ের আবেদন করা হয়েছে। আপিল বিভাগের রায়ে এসেছে, এই মামলায় অভিযোগ গঠনের আদেশ ত্রুটিপূর্ণ।”
সোমবার আদালত শুনানি পিছিয়ে দেওয়ার পর আসামিপক্ষের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, “প্রস্তুতির জন্য আমরা দুই মাস সময় চেয়েছিলাম। আদালত এক মাস দিয়েছে। ২৪ অগাস্ট শুনানির তারিখ দিয়েছে।”
৬৩ বছর বয়সী মীর কাসেম এখন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রয়েছেন। রিভিউ খারিজ হলে এবং তিনি প্রাণভিক্ষা না চাইলে কিংবা আবেদন করে প্রত্যাখ্যাত হলে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরে কোনো বাধা থাকবে না।
২০১৪ সালের ২ নভেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে মীর কাসেমকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এরপর গত ৮ মার্চ আপিলের রায়ে ওই সাজাই বহাল থাকে।
আপিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর ১৫ দিনের মধ্যে ১৯ জুন তা পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করেন মীর কাসেম।
দণ্ড মওকুফ চেয়ে ৮৬ পৃষ্ঠার রিভিউ আবেদনে ১৪টি যুক্তি তুলে ধরেছেন মীর কাসেম। রিভিউ দায়েরের পর তার প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছিলেন, এতে ‘ন্যায়বিচার’ পাবেন বলে তারা ‘প্রত্যাশা’ করছেন।
অন্যদিকে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম অতীত অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে বলেছিলেন, ফৌজদারি মামলায় পুনর্বিবেচনায় রায় বদলের সম্ভাবনা ‘খুবই সীমিত’।
ক্রম অনুসারে বিষয়টি ডাকা হলে ১১টা ৫৫ মিনিটে খন্দকার মাহবুব হোসেন আদালতে বলেন, “একটি আবেদন করা হয়েছে। প্রস্তুতির জন্য সময় প্রয়োজন। আদালতে আসার পথে বুক কাঁপে।”
প্রধান বিচারপতি বলেন, “আপনার বুক কেন কাঁপবে? আপনি সমিতির সাবেক সভাপতি। ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় আপনাকে তো বেশ প্রম্পটলি কথা বলতে দেখা যায়।”
এ সময় খন্দকার মাহবুব বলেন, “একটু ধীরে-সুস্থে প্রস্তুতি নিয়ে শুনানি করতে চাই। এটাই শেষ, তিনি লাস্ট ম্যান (মীর কাসেম)।”
এ পর্যায়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, “শেষ হবে কেন, বিচার তো চলছে।”
খন্দকার মাহবুব বলেন, “শীর্ষ নেতাদের মধ্যে তিনিই শেষ।”
এ সময় আদালত অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্য শুনতে চান। জবাবে মাহবুবে আলম বলেন, “দেড় মাস আগে চেম্বার বিচারপতি শুনানির দিন ঠিক করে দিয়েছে। অনেক সময় দেওয়া হয়েছে।”
আদালত এ সময় আসামিপক্ষের কাছে জানতে চান, সময়ের আবেদনের কারণ কী?
খন্দকার মাহবুব বলেন, “দেশের যে অবস্থা দেখি, তাতে স্বস্তি পাই না। রাস্তায় আসতে গাড়ি সাত-আটবার চেক করা হয়, অস্ত্রের ঝনঝনানি শুনি।”
বিচারক বলেন, “আপনারা আসা-যাওয়ায় ব্যক্তিগত নিরাপত্তার প্রয়োজন হলে বলতে পারেন, ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
এ সময় ‘না সূচক’ জবাব দেন খন্দকার মাহবুব হোসেন।
আদালত বলেন, “আপনি নিশ্চিত করুন- কবে শুনানির জন্য প্রস্তুত হবেন, সে অনুযায়ী তারিখ দেব। এটি দীর্ঘ সময় হতে পারে না। চেম্বার বিচারপতি দীর্ঘ সময় দিয়ে তারিখ নির্ধারণ করেছেন।”
খন্দকার মাহবুবকে উদ্দেশ্য করে প্রধান বিচারপতি বলেন, “আপনি বলুন, নতুবা আমরা একটা সম্ভাব্য সময় ঠিক করে দিচ্ছি, অগাস্টের মধ্যে তারিখ দিতে হবে।”
এক পর্যায়ে আদালত প্রথমে ১৮ অগাস্ট ও পরে ২১ অগাস্ট তারিখ বলেন।
২১ অগাস্ট নিয়ে আপত্তি জানিয়ে খন্দকার মাহবুব বলেন, “না, এটা খারাপ দিন। আমাদের প্রার্থনা ৯ সেপ্টেম্বরের পরে।”
এ সময় অ্যাটর্নি জেনারেল মনে করিয়ে দেন, ৯ সেপ্টেম্বরের পর অবকাশ শুরু হয়ে যাচ্ছে।
আদালত বলেন, “এক মাস সময় দেওয়া হচ্ছে। ২৪ অগাস্ট তারিখ রাখা হল। আর সময় চাইতে পারবেন না।”
যে অভিযোগে ফাঁসি অভিযোগ ১১: ১৯৭১ সালে ঈদুল ফিতরের পরের যে কোনো একদিন মীর কাসেমের পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে আলবদর বাহিনীর সদস্যরা চট্টগ্রাম শহরের কোনো এক অজ্ঞাত স্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধা জসিমকে অপহরণ করে আন্দরকিল্লার ডালিম হোটেলে নিয়ে যায়। তাকে ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত সেখানে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনের ফলে জসিমের মৃত্যু হলে আরো পাঁচজন অজ্ঞাত ব্যক্তির লাশসহ তার মৃতদেহ কর্ণফুলী নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। ট্রাইব্যুনালে তিন বিচারকের ঐক্যমতের ভিত্তিতে এ অভিযোগে মীর কাসেমের ফাঁসির রায় হয়। আপিলেও তা বহাল থাকে। এছাড়া আরও ছয় অভিযোগে মোট ৫৮ বছরের কারাদণ্ডের রায় বহাল রাখে আপিল বিভাগ। |
যুদ্ধাপরাধে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিতদের মধ্যে মীর কাসেমের আগে রিভিউ করে বিফল হয়েছিলেন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মো. মুজাহিদ, মো. কামারুজ্জামান ও আব্দুল কাদের মোল্লা।
রিভিউ খারিজের পর তাদের সবার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। সর্বশেষ গত মে মাসে নিজামীর রিভিউ আবেদন খারিজের ছয় দিনের মাথায় তাকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়।
একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ২০১২ সালের ১৭ জুন মতিঝিলে নয়া দিগন্ত কার্যালয় থেকে কাসেমকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরের বছর ৫ সেপ্টেম্বর অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় তার যুদ্ধাপরাধের বিচার।
এ মামলার শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষ মীর কাসেমকে আখ্যায়িত করেছে পাকিস্তানের খান সেনাদের সঙ্গে মানবতাবিরোধী অপরাধে লিপ্ত হওয়া ‘বাঙালি খান’ হিসাবে, যিনি সে সময় জামায়াতের তখনকার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের পূর্ব পাকিস্তান শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতায় ছাত্রসংঘের বাছাই করা সদস্যদের নিয়ে গঠিত সশস্ত্র আলবদর বাহিনীর চট্টগ্রাম অঞ্চলের কমান্ডার হিসেবে মীর কাসেম যেসব মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটান, তা উঠে এসেছে রায়ে।
ডালিম হোটেল ছাড়াও নগরীর চাক্তাই চামড়ার গুদামের দোস্ত মোহাম্মদ বিল্ডিং, দেওয়ানহাটের দেওয়ান হোটেল ও পাঁচলাইশ এলাকার সালমা মঞ্জিলে বদর বাহিনীর আলাদা ক্যাম্প ও নির্যাতন কেন্দ্র ছিল সে সময়।
ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মীর কাসেম ১৯৮৫ সাল থেকে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ অর্থাৎ মজলিসে শূরার সদস্য হিসেবে দলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছিলেন। তিনি হলেন জামায়াতের পঞ্চম শীর্ষ নেতা, চূড়ান্ত রায়েও যার সর্বোচ্চ সাজার সিদ্ধান্ত এসেছে।