নিজের নির্বাচনী এলাকায় বেসরকারি স্কুল ও কলেজে ব্যবস্থাপনা কমিটিতে সংসদ সদস্যদের সভাপতি হওয়ার অবাধ সুযোগে একটি ধাক্কা এসেছে।
Published : 01 Jun 2016, 08:56 PM
আদালত বুধবার এক রায়ে আইনপ্রণেতাদের নিজের নিজের নির্বাচনী এলাকার মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গভর্নিং বডি ও ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি মনোনীত হওয়ার বিধানটি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করেছে।
একইসঙ্গে ২০০৯ সালের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডি ও ম্যানেজিং কমিটি প্রবিধানমালার বিশেষ কমিটি গঠনের ৫০ বিধানটিও সাংঘর্ষিক ঘোষণা করেছে আদালত।
এ সংক্রান্ত রুলের ওপর চূড়ান্ত শুনানি শেষে বিচারপতি জিনাত আরা ও বিচারপতি এ কে এম জহিরুল হকের হাই কোর্ট বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন।
রায়ে বলা হয়, ওই দুটি বিধান সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদ, ১৯৬১ সালের অর্ডিনেন্স এবং ওই প্রবিধানমালার মূল চেতনার সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ বলে অবৈধ ঘোষণা করা হল। অর্ডিন্যান্সে এ বিষয়ে সর্বোচ্চ ক্ষমতা দেওয়া আছে বোর্ডকে। অথচ ৫ বিধানের মাধ্যমে এই ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছে।
তবে সংসদ সদস্যরা এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কমিটিতে থাকবেন কি থাকবেন না, কীভাবে থাকবেন- তা শিক্ষা বোর্ডের সিদ্ধান্ত সাপেক্ষ বিষয় বলে রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে।
যার রিট আবেদনে এই রায় হয়েছে, সেই আইনজীবী ইউনুছ আলী আকন্দ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, “এর ফলে এমপিরা এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি হতে পারবেন না।”
তবে রায়ের ব্যাখ্যায় এ নিয়ে ভিন্নমত জানিয়েছেন আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ইসরাত জাহান।
তিনি বলেছেন, “এমপিরা সভাপতি নির্বাচিত হতে পারবেন। তবে ইচ্ছা অনুসারে সভাপতি হতে পারছেন না।”
‘ক্ল্যারিফিকেশনের জন্য’ হাই কোর্টের এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আবেদন করা হবে বলে জানান এই ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল।
রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল ও কলেজ পরিচালনার জন্য গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর বিশেষ কমিটি গঠনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইউনুছ আকন্দ চলতি বছর রিট আবেদনটি করেছিলেন।
তার যুক্তি, ওই প্রবিধানমালার ৩৯ বিধান অনুসারে এডহক কমিটির মেয়াদ ছয় মাস। অথচ ভিকারুননিসা নূন স্কুল ও কলেজ এ পর্যন্ত চার বার এডহক ও দুই বার বিশেষ কমিটি গঠন করা হয়। এটি ৩৯ বিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
এই রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ১৯ জানুয়ারি হাই কোর্ট রুল দেয়। রুলে ওই কমিটি কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়।
এরপর ২০০৯ সালের মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডি ও ম্যানেজিং কমিটি প্রবিধানমালা এর ৫ ও ৫০ বিধানের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে সম্পূরক আবেদন করেন ইউনুস আলী।
বিধান ৫ তে গভর্নিং বডির সভাপতি মনোনয়ন বিষয়ে এবং বিধান ৫০ বিশেষ ধরনের গভর্নিং বা ম্যানেজিং কমিটি গঠনের বিষয়ে বলা আছে।
রিট আবেদনকারীর যুক্তি ছিল, ওই দুটি বিধান ১৯৬১ সালের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক অধ্যাদেশের ৩৯(২)(৬) এবং সংবিধানের ১১, ২৬, ২৭, ৩১ ও ৬৫ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
সম্পূরক এই আবেদনের শুনানি নিয়ে ওই দুই বিধান বিষয়ে ৬ এপ্রিল আরেকটি রুল দেয় হাই কোর্ট।
এসব রুলের ওপর চূড়ান্ত শুনানি শেষে বুধবার বিচারপতি জিনাত আরা ও বিচারপতি এ কে এম জহিরুল হকের হাই কোর্ট বেঞ্চ এই রায় দেয়।
আদালত ভিকারুননিসা পরিচালনায় গঠিত বিশেষ কমিটি অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে নতুন করে এডহক কমিটি করে ৬ মাসের মধ্যে নির্বাচন দিতে বলেছে।
প্রবিধানমালার ২ বিধান
১৯৬১ সালের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক অধ্যাদেশের ৩৯ এর ক্ষমতাবলে ২০০৯ সালের ৮ জুন ‘মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডি ও ম্যানেজিং কমিটি প্রবিধানমালা-২০০৯’ প্রণয়ন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
এর ৫ বিধানে গভর্নিং বডির সভাপতি মনোনয়ন এবং ৫০ বিধানে বিশেষ ধরনের গভর্নিং বা ম্যানেজিং কমিটি গঠন বিষয়ে বলা রয়েছে।
গভর্নিং বডির সভাপতি মনোনয়ন : (১) কোনো স্থানীয় নির্বাচিত সংসদ সদস্য তাহার নির্বাচনী এলাকায় অবস্থিত বোর্ড কর্তৃক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত এমন সংখ্যক উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডির সভাপতির দায়িত্বগ্রহণ করিতে পারিবেন যেন ওই এলাকায় অবস্থিত , এই প্রবিধানমালার আওতাভুক্ত নয় এরূপ অন্যান্য বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ , তাহার এরূপ দায়িত্ব গ্রহণ করা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা চার এর অধিক না হয়।
(২) উপ-বিধান ১ এর অধীন সভাপতির দায়িত্বগ্রহণের জন্য স্থানীয় নির্বাচিত সংসদ সদস্য, তাহার নির্বাচনী এলাকায় অবস্থিত যে সকল উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব গ্রহণ করিতে ইচ্ছুক তাহার উল্লেখসহ লিখিতভাবে এই প্রবিধানমালার অধীন বোর্ডের চেয়ারম্যানের নিকট তাহার অভিপ্রায় ব্যক্ত করিবেন এবং উক্ত অভিপ্রায়পত্র সংশ্লিষ্ট বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা প্রতিষ্ঠানসমূহের সভাপতি হিসেবে তাহার মনোনয়নরূপে গণ্য হবে।
বিধান ৫০ এ রয়েছে: “বিশেষ ধরনের গভর্নিংবডি বা ম্যানেজিং কমিটি-বিশেষ পরিস্থিতিতে বোর্ড এবং সরকারের পূর্বানুমোদনক্রমে, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের কোনো বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য বিশেষ ধরনের গভর্নিং বডি বা, ক্ষেত্রমতে ম্যানেজিং কমিটি করা যাইবে।
বাংলাদেশের সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদে রয়েছে প্রশাসনে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণের বিষয়ে।
অনুচ্ছেদ ১১: প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে।
আইনজীবীদের বক্তব্য
ইউনুছ আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, রায়ে বলেছে ভিকারুননিসা নূন স্কুল ও কলেজ পরিচালনায় গঠিত বিশেষ কমিটি বাতিল, বিশেষ কমিটি গঠনের ধারা ৫০ তাও বাতিল। যে বিধান বলে সংসদ সদস্যারা ইচ্ছা করলেই সভাপতি হতে পারত ওই ধারাটিও বাতিল।
পুরো বিধান (৫) বাতিল হয়েছে কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমি চেয়েছে ৫ ধারাটি বাতিল, রুল অ্যাবসলিউট (যথাযথ)... অর্থাৎ সম্পূর্ণ বাতিল হয়ে গেল।
“এর ফলে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এমপিরা সভাপতি থাকতে পারবে না। এখন থেকে কোনো বিশেষ কমিটি হবে না। এখন থেকে যেসব বিশেষ কমিটি বহাল রয়েছে, সেটিও অবৈধ হবে, যেহেতু আইন অবৈধ হয়ে গেছে, কমিটিও অবৈধ।”
“আইডিয়াল স্কুলের বিশেষ কমিটি, উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের বিশেষ কমিটি তাও অবৈধ হবে।.. রাশেদ খান মেনন এই তিনটি বিদ্যালয়ের সভাপতি। ..যেহেতু আইনই নাই, যে আইনে বিশেষ কমিটি, আইন না থাকলে কমিটি থাকবে কি ভাবে ?-এটি আমার মত,” বলেন ইউনুছ আলী।
অন্যদিকে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ইসরাত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রবিধানের ৫(১) বহাল রয়েছে। ফলে ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি হিসেবে সংসদ সদস্যরা নির্বাচিত হয়ে আসতে পারবেন। তবে প্রবিধানের ৫(২) অনুসারে ইচ্ছা অনুসারে সভাপতি হওয়ার সুযোগ থাকছে না।”
বিশেষ কমিটি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিশেষ কমিটি রয়েছে, যেখানে কমিটি গঠনের সময় এর মেয়াদ উল্লেখ রয়েছে সেসব ক্ষেত্রে মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তারা থাকতে পারছে, যদি না কেউ সংক্ষুব্ধ হয়ে এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করবে। তবে এই রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে নতুন করে আর বিশেষ কমিটি গঠন করা যাচ্ছে না।”