অস্বাভাবিক মৃত্যুর পর খাবারে বিষক্রিয়ার সন্দেহের মধ্যে ময়নাতদন্তে হত্যার আলামত পাওয়ার ঘটনায় ‘স্তম্ভিত’ বলে জানিয়েছেন রাজধানীর রামপুরার ওই শিশু দুটির পরিবারের সদস্যরা।
Published : 02 Mar 2016, 10:43 PM
ভাই-বোনকে হত্যা করা হয়েছে ধরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তদন্ত শুরু করলেও কী কারণে তারা হত্যাকাণ্ডের স্বীকার হবে, সে বিষয়ে কোনো ধারণাও দিতে পারছে না স্বজনরা।
দুই শিশুর মামা খোকন বুধবার রাতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ওদের মৃত্যুর ঘটনায় স্তম্ভিত হয়ে পড়েছি। এ মৃত্যু মেনে নেওয়া কঠিন। কীভাবে কী হল, কিছু বুঝতে পারছি না।”
গত সোমবার বিকালে বনশ্রীতে নিজেদের বাসায় দুই শিশু নুসরাত আমান অরণী (১৪) এবং তার ভাই আলভী আমানকে (৬) বিছানায় মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।
বনশ্রীর বি ব্লকের চার নম্বর রোডের নয় নম্বর বাসায় বাবা আমানুল্লাহ ও মা মাহফুজা মালেক জেসমিনের সঙ্গে তারা থাকত।
শিশু দুটিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর পরিবারের পক্ষ থেকে খাবারে বিষষ্ক্রিয়ার কথা বলা হয়েছিল। পরদিন ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকরা হত্যার আলামত পাওয়ার কথা জানান।
মৃত্যুর পর সন্তানদের মরদেহ ময়নাতদন্ত না করে গ্রামের বাড়ি জামালপুরে নিয়ে যেতে চাইছিলেন আমানুল্লাহ দম্পতি।
কিন্তু তা করতে না পারার পর মঙ্গলবার সকালে তারা বাড়িতে রওনা হন। পরে তাদের সন্তানদের লাশ নিয়ে পরিবারের সদস্যরা জামালপুরে নিয়ে যান।
এরপর র্যাব-৩ এর একটি দল জামালপুর থেকে আমানুল্লাহ, মাহফুজা এবং মাহফুজার বোন আফরোজা মিলাকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ঢাকায় রওনা হয়।
মাহফুজা ও আমানুল্লাহ সম্পর্কে চাচাত ভাই-বোন। ১৫ বছর আগে পারিবারিক সম্মতিতে তাদের বিয়ে হয়েছিল।
হত্যাকাণ্ডের আলামত পাওয়ার পর নানা সন্দেহের কথা আসছে এলাকাবাসীর কথায়। পারিবারিক বিরোধের বিষয়টিও তদন্তের আওতায় রাখা হচ্ছে বলে জানান রামপুরা থানার ওসি রফিকুল ইসলাম।
পারিবারিক কোনো বিরোধ ছিল কি না- জানতে চাইলে শিশু দুটির মামা খোকন বলেন, “আপনারা (সাংবাদিক) বারবার ফোন করে একই ঘটনা জানতে চাইছেন। প্লিজ এমন করবেন না।”
বলার পর কলটি কেটে দেন তিনি। তারপর তার মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
তার আগে কথা বলার সময় খোকন জানিয়েছিলেন, তার বোন ও ভগ্নিপতি র্যাবের কাছে আছেন।
তারা এখন কোথায়- জানতে চাইলে র্যাব-৩ এর র্যাব-৩ এর মিডিয়া অফিসার আবদুল করিম রাত সাড়ে ১০টায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখনও তারা জামালপুর থেকে ঢাকায় এসে পৌঁছায়নি।”
অরণী ও আলভীকে সোমবার হাসপাতালে নেওয়ার পর তাদের খালা আফরোজা মিলা সাংবাদিকদের বলেছিলেন,“গতকাল (রোববার) রাতে তারা একটি চাইনিজের দোকানে ফাস্টফুড খেয়েছিল। এরপর বাসায় গিয়ে তারা ঘুমিয়ে পড়ে। তারা সোমবার দুপুরে আবারও চাইনিজ খাবারের অবশিষ্ট অংশ গরম করে খেয়েছিল। এরপর ঘুমিয়ে পড়লে আর ঘুম থেকে ওঠেনি।”
তৈরি পোশাক ব্যবসায়ী আমানুল্লাহর বন্ধু জাহিদ হাসানও হাসপাতালে ছিলেন। বন্ধুর ফোন পেয়ে তিনি বাড়িতে গিয়ে পরিস্থিতি দেখে শিশু দুটিকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছিলেন।
জাহিদ বলেছিলেন, আমানুল্লাহ তাকে ফোন করে বলেছিলেন- ‘তোমার ভাবি কেন যেন কান্নাকাটি করছে, কিছু বলছে না। একটু বাসায় গিয়ে দেখে আসতে পারবা কী হয়েছে?’
জাহিদের বাসা বনশ্রীর বি ব্লকের দুই নম্বর রোডে। তার বাড়িও জামালপুর। এক দশক ধরে তার সঙ্গে আমানুল্লাহর বন্ধুত্ব।
তিনি বুধবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তাদের ব্যক্তিগত বিষয়ে কিছু জানা নেই। তবে যতদূর জানি তার কারও সঙ্গে তেমন বিরোধ নেই।
“আসলে বিষয়টা যে কীভাবে ঘটল, কিছুই বুঝতে পারছি না। আমি সত্যিই হতবাক হয়ে গেছি।”
অরণী ও আলভীর মৃত্যুর পর জামালপুর গেলেও সেখানে আমানুল্লাহ ও মাহফুজার সঙ্গে তেমন কোনো কথা হয়নি বলে জানান জাহিদ।
“ওখানে গাড়ি থেকে নেমে জানাজা পড়ি। কারও সঙ্গে তেমন কোনো কথা হয়নি। শুনতে পারলাম র্যাব আমানুল্লাহ ভাই, তার স্ত্রী ও শালিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে গেছে।”
ঢাকায় আমানুল্লাহর প্রতিবেশী কিংবা বাড়ির মালিকও কোনো ধারণা দিতে পারেননি।
‘হত্যাজনিত’ মৃত্যুর সন্দেহের কথা জানিয়ে ঢাকা মেডিকেলের ফরেনসিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ সোহেল মাহমুদ বলেন, দুটি বাচ্চার গলায় তারা ‘দাগ’ পেয়েছেন। সেখানে আঙুলের ছাপও ছিল। থুতনিসহ বিভিন্ন জায়গায় আঘাতের চিহ্ন ছিল। দুজনেরই জিহ্বায় কামড় লেগে ছিল।
শিশু দুটির বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কয়েকদিন আগে আলভীর হাতে আঘাতের চিহ্ন দেখা গিয়েছিল। তাকে জিজ্ঞাসা করলে সে জানিয়েছিল, মা মেরেছে। চোখে জমাট রক্ত ছিল অরণীর, যা কলমের খোঁচায় হয়েছিল বলে বন্ধুদের জানিয়েছিল সে।
হত্যাকাণ্ডের আলামত পাওয়ার পর পুলিশ ঘর থেকে কিছু আলামত সংগ্রহ করেছে। এসব আলামতের ডিএনএ প্রোফাইলিং ও রাসায়নিক পরীক্ষার জন্য আদালতের অনুমতিও নিয়েছে পুলিশ।
রামপুরা থানার ওসি রফিকুল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর ‘পারিবারিক বিরোধ’সহ অন্যান্য বিষয়গুলোকে তদন্তের মধ্যে আনবেন তারা।
ময়নাতদন্তে হত্যার আলামত পাওয়ার পর মঙ্গলবারই ভবনের দুই দারোয়ান, গৃহশিক্ষিকা এবং এক আত্মীয়কে জিজ্ঞাসাবাদ করে র্যাব-৩।
মা, বাবা, খালাকে জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়ে র্যাব-৩ এর অধিনায়ক খন্দকার গোলাম সরোয়ার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কীভাবে শিশুদের মৃত্যু হয়েছে সেটি জানতে তাদের আনা হচ্ছে। তাদের থেকে জানতে চাওয়া হবে আসলে কীভাবে তাদের সন্তানরা মারা গেল।”
“আমরা সন্দেহ করছি অনেক কিছু,” বলেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল।