স্বাধীন ভারতে আসাম রাজ্য সরকার বাঙালি অধ্যুষিত বরাক উপত্যকায় অহমিয়া ভাষার আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করলে আরেক ভাষা আন্দোলনের সূচনা হয়।
Published : 21 Feb 2023, 11:00 AM
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের মত বাংলা ভাষার অধিকারের দাবিতে রক্ত ঝরেছিল ভারতীয় উপমহাদেশের আরও এক শহরে, ঠিক ৯ বছর পর আসামের বরাক উপত্যকার শিলচরে প্রাণ দিয়েছিলেন ১১ তরুণ।
মাতৃভাষা বাংলাকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় প্রথম রক্ত দেন সালাম, বরকত, শফিক ও জব্বারসহ নাম না জানা অনেকে। আর স্বাধীন ভারতে বাংলা ভাষার জন্য প্রথম রক্ত দেওয়ার প্রথম ঘটনা ঘটে ১৯৬১ সালের ১৯ মে।
ভারত ভাগের আগে বরাক উপত্যকায় ছিল মূলত বৃহত্তর কাছাড় জেলা। পরে কাছাড় জেলাকে ভেঙে কাছাড়, করিমগঞ্জ এবং হাইলা কান্দি জেলা হয়। বাংলাদেশের সিলেট সংলগ্ন আসামের দক্ষিণ সীমান্তে ওই এলাকার অবস্থান।
সে সময় বরাক উপত্যকায় প্রায় চল্লিশ লাখ নাগরিকের বসবাস ছিল, যাদের ৮০ শতাংশই ছিলেন বাংলাভাষী। অহমিয়াদের তুলনায় শিক্ষা, ভাষা ও সংস্কৃতিতেও বাঙালিরা ছিল অগ্রসর।
ভারতের স্বাধীনতার পর থেকে আসামের রাজনৈতিক শাসকরা বিভিন্নভাবে বাঙালি ও বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে নানা পদক্ষেপ নিতে শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৬০ সালে আসম প্রদেশ কংগ্রেস সিদ্ধান্ত নেয়, অহমিয়া ভাষাই হবে রাজ্যের একমাত্র দাপ্তরিক ভাষা।
এরপর শুরু হয় প্রতিবাদ। পূর্ব পাকিস্তানে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের চেতনায় বরাকের বাঙালিরাও আন্দোলনে শামিল হন। বাংলা ভাষার স্বীকৃতির দাবিতে সেই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে বরাক উপত্যকাজুড়ে।
ওই আন্দোলনের মধ্যেই অহমিয়া ভাষাকে একমাত্র দাপ্তরিক ভাষা ঘোষণা করে ১৯৬০ সালের অক্টোবরে আইন পাস করা হয় প্রাদেশিক পরিষদে। এর জের ধরে ১৯৬১ সালে প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে ওঠে বরাক উপত্যকা।
ফেব্রুয়ারিতে কাছাড় গণসংগ্রাম পরিষদ গঠিত হলে বাংলা ভাষার স্বীকৃতির দাবিতে আন্দোলন নতুন গতি পায়। বরাকের কাছাড়, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দিতে ১৪ এপ্রিল পালিত হয় সংকল্প দিবস।
গণসংগ্রাম পরিষদের নেতা রবীন্দ্রনাথ সেন ১৯ মে হরতালের ডাক দেন। তাতে দমন-পীড়ন আরও বাড়ে। রবীন্দ্রনাথ সেন, নলিনীকান্ত দাশ, বিধুভূষণ চৌধুরীসহ ভাষা আন্দোলনের প্রথম সারির নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয় ১৮ মে।
১৯ মে হরতাল শুরু হলে কাছাড়, করিমগঞ্জ ও হাইলা কান্দি জেলায় সরকারি অফিস, আদালত ও রেলওয়ে স্টেশনে অবস্থান নেয় জনতা। পরিস্থিতি সামাল দিতে রাজ্য সরকার জেলা শহরগুলোতে পুলিশের টহল নামায়। হরতালকারীদের গ্রেপ্তার করা শুরু হলে উত্তেজনা বাড়তে থাকে।
পুলিশের একটি দল গ্রেপ্তার কয়েকজনকে ট্রাকে তুলে শিলচর রেলওয়ে স্টেশনের পাশ দিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় উত্তেজিত জনতা সেটি ঘেরাও করে ফেলে। পরে আগুন দেওয়া হয় ওই ট্রাকে। স্টেশনে থাকা আধাসামরিক বাহিনীর সদস্যরা তখন আন্দোলনরতদের ওপর চড়াও হয়।
এক পর্যায়ে চালানো হয় গুলি। ঘটনাস্থলেই লুটিয়ে পড়েন নয়জন ভাষাসৈনিক। পরে আরও দুজনের মৃত্যু হয়।
সেদিন ভাষার জন্য শহীদ হন, কানাইলাল নিয়োগী, চণ্ডীচরণ সূত্রধর, হীতেশ বিশ্বাস, সত্যেন্দ্র দেব, কুমুদরঞ্জন দাস, সুনীল সরকার, তরণী দেবনাথ, শচীন্দ্র চন্দ্র পাল, বীরেন্দ্র সূত্রধর, সুকমল পুরকায়স্থ এবং কমলা ভট্টাচার্য।
ওই রক্তদানে মর্যাদা পায় বাংলা। ১৯৬১ সালের অক্টোবরে আইন সংশোধন করে বাংলাকে কাছাড়, করিমগঞ্জ ও হাইলা কান্দি জেলায় দাপ্তরিক ভাষার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
অবশ্য পরেও অনেকবার ভাষার জন্য ওই জনপদের মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে। বাহাত্তরে একজন, ছিয়াশিতে দুজন আর ১৯৯৬ এ বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি ভাষার জন্য প্রাণ দেন সুদেষ্ণা সিনহা নামে এক তরুণী।
অর্ধশতকের বেশি সময় পর পুলিশের গুলিতে প্রাণ দেওয়া ভাষা সৈনিকদের শহীদের মর্যাদা দেওয়া হয় সরকারিভাবে। ২০১৬ সালে শিলচর রেলওয়ে স্টেশনের নাম রাখা হয় ভাষা শহীদ স্টেশন।