কিংবদন্তি শচীন দেববর্মণের কুমিল্লার পৈত্রিক বাড়িটি পুরাকীর্তি হিসেবে সংরক্ষণেরও উদ্যোগ আছে, কিন্তু বাস্তবায়ন?
Published : 30 Jul 2022, 07:07 PM
গত মাসের মাঝামাঝি এক রাতে যাওয়া হয়েছিল ‘নিশীথে যাইও ফুলবনে’ গানটির গায়ক শচীন দেববর্মণের বাড়িতে। শেখ ভানুর লেখা এবং জসীমউদ্দীনের সংগ্রহ করা ওই গানে নিশীথ শব্দটি যতটা গভীর রাতের দ্যোতনা তৈরি করে, তখনও তত রাত হয়নি। বিনে বাধায় গেট ঠেলে ঢুকতেই নাকে লাগল তীব্র গন্ধের ধাক্কা। সঙ্গী বললেন, “মনে হয়, ইয়াবাখোররা আসর বসিয়েছে। আর ভেতরে যাওয়া ঠিক হবে না।”
সর্বসাধারণ্যে ‘শচীন কর্তা’ নামে পরিচিত বাংলা ও হিন্দি গানের প্রবাদ পুরুষ শচীন দেববর্মণের জন্মভিটেটি সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে ২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর গেজেট করা হয়েছে। এই বাড়িটি সংরক্ষণ করে সেখানে একটি সংস্কৃতি কেন্দ্র ও জাদুঘর করার অঙ্গীকার ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। তিনি ২০১২ সালে ত্রিপুরা সফরে যাওয়ার পর সেখানকার লেখক ও সংস্কৃতিকর্মীদের দাবিতে এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছিলেন।
পরে ২০১৫ সালের ২৪ মার্চ কুমিল্লায় একটি বইমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাড়িটি সংস্কার এবং একে সংস্কৃতি কেন্দ্রে রূপান্তরের জন্য এক কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়ার ঘোষণা দেন তৎকালীন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। ওই বছরই ২৫ মে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১১৬তম জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে যোগ দিতে কুমিল্লায় গিয়ে প্রধানমন্ত্রী সাতটি প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন, যার একটি ‘শচীন দেববর্মণ কালচারাল কমপ্লেক্স’।
রাতবিরেতে ঢুকতে গিয়ে ভয় হলেও পরের দিন সকালে আর তেমনটা হল না। তবে স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপে জানা গেল, কুমিল্লা শহরের চর্থা এলাকার এই বাড়িটিতে শুধু রাতে নয়, মাঝেমধ্যে দিনদুপুরে মাদকাসক্তরা আসর বসায়।
বাড়িটি তত্ত্বাবধানের জন্য জেলা প্রশাসন এবং প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের দুজন কর্মী নিযুক্ত আছেন। পরপর দুদিন দিনে এবং রাতে সেখানে গিয়ে কোনো পাহারাদারের দেখা পাওয়া গেল না। কুমিল্লার জেলা প্রশাসক এবং প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালকের সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেল, এ দায়িত্বটি কার, তা এখনও অমীমাংসিত রয়ে গেছে।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামরুল হাসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, জেলা প্রশাসনের দায়িত্ব ছিল বাড়িটি সংস্কার করে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কাছে ন্যস্ত করার। সংস্কার কাজ অনেক আগেই সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এখনও সাইটটি বুঝে নেয়নি বলে জেলা প্রশাসন এখনও দেখভালের দায়িত্ব পালন করছে।
পাহারাদারকে কেন সেখানে পাওয়া যায় না খোঁজ নেবেন বলে জানালেন জেলা প্রশাসক।
প্রত্মতত্ত্ব অধিদপ্তরের কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের আঞ্চলিক পরিচালক এ কে এম সাইফুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে সাইটটি বুঝে পাওয়ার জন্য ঢাকা থেকে চিঠি দেওয়া হবে।”
তবে এখনও দৈনিক মজুরিতে নিয়োগপ্রাপ্ত একজন কর্মী বাড়িটি পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্ব পালন করেন বলে জানালেন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালক।
পরিচ্ছন্নতা কর্মীর দায়িত্বে অবহেলার উদাহরণ বাড়িটির সর্বত্রই রয়েছে।
বাড়ির মূলভবনের সামনে নির্মিত শচীন কর্তার ম্যুরালে জমে আছে ধুলোবালির স্তর। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ করা এক কোটি টাকায় বাড়িটি সংস্কার, বাড়িতে ম্যুরাল নির্মাণসহ দেওয়া হয়েছে সীমানা দেয়াল। দেয়ালগুলোতে লেখা আছে শচীন কর্তার বিখ্যাত সব গানের লাইন- ‘তুমি এসেছিলে পরশু, কাল কেন আসোনি’, ‘শোনো গো দখিনা হাওয়া প্রেম করেছি আমি’, ‘তোরা কে যাসরে ভাটি গাঙ বাইয়া’, ‘টাকডুম টাকডুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল’ ইত্যাদি। সঙ্গে অলঙ্করণও করা হয়েছে। তবে এই সব অলঙ্করণ অযত্নে বিবর্ণ হয়ে এসেছে।
কোটি টাকা ব্যয়ে জরাজীর্ণ বাসভবনটিকে দেখনসই করা হয়েছে। তবে পেছনের দিকে যেতেই দেখা গেল, দরজাটা হাট হয়ে খোলা। এখানে-ওখানে সিগারেটের প্যাকেটের পোড়া ফয়েল পড়ে আছে, যা দেখে বোঝা যায় কাগজগুলো ইয়াবা খাওয়ার কাজে ব্যবহৃত হয়েছে।
কবি পিয়াস মজিদ অবশ্য এই পরিস্থিতিটাকে আগের চেয়ে অনেক ভালো বলে মন্তব্য করলেন। কুমিল্লা শহরে শৈশব-কৈশোর কাটানো তরুণ এই কবি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ছোটবেলায় আমরা প্রায় নিয়মিতই ওখানে যেতাম। তবে দলবল সঙ্গে না থাকলে যাওয়ার সাহস পেতাম না। হাড় জিরজিরে একটা ভবন শচীন দেববর্মণের স্মৃতিচিহ্ন হয়ে ছিল তখন। একটা ফলকে লেখা ছিল- এখানে একদা কাজী নজরুল ইসলাম এসেছিলেন।”
লেখক-গবেষক আহসানুল কবীর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শুধু নজরুল নয়। শচীন কর্তাদের ওই বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত ছিল সুরসাগর হিমাংশু দত্তের। অজয় ভট্টাচার্য, মোহিনী চৌধুরী, সমরেন্দ্র পাল, শৈলবালা দেবী, সৌরেন দাশ, ওস্তাদ জানে আলম চৌধুরী, মোহাম্মদ হোসেন খসরু। গানের কত শত মানুষ এই বাড়িতে আসতেন। গত শতকের বিশের দশকের ওই সময়টা ছিল কুমিল্লায় সংস্কৃতি চর্চার স্বর্ণোজ্জ্বল সময়।”
কুমিল্লার ইতিহাস নিয়ে গবেষণার জন্য খ্যাত এই লেখক ‘রাজমালা’সহ ত্রিপুরা অঞ্চলের ইতিহাসের কিছু আকররগ্রন্থের উল্লেখ করে বলেন, শচীন দেব বর্মণ ১৯০৬ সালের কুমিল্লার দক্ষিণ চর্থায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলা রাজপরিবারের রাজকুমার নবদ্বীপ চন্দ্র দেববর্মণ।
তার ভাষ্যে, বাবার তত্ত্বাবধানের শচীন দেবের সংগীত প্রতিভার বিকাশ ঘটে শৈশব থেকে। শচীন কর্তার বাবা ছিলেন একজন সেতারবাদক ও ধ্রুপদি সংগীতশিল্পী। পড়াশোনা শুরু হয়েছিল কুমিল্লা ইউছুফ স্কুলে। এরপর জিলা স্কুল। সেখান থেকে ম্যাট্রিক এবং কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ থেকে বিএ পাস করেন।
দেববর্মণদের এই পরিবারটি কুমিল্লায় সামাজিকভাবেও যথেষ্ট প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন। শচীন কর্তার বাবা নবদ্বীপ দেববর্মণ কুমিল্লা পৌরসভার চেয়ারম্যানও নির্বাচিত হয়েছিলেন।
আহসানুল বলেন, “প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের কারণে শচীনের বাবা সপরিবারে কুমিল্লা চলে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। তাদের সেখানে প্রথমে আশ্রয় দিয়েছিলেন নবাব ফয়জুন্নেছার স্বামী গাজী চৌধুরী। তবে ব্রিটিশ আদালতের নির্দেশে ত্রিপুরার রাজপরিবার নবদ্বীপ চন্দ্র দেববর্মণের বাড়ি নির্মাণ এবং মাসিক পারিতোষিক দিতে বাধ্য হয়েছিলেন।”
স্থপতি ড. আবু সাঈদ এম আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রাজবাড়ি বলে পরিচিত বাড়িটি বহুকাল ধরে অবহেলায় জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে ছিল। এই পোড়োবাড়িটা আমরা যতটা সম্ভব প্রাচীন আদলে ফিরিয়ে নিতে চেষ্টা করেছি।”
সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে শচীন দেববর্মণের বাড়িটি সুষ্ঠুভাবে সংস্কার-সংরক্ষণ কাজের তদারকির জন্য সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠিত কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন আবু সাঈদ এম আহমেদ।
তিনি বলেন, “বাড়িটি সংস্কার একমাত্র লক্ষ্য হওয়ার কথা ছিল না। এই বাড়িটি ঘিরে কুমিল্লায় একটি কালচারাল কমপ্লেক্স তৈরি করা হবে, এটাই ছিল পরিকল্পনা। ”
‘শচীন দেববর্মণ কালচারাল কমপ্লেক্স’, যার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী, তা নিয়ে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদের কিছু জানা নেই।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “বাড়িটি সংস্কার করা হয়েছে। সেটিকে পুরাকীর্তি হিসেবে সংরক্ষণেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আর কোনো প্রকল্প আপাতত নেই।”
সাবেক সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের সঙ্গে যোগাযোগে সংস্কৃতি বলয় তৈরির জন্য একটি প্রকল্পের খসড়া তৈরি করা হয়েছিল বলে জানা গেল।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাড়িটিকে ঘিরে সংস্কৃতিকর্মীদের জন্য এমন একটা কমপ্লেক্স তৈরি করার কথা ছিল যেখানে শচীন জাদুঘর এবং বাড়িসংলগ্ন পুকুরে ভাসমান মঞ্চ করার কথা ছিল। একটি গানের সংগ্রহশালা করাও ছিল ওই পরিকল্পনার অংশ।
“তবে সেই জন্য শচীন দেববর্মণদের বাড়ির জায়গা থেকে সরকারি মুরগির খামারটি সরানো দরকার। আমার সঙ্গে সেই সময়কার প্রাণিসম্পদমন্ত্রীর কথা হয়েছিল। তিনি জায়গাটি ছেড়ে দিতে রাজি হয়েছিলেন।”
আসাদুজ্জামান নূর মনে করেন, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উচিৎ দ্রুত একটি প্রকল্প তৈরি করা। তিনি বলেন, “প্রকল্পটি উপস্থাপিত হলে অনুমোদন পাওয়ার জন্য বেগ পেতে হবে না। কেননা, এটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গীকারের অংশ।”
শচীন দেব বর্মণ কুমিল্লায় ছিলেন ১৯২৪ সাল পর্যন্ত। ওই বছর উচ্চশিক্ষার্থে তিনি চলে যান কলকাতায়, সেখানে ছিলেন ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত। ১৯৪৪ সালে তিনি সপরিবারে মুম্বাই চলে যান। মুম্বাই চলচ্চিত্র জগতে শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালকের মর্যাদা লাভ করেন। ভারত সরকার তাকে পদ্মশ্রী খেতাবে ভূষিত করেন। তার স্ত্রী মীরা দেবীও উপমহাদেশের বিখ্যাত শিল্পী ও গীতিকার ছিলেন। স্ত্রীর রচিত বহুগান গেয়েছেন তিনি। ১৯৭৫ সালের ৩১ অক্টোবরে মারা যান এবং মুম্বাইয়ে হয় তার শেষকৃত্যানুষ্ঠান। শচীন দেববর্মণের একমাত্র ছেলে রাহুল দেববর্মণ ভারতের বিখ্যাত সংগীত পরিচালক, যিনি আর ডি বর্মণ হিসেবে পরিচিত।
কুমিল্লার বাড়িতে দেববর্মণ পরিবারের যারা ছিলেন, তারাও ১৯৪৭ সালের পর ভারতে চলে যান। পরিত্যক্ত এই বাড়িটির প্রায় সাত একর জমির সবটাই প্রথমে মিলিটারি গোডাউন হিসেবে ব্যবহৃত হয়। গোডাউন তুলে নেওয়ার পর বাড়িটির একাংশে করা হয় হাঁস-মুরগির খামার। সেই থেকে কুমিল্লা শহরের চর্থার এই এলাকাটি মুরগির খামার নামে পরিচিতি পায়।