ঘন কুয়াশা শীতের অনুভূতি বাড়াবে জানিয়ে আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, তাপমাত্রা ৭/৮ ডিগ্রি হলেও অনুভূত হবে ২/৩ ডিগ্রির মত।
Published : 04 Jan 2024, 08:52 PM
তিন সন্তান নিয়ে একার রোজগারে সংসার সামলানো গৃহকর্মী হালিমা আক্তার ঠিকমত বাজার করতেই হিমশিম খান, তাই তার কাছে ভালো শীতের কাপড় বা মোটা কম্বল কেনার চিন্তা অলীক। পৌষের তীব্র ঠাণ্ডা পাড়ি দিতে বাধ্য হয়ে বাড়ি বাড়ি থেকে পুরানো গরম কাপড় চেয়ে নিয়েছেন তিনি।
হালিমার মত ভ্যানচালক খসরুরও ভারী কাপড় কেনার সামর্থ্য নেই। দিনের বেলা কোনমতে কাটিয়ে দিলেও রাত হলে পথের ধারে জ্বালানো আগুনই তার একমাত্র ভরসা।
হুট করে শীত বেড়ে যাওয়ায় হালিমা, খসরুর মত রাজধানীর খেটে খাওয়া নিম্ন আয়ের অনেক মানুষ পড়েছেন ভোগান্তিতে। আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে আগামী কয়েকদিন মাঝরাত থেকে সকাল পর্যন্ত ঘন কুয়াশা ঝরতে থাকবে। আর তাতে বাড়বে শীতের তীব্রতা।
পৌষের শেষভাগে এসে ঢাকাসহ দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে জেঁকে বসেছে শীত। উত্তরের জেলাগুলোয় বইছে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ, অনেক এলাকায় ঘন কুয়াশার সঙ্গে বইছে উত্তুরী হাওয়া।
কয়েকদিন ধরে সৈয়দপুর, নীলফামারী, দিনাজপুর, পাবনার ঈশ্বরদীসহ আরও কয়েক জেলায় পারদ থাকছে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের এপার-ওপার। ফলে এসব এলাকায় দিনের মধ্যভাগেও সেভাবে সূর্যের দেখা মিলছে না। আবার সূর্য উঠলেও দিনের আলোর সেই ঠাণ্ডা কাটাতে পারছে না।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক আজিজুর রহমান বলেন, "আগামী কয়েকদিন মধ্যরাত থেকে সকাল পর্যন্ত মাঝারি থেকে অতি ঘন কুয়াশা পড়তে পারে, যা দেশের কোথাও কোথাও গড়াবে দুপুর পর্যন্ত।"
ঘন কুয়াশা শীতের অনুভূতি বাড়াবে জানিয়ে তিনি বলেন, “তাপমাত্রা থাকবে ৭-৮ ডিগ্রি, কিন্তু মনে হবে আরও কম। ২-৩ ডিগ্রি তাপমাত্রা চলছে এমনও মনে হতে পারে।"
চলতি মাসের দীর্ঘমেয়াদী পূর্বাভাসে জানুয়ারিতে দেশে এক-দুটি মৃদু থেকে মাঝারি মাত্রার শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাওয়ার আভাসও দিয়েছিল আবহাওয়া অফিস।
আবহাওয়া অধিদপ্তর বৃহস্পতিবার বলেছে গত ২৪ ঘণ্টায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল তেঁতুলিয়ায় ৮ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। দিনাজপুর ও পঞ্চগড় জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া শৈত্যপ্রবাহ অব্যাহত থাকবে আরও কয়েকদিন। ঘন কুয়াশার কারণে বিমান, নৌ এবং সড়ক পথে চলাচলে সমস্যা হতে পারে।
উত্তরের জেলার ঠাণ্ডা দাপট এসে পৌঁছেছে ঢাকাতেও। গৃহকর্মী হালিমার মত নিম্ন আয়ের মানুষ তাতে পড়েছে মুশকিলে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এতদিন শীত কম আছিল; মনে করছিলাম এবার কষ্ট কম হইব। এখন তো আবার শীত পরছে, বাচ্চা পোলাপান নিয়ে কষ্টে আছি। একটা পাতলা কম্বল নিয়ে ঘুমানো যায় না। বাচ্চাটা সারা রাত শীতে কাঁপে। টাকা পয়সাও নাই যে শীতের লাগি গরম কিছু কিনমু। বাজারে জিনিসপত্রের দামও অনেক, খাওয়ার জিনিস কিনতেই অনেকবার ভাবা লাগে।
“এর হের বাড়ি থেকে কিছু ছিঁড়া পুরান কাপড় দিছিল গতবার। ওইগুলা দিয়েই চলতেছি, ওইগুলা দিয়ে শীত মানে না।”
ভ্যান চালক খসরু মিয়া বলেন, "গরীব মানুষের শীতও যা, গরমও তা। আমাদের তো দেখার কেউ নাই। দিনের বেলা রোদ থাকে তখন একটু আরাম হয়। রাতে ঘুমানোর মত অবস্থা থাকে না। অনেক রাত পর্যন্ত আগুন জ্বালাইয়া তাপাই, তখন শরীর একটু গরম হয়- এর পরে ঘুমাইতে যাই।”
কালশীর রাস্তার পাশে দেখা গেল ফুল হাতা শার্ট পরে রিকশায় বসে আছেন চালক কাশেম মিয়া।
তিনি বলেন, “মোডা কাপড় নাই; তাই এমনেই বের হইছি। আমাদের থাকার জায়গারই কোন ঠিক নাই, শীত কমানোর ব্যবস্থা কেমনে করুম?”
ফুটপাতের বিক্রিতে ভাটা
নতুন বছরের শুরু থেকে শীতের দাপট বাড়লেও গরম কাপড় কেনাবেচায় উত্তাপ নেই বলে জানিয়েছেন মিরপুর, কালশী, মহাখালী এসব এলাকার ফুটপাতের বিক্রেতারা।
মিরপুরের নান্নু মার্কেটের ফুটপাতে দোকান বসে ৪০ থেকে ৫০টি। সেখানে গিয়ে দেখা গেছে, ঝেড়েমুছে ফুটপাতের দোকান সাজাচ্ছেন কেউ কেউ। আবার কেউ চৌকিতে কাপড় সাজিয়ে অপেক্ষা করছেন ক্রেতার জন্য।
কুয়াশা বাড়লে ক্রেতা কমে যায় বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছেন এই মার্কেটের বিক্রেতা মো. ইমন।
"এই দুইদিন অনেক কম লোক আসছে, বাতাসের কারণে আসতে চায় না আরকি। আমার নিজেরই আসতে মন চায় না। আর গ্রামে যারা যায় তারা শীতের শুরুতেই জামা কিনে নিয়ে চলে যায়। ঢাকায় তো আর তেমন শীত পরে না।”
গত মাসের মাঝ নাগাদ থেকে শীতের পোশাক বিক্রি কমে গেছে বলে আরেক বিক্রেতা মো. মিলন জানান।
তিনি বলেন, “এ মাসে বেচাবিক্রি একদমই নাই। গতবারের শীতের চেয়ে এবার বিক্রি অনেক কমে গেছে। তাও শীতের শুরুর দিকে যা বিক্রি হইত তাও এখন হয় না। শীতের সময় তাই পাতলা কাপড়ও চলে না। গরমের সময় সন্ধ্যা বেলা এই মার্কেটে প্রচুর লোক আসে, বেচে শেষ করতে পারি না। আর এখন যা দেখতেছেন সন্ধ্যায়ও তাই অবস্থা চলতেছে।”
কালশীর ২২ তলা মার্কেটের ফুটপাতে গিয়েও দেখা গেল একই অবস্থা। বিক্রেতারা বসে আছেন পসরা সাজিয়ে, তবে কেনার কেউ নেই।
এখানকার বিক্রেতাদের ভাষ্য, মার্কেটে এখন লোক আসে না বললেই চলে। অল্প যা বিক্রি হচ্ছে তা বাচ্চাদের পোশাক। এছাড়া গতবারের তুলনায় বিক্রিবাটা কম বলে জানিয়েছে প্রায় সবাই।
বিক্রেতা শাকিল মিয়া বলেন, “কাপড় নিয়ে বসি প্রতিদিন; যাওয়া- আসার সময় দুয়েক জন কিনে নিয়ে যায়। কেউ কেউ দেখে চলে যায়। শীতের পোশাকের চেয়ে অন্য পোশাক একটু চলে।”
ক্রেতাদের অলস সময় পার করতে দেখা গেল মহাখালীর আমতলীর ফুটপাতের দোকানগুলোতেও।
প্রায় ক্রেতাশূণ্য মার্কেটে বসে কানের কাছে মোবাইল ধরে গান শুনছিলেন শীতবস্ত্র বিক্রেতা মো. নূরে আলম।
তিনি বলেন, “মানুষ আসে না তাই গান শুনতেছিলাম। শীতের জিনিস এখন আর কিনে না মানুষ; শীত আসার আগেই কিনে ফেলছে অনেকে। তাই গতবারের চেয়ে অনেক কম বিক্রি হচ্ছে এবার। গতবার শীত বেশি ছিল তাই বিক্রিও বেশি হইত।”
তবে মিরপুরের পল্লবী এলাকায় দেখা গেল খানিকটা ভিন্ন চিত্র। সেখানে ক্রেতা সমাগম তুলনামূলক বেশি। ফুটপাতের একটি দোকানে পোশাক নিয়ে দামাদামি করছিলেন হাফসা বেগম।
তিনি বলেন, “মায়ের বাড়িতে বাচ্চা নিয়ে বেড়াইতে আসছিলাম; তখন বুঝতে পারি নাই এত শীত পরবে। তাই কাপড় বেশি আনি নাই, সেই কারণে বাচ্চার জন্য কাপড় নিতে আসলাম; ঠান্ডায় ওর কষ্ট হচ্ছে অনেক।”
পল্লবীর বিক্রেতারা বলছেন, এবার শীতের শুরু থেকেই শীত পোশাক বিক্রিতে যে ভাটা ছিল; গত দুইদিনে কিছুটা হলেও বিক্রি বেড়েছে।
বিক্রেতা নজরুল মিয়া বলেন, “আমাদের এখানে গরীব মানুষেরা আসে; বড়লোক তো আর আইব না। একটু শীত বাড়ছে বলে এরা আসতেছে আরকি। ছোট-বড় সবার পোশাকই বিক্রি হচ্ছে এখন।”
"শীত বাড়ায় এখন টুকটাক একটু বিক্রি হচ্ছে। বাচ্চাদের কাপড়টা একটু বেশি বিক্রি হচ্ছে আরকি," বলেন বিক্রেতা আল আমিন।