“টিআরএম প্রকল্প বাদ দিয়ে ২০২২ সাল থেকে পানি উন্নয়ন বোর্ড যে সেচ প্রকল্প গ্রহণ করেছিল, সেটাই এখন ভোগান্তির কারণ।”
Published : 30 Sep 2024, 01:22 AM
টানা বৃষ্টিতে ভবদহ অঞ্চলে বিলের পর বিল, কয়েকশ গ্রাম-হাটবাজার তলিয়ে কাজকর্মহীন বসে থাকা ১৫ লাখের বেশি মানুষ জীবন-জীবিকার হুমকিতে পড়েছে; পানিবাহিত রোগা-বালাই বেড়েছে, দেখা দিয়েছে খাদ্য সংকট।
প্রায় মাসখানেকের জলাব্দ্ধতায় গরু-ছাগল, সাপ-ব্যাঙের সঙ্গে বসবাস করা এসব মানুষের দুর্ভোগ-দুর্গতির শেষ নেই। বছরের পর বছর ধরে পানির সঙ্গে তাদের এ যুদ্ধ করেই যেতে হচ্ছে।
ভবদহ অঞ্চলে ঘুরে দেখা যায়, এবারও সেই একই কষ্ট। সেই পানির মধ্যে বসবাসের ভোগান্তি ভয়াল রূপ নিয়েছে। শিশুখাদ্যের সংকট চরমে; কেউ মারা গেলে কবর দেওয়া বা সৎকার করার উপায়ও যেন নেই। অন্তঃস্বত্তা নারী, প্রসূতি মা, শিশু-বৃদ্ধ সবাই মিলে একত্রে বসবাসের দুর্বিসহ দিনরাত্রি পার করছে সেখানকার লাখো মানুষ।
অথচ এই জলাবদ্ধতা নিরসনে এখনও নেওয়া হয়নি কোনো কার্যকর উদ্যোগ। পানি সরানোর একমাত্র সক্রিয় উপায় পাম্প দিয়ে সেচ- যার ওপর ভরসা করার আদৌ কোনো কারণ দেখছেন না দুর্ভোগ-ক্লান্ত ভবদহের মানুষ।
যশোরের অভয়নগর, মনিরামপুর, কেশবপুর ও খুলনার ডুমুরিয়া, ফুলতলা উপজেলার অংশবিশেষ পরিচিত ভবদহ অঞ্চল হিসেবে। পুরো এ অঞ্চল জলাবদ্ধতায় ধুঁকছে অনেক বছর ধরে। এর সমাধানে বারবার নেওয়া ‘ভুল প্রকল্প’ শুধু রাষ্ট্রের শত শত কোটি টাকারই অপচয় করেনি; বাড়িয়েছে ভুক্তভোগীদের কষ্টের দিন। যে কারণে একটু ভারি বৃষ্টি হলেই ফসলের মাঠ, মাছের ঘের, পুকুর, খাল-বিল উপচে পানি উঠে যায় উঠানে, ঘরে, মসজিদে-মন্দিরে, স্কুলে-কলেজে।
একের পর এক ‘আত্মঘাতী’ প্রকল্পের খেসারত দিতে হচ্ছে ভবদহের মানুষদের। বুঝে-না বুঝে নেওয়া এসব প্রকল্প এবারও ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে এনেছে বলে মনে করেন জলাবদ্ধ-উপদ্রুত মানুষ।
তাদের মতে, টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট (টিআরএম) বা জোয়ারাধার বাস্তবায়নের জনদাবি উপেক্ষা করে সেই অনেক বছর আগে থেকে বাঁধ দেওয়া, স্লুইট গেট, সেতু-কালভার্ট, পোল্ডার নির্মাণ করা; ‘ভাগবাটোয়ারা’র অপ্রয়োজনীয় সেচ পাম্প স্থাপন, খননের নামে নদীর মাটি কেটে নদীতে ফেলা; বাঁধ দিয়ে খালগুলো দখল করে নদীর সঙ্গে সংযোগ ছিন্ন করার মত প্রকল্পের জের টানতে হচ্ছে স্থানীয়দের।
ভবদহ জলাবদ্ধ অঞ্চলকে এখনই ‘দুর্গত অঞ্চল’ ঘোষণা করে সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জোর দাবি তুলেছেন দীর্ঘদিন আন্দোলন করে আসা মানুষেরা।
অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ বন ও জলবায়ু এবং পানি সম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ভবদহ জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ আপাতত কমিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলেছেন।
বিডিনিউজ টোয়েটিফোর ডকটমকে তিনি বলেন, স্থায়ী সমাধানের জন্য কর্মপলিক্পনা করে এগিয়ে যাওয়ার বিষয়টি তার অগ্রাধিকারে রয়েছে।
বৃষ্টি এবার বাড়িয়েছে ভোগান্তি
এবারের জলাবন্ধতার কারণ হিসেবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা বলছেন, এ বছর যশোরে রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে। শুধু ২৬ অগাস্ট থেকে ১৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বৃষ্টি হয়েছে ৬২৩ মিলিমিটার।
পানি উন্নয়ন বোর্ড যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলী পলাশ ব্যাণার্জী বলছেন, জলাবদ্ধ অঞ্চলের পানি দ্রুত নিষ্কাশনের কাজ চলছে। এ জন্য নয়টি পাম্প চলছে। পলিতে নদীর যে স্থান উঁচু হয়ে আছে, সেই ৩ দশমিক ৩ কিলোমিটার খনন শুরু হয়েছে। ভবদহের ডহুরি স্লুইস গেট এলাকায় এ খনন কাজ চলছে।
“ভবদহ হয়ে যশোর শহরের পানিও নামে। বর্তমানে যে পানি নামছে তা হরিণার বিলে আবদ্ধ থাকা পানি। এই পানি নেমে যাওয়ার পর ভবদহ এলাকার আবদ্ধ পানি নিষ্কাশন শুরু হবে।”
ভবদহ কী
ভবদহ জলাবদ্ধ অঞ্চলের বাসিন্দা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের অধ্যাপক অনুপম হীরা মণ্ডল বলেন, যশোরের অভয়নগর উপজেলার ভবানীপুর গ্রামের ভবদহ এলাকায় ১৯৬১ সালে নির্মাণ করা হয় স্লুইস গেট। এর পরই মনিরামপুর, কেশবপুর, অভয়নগর, খুলনার ফুলতলা ও ডুমুরিয়া এবং পরে সাতক্ষীরার তালা উপজেলার মধ্যবর্তী ভবদহ অঞ্চলের কৃষক জলাবদ্ধতার কবলে পড়েন। ১৯৮৬ সাল থেকে স্থায়ী জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। এর মূল কারণ ভবদহের ভাটিতে থাকা নদ-নদীর নাব্য হারানো।
এ অঞ্চলের জলাবদ্ধতা নিরসনে কয়েক দশকে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। ১৯৯০ থেকে চলতি বছর পর্যন্ত ভবদহ ঘিরে নেওয়া ২১টি প্রকল্পে ব্যয় দেখানো হয়েছে ৬০০ কোটি টাকা। তারপরও নিরসন হয়নি জলাবদ্ধতা।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, এই এলাকার পানি ওঠা-নামা করে মুক্তেশ্বরী, টেকা ও হরি নদী দিয়ে। পলি পড়ে এসব নদী হারিয়েছে নাব্য, ভারি বৃষ্টি হলে তা আর ধারণ করতে পারে না নদীগুলো; নদীর চলার পথে শত বাঁধ আর বাধা পানি নামতে দেয় না দক্ষিণে-বঙ্গোপসাগর অভিমুখে।
ভবদহের ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী, এর উত্তরে যশোরের উঁচু অঞ্চল, পলি পড়ে দক্ষিণে খুলনার নিচু অঞ্চলও এখন উঁচু হয়ে গেছে; আর পূর্বে ভৈরব নদের পূর্ব অববাহিকা আগে থেকেই উঁচু এবং পশ্চিমে কপোতাক্ষের পশ্চিম অববাহিকাও অপেক্ষাকৃত উঁচু। ফলে ভবদহ এখন ‘বেসিন’ হয়ে উঠেছে। চার দিকের পানি এই বেসিনে জমে; অথচ নেমে যাওয়ার পথ নেই।
‘ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটি’র যুগ্ম আহ্বায়ক গাজী আব্দুল হামিদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এবারও কয়েক দিনের অবিরাম বৃষ্টিতে কেশবপুর, মনিরামপুর ও অভয়নগর উপজেলার শত শত গ্রামে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। প্রায় ২৭টি বিলের পানি নিচে নামতে পারছে না। ফুলে ওঠা পানি গ্রামে ঘর-বাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও রাস্তাঘাট ভাসিয়ে দিয়েছে। বিশেষ করে ১৩ সেপ্টেম্বরের পরিস্থিতি আয়ত্তের বাইরে চলে গেছে।
জলাবদ্ধ অঞ্চলে গিয়ে দেখা যায়, মনিরামপুর, কেশবপুর ও অভয়নগর উপজেলার জলাবদ্ধ ইউনিয়নগুলোর মধ্যে রয়েছে মঙ্গলকোট, বিদ্যানন্দকাটি, কেশবপুর, পাজিয়া, সুফলাকাটি, গৌরিঘোনা, হরিদাসকাটি, সুন্দলী, চলশিয়া, পায়রা, কুলটিয়া, মনোহরপুর, দুর্বাডাঙ্গা ও শ্যামকুড়।
স্থানীয়রা বলেছেন, এ তিন উপজেলার ২৭ বিলের পানি নিষ্কাশিত হয় ভবদহের ২১, ৯ ও ৩ ভেন্টের স্লুইস গেট দিয়ে হরি নদিতে। কিন্তু পলিতে স্লুইস গেটগুলো অচল হয়ে থাকায় পানি সরছে না আর।
ভবদহের জলাবদ্ধ পরিস্থিতি সম্পর্কে পানি সম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ভবদহ জলবদ্ধতার সমস্যা সবচেয়ে প্রকট হয় ২০০৬ থেকে ২০০৭ সালে। সেসময় থেকেই আমি মাঠে ছিলাম, আমি এই ঘটনার পুরোটাই জানি।”
সেই থেকে ভবদহ জলাবদ্ধতার সমাধানে গণশুনানি, গোলটেবিল বৈঠক এবং টিআরএম বিষয়ে আইনি লড়াই করার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, টিআরএম প্রকল্প বাস্তবায়নের জটিলতা কাটাতে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি-বেলা একটি মামলাও দায়ের করেছে।
সাপ-ব্যাঙ আর পোকামাড়কের সঙ্গে বাঁচা
মনিরামপুর উপজেলার জলাবদ্ধ কুলটিয়া গ্রামের রীতা মণ্ডল নৌকায় বসেছিলেন, পাশে পানিতে নেমে মাছ ধরছিলেন স্বামী আনন্দ মণ্ডল ও ১৩ বছরের মেয়ে। আরেকটি নৌকায় শহরের মানুষ দেখে বললেন, “আমাগের জন্য কিছু নিয়ে আইনছেন?”
সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে বললেন, “একটু জাগায় (জায়গা মত) কয়ে দিয়েন, আমাগের জন্যি য্যানো কোনো ব্যবস্থা করে। এই দ্যাখেন, জলে ভিজে হাত-পায়ের কী অবস্থা! পাক (পচন) ধরেছে।”
আর একটু এগিয়ে দেখা গেল চারদিকে পানিবেষ্টিত একটি ঘরে উঁচুতে খাট বেঁধে পঙ্গু স্বামীকে নিয়ে বসে আছেন স্বপ্না শিকদার। বললেন, “ঘর-বাড়ি ভাইঙে পড়তেছে। অনেক কষ্টে রান্না করে খাচ্ছি আমরা। আমাগের কিছু চাইনে, আমাগের এই জলডাই শুকোয় দেও।”
ভবদহ অঞ্চলের মানুষের এই শোচনীয় অবস্থার জন্য যশোর-৫ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডকে দায়ী করেছেন ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক হামিদ।
তার অভিযোগ, “টাইডাল রিভার ম্যাজেমেন্ট-টিআরএম প্রকল্প বাদ দিয়ে ২০২২ সাল থেকে স্বপন ভট্টাচার্যের মদদে পানি উন্নয়ন বোর্ড যে সেচ প্রকল্প গ্রহণ করেছিল, সেটাই এখন ভোগান্তির কারণ। ওই ব্ছরের ২ জানুয়ারি ও ১৫ নভেম্বর ৩ কোটি ৮০ লাখ টাকার সেচ প্রকল্প ও প্রস্তাবিত প্রায় ৪৫ কোটি টাকার ‘ভবদহ ও তৎসংলগ্ন বিল এলাকার জলাবদ্ধতা দূরীকরণ’ প্রকল্প বাতিলের দাবিতে যশোরে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছিল ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটি।
“ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটি বৃহস্পতিবার যশোর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ওই এলাকার দুরাবস্থার কথা জানায় এবং প্রতিকারে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে, তাও জানতে চায়। নির্বাহী প্রকৌশলী বলেছেন, তিনি ২৪ ঘণ্টাই এ বিষয়ে খোজ রাখছেন।”
মনিরামপুরের মশিয়াহাটী গ্রামের শেখর বিশ্বাস বলছিলেন, “স্থানীয়দের মতামতকে ‘গুরুত্ব না দিয়ে’ জলাবদ্ধতা নিরসনে পানি উন্নয়ন বোর্ড ভবদহ সেচ পাম্প প্রকল্প গ্রহণ করে। তখন আমরা বলেছিলাম, জলাবদ্ধতা নিরসনে এই প্রকল্প কোনো কাজে দেবে না। বৃষ্টি হলেই আবার জলাবদ্ধতা হবে।
“গত ২-৩ বছর বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টি ছিল কম। কিন্তু এ বছর স্বাভাবিক বৃষ্টি হয়েছে। ফলে আমাদের আশঙ্কাই সত্যি হয়েছে।”
অভয়নগরের জলাবদ্ধ কোটা পশ্চিমপাড়া এলাকার ইয়াসিন শেখের শোয়ার ঘরে পানি ঢুকে গেছে। তিনি বলেন, “পরিবার-পরিজন নিয়ে খুব কষ্টে আছি। রান্না করার জায়গাটুকুও নেই।
“টয়লেটে যেতে পারছি না, খেতেও পারছি না। রাতে খাটের নিচে পানি থাকছে, সাপ-ব্যাঙ, পোকামাকড়ের ভয় নিয়ে খাটের উপরে আমরা থাকছি।”
কোনো সহযোগিতা সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছে কি না, জানতে চাইলে ইয়াসিন বলেন, এখনও কোনো ধরনের সরকারি সহযোগিতা তারা পাননি।
অভয়নগরের একদল তরুণ জলাবদ্ধ অঞ্চলে কাজ করছে। এরই মধ্যে স্বল্প পরিসরে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করা এই উদ্যোগের অন্যতম সংগঠক সৈয়দ সোয়াইব ইমতিয়াজ বলেন, তারা নিজেদের উদ্যোগে খাদ্য সহায়তা দিচ্ছেন এবং মেডিকেল ক্যাম্প করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
“আমরা চাই ভবদহ জলাবদ্ধ অঞ্চলকে ‘দুর্গত’ অঞ্চল ঘোষণা করে সার্বিক সহায়তা নিয়ে সরকার কষ্টে থাকা মানুষের পাশে এগিয়ে আসুক।”
অভয়নগর উপজেলা ঘের মালিক সমিতির সভাপতি মো. রবিউল আলম বলেন, ঘেরগুলো ভেসে গেছে, মালিকরা সর্বস্বান্ত হয়ে গেছেন। তাদের পুনর্বাসন দরকার; সরকারি সহায়তা না পেলে ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব হবে না।
সামনে পূজা, উৎসবের প্রস্তুতি নেই
সামনে সারদীয় দুর্গোৎসব; এবার ভবদহের জলাবদ্ধ অঞ্চলে পূজার উৎসব সেভাবে আয়োজন করার সুযোগও নেই। অভয়নগরের সুন্দলীর বাসিন্দা প্রিয়ব্রত ধর বলেন, “পূজা চলে এসেছে অথচ উৎসবের প্রস্তুতি নেই। সুন্দলীর মণ্ডপে প্রতিমা গড়ার কাজ চলছে; তবে রাস্তাঘাট, ঘরবাড়িতে জল। সবাই কষ্টে আছে।”
যশোর জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি দীপংকর দাস রতন বলেন, “এবার মনিরামপুরের হরিদাস কাটির কুচলিয়া মন্দির, হাজিরহাট মন্দির, অভয়নগরের সুন্দলী ইউনিয়নের সব মন্দির, মহিশায়াহী ও কুলটিয়ার মন্দির হাঁটু পানিতে ডুবে আছে। এর মধ্যেই পূজা স্বল্প পরিসরে পূজার আয়োজন করা হচ্ছে।”
সমাধান কীভাবে?
জলাবদ্ধতা দূর করতে ‘সেচ প্রকল্প’ নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করে বলিদাহ-পাঁচাকড়ি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হারুন-অর-রশিদ বলেন, “তিন উপজেলার ২৭ বিলের পানি নিষ্কাশিত হয় ভবদহের ২১, ৯ ও ৩ ভেন্টের স্লুইস গেট দিয়ে হরি নদিতে। কিন্তু পলিতে স্লুইস গেটগুলো অচল হয়ে থাকায় পানি যাচ্ছে না।
“বর্তমানে আবার স্লুইস গেটগুলো বন্ধ করে পানি উন্নয়ন বোর্ড সেচ পাম্প বসিয়েছে। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হচ্ছে না। এর পরিণতি হিসেবে এক মাস ধরে এই জলাবদ্ধতা।”
নদীগুলো ভরাট হওয়ায় এখন অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, টিআরএম করতে গেলে আগে নদী খনন করে জোয়ার-ভাটা স্বাভাবিক করতে হবে বলে মনে করছেন একই বিদ্যালয়ের শিক্ষক আব্দুস সবুর।
তিনি বলেন, “নদী খনন না করলে এই পানি কমবে না। সেচ করে এ জলাবদ্ধতার পানি কমানো যাবে না। টিআরএম প্রকল্প ছিল একমাত্র পরিত্রাণের উপায়। কিন্তু পলি জমে এখন যে অবস্থা তাতে নদী খনন করা ছাড়া উপায় নেই।”
অধ্যাপক অনুপম হীরা মণ্ডল বলছিলেন, টিআরএম-এর ধারণা কৃষকদের কাছ থেকেই পায় সরকার। মূলত ‘জোয়ারাধার’ বা ‘ডাকজোয়ার’ ব্যবস্থাকেই টিআরএম বলা হয়। এই ব্যবস্থায় নদীর পানি বিলে উঠিয়ে বিলের বুক পালি দিয়ে ধীরে ধীরে উঁচু করা যায়। এতে করে একদিকে জলাবদ্ধ বিল ও জনপদের মাটির উচ্চতা বাড়ে, অন্যদিকে নদীর বুক গভীর হয়; স্রোতসহ পানি দক্ষিণের নিচু অঞ্চলে নেমে যেতে পারে।
পানি সম্পদ উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসানের কাছে জানতে চাওয়া হয়, এবার জলাবদ্ধতা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে; এর স্থায়ী সমাধান চাইছে ভবদহের মানুষ, সরকার কী ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে।
জবাবে তিনি বলেন, এবার যা হয়েছে সমস্যাটা জানবার পরে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব ভুক্তভোগী এলাকার লোকজনের সঙ্গে একটি বৈঠক করেছেন। সে বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৪টি ফ্লোটিং ড্রেজার দিয়ে পানি সেচে ফেলা হলে আপাত সমস্যার সমাধান হবে। এরপর ওই এলাকার মানুষজন দাবি তুলেছে, কতগুলো খালের মুখ সরু হয়ে গেছে পলি পরে, সেই পলি সরাতে ভবদহ এলাকার বাইরে থাকা নদীগুলো ড্রেজিং করাতে হবে।
“আমরা এই দাবিগুলো শুনেছি। আমি দেশের বাইরে যাচ্ছি, ফিরে এসে ওই এলাকা পরিদর্শনে যাব। এটা যে কেবল ভবদহ তা নয়, পাশের এলাকা বিল ডাকাতিয়াতেও শুরু হয়েছে। ফলে এর জন্য একটা সামগ্রিক কর্মপরিকল্পনা লাগবে। সেই পরিকল্পনার ব্যাপারে মানুষ কী চায়, আমরা তা শুনতে চাই।”
টিআরএম প্রকল্প দ্রুত চালুর দাবি
ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক রণজিৎ বাওয়ালি বলছিলেন, ভবদহের পানিবন্দি মানুষের দীর্ঘ আন্দোলনের পর ১৯৯৮ সালে তৎকালীন পানিসম্পদ মন্ত্রীর উপস্থিতিতে সরকার এক কনভেনশনে পর্যায়ক্রমে বিলগুলোতে ‘জোয়ারাধার’ বা টিআরএম প্রকল্প গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু স্থানীয় লোকজন এবং মাছের ঘের মালিকরা টিআরএমের বিরোধী ছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১২ সালে সরকারি দলের একাংশ ও ঘের মালিকরা জোটবদ্ধ হয়।
“তখন টিআরএম-বিরোধীদের সশস্ত্র আক্রমণে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও জাতীয় সংসদের তৎকালীন হুইপ আব্দুল ওহাব এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা আহত হন। সরকারি গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। সরকার হামলাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে বরং টিআরএম প্রকল্প বাতিল করে দেয়। আবার আগের অবস্থায় ফিরে যায় ভবদহ জলাবদ্ধ পরিস্থিতি।”
কমিটির উপদেষ্টা ইকবাল কবির জাহিদ বলেন, “২০১২ সালের পর আবার নিরঙ্কুশ জনমতের ভিত্তিতে ২০১৭ সালের ১৬ মার্চ যশোর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে পানিসম্পদ মন্ত্রীসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ও ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে একটি জাতীয় কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়।
“পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং-আইডব্লিউএম ব্যাপক জরিপ ও জনমত যাচাই করে বিল কপালিয়া ও পর্যায়ক্রমে বিলে বিলে টিআরএম প্রকল্প গ্রহণ করে। ২০১৮ সালের ১২ সেপ্টেম্বর আকস্মিকভাবে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ওই প্রকল্প বাতিল করে নতুন প্রকল্প প্রণয়নের নির্দেশ দেয়। ফলে এই বিপর্যয়কর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।”
মনিরামপুরের কপালিয়ায় তিন ভেন্ট এলাকার রাম প্রসাদ সরকার বলেন, “পানির চাপে সেচ কোনো কাজে দিচ্ছে না। নদীর পানি উপচে বাড়িতে ঢুকছে। পানি বাড়তে থাকায় স্থানীয়রা রাস্তার ওপর ঘর বেঁধে গবাদি পশু নিয়ে রাখছেন।”
কপালিয়া থেকে মশিয়াহাটী পর্যন্ত একই অবস্থা দেখা গেছে। পথে রাস্তার ওপর তৈরি গোয়াল ঘরে গরুকে খাবার দিচ্ছিলেন সুষমা সরকার। জলাবন্ধতাকে সঙ্গী করে বেঁচে থাকা এ নারী বলেন, “এত কষ্টে বেঁচে থাকা যায়?”
পানিয়াল গ্রামের রাজু আহমেদ বলেন, প্রায় এক মাস জলাবদ্ধতা তার অঞ্চলে। এরপর চার দিন যে বৃষ্টি হয়েছে তাতে জলাবদ্ধতা আরও বেড়েছে। ফলে এ এলাকায় চলাচলের জন্য নৌকা যাতায়াতের একমাত্র অবলম্বন হয়ে উঠেছে।
ভবদহ জলাবদ্ধতা সংকট নিরসন জাতীয় সমন্বয় কমিটির অন্যতম সমন্বয়ক মো. জাহিদুর রহমান বলেন, “সমস্যা দীর্ঘদিনের। তবে এবার আমাদের আশা একটু বেশি; কারণ এখন যিনি পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছেন-সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান; তিনি এই সমস্যা সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত। তার কাছে ভবদহের মানুষ এই সমস্যার সমাধান আশা করে।”
এই কমিটির আরেকজন সমন্বয়ক মো. ইমরান গাজী শনিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি এখন ভবদহ অঞ্চলে আছি; মানুষের কষ্ট সহ্য করার মত নয়। দ্রুত পানি সরানোর ব্যবস্থা না করলে জনজীবনে ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটে যাবে।
“এখানে সমস্যার স্থায়ী সমাধান একটাই- সেটি হল টিআরএম বাস্তবায়ন। আমরা পানি সম্পদ উপদেষ্টার কাছ থেকে আশু উদ্যোগ প্রত্যাশা করছি।”
তবে টিআরএম প্রকল্প নিয়ে কিছু জটিলতা রয়েছে জানিয়ে রিজওয়ানা হাসান বলেন, টিআরএমের ব্যাপারে সেই ২০০৬-০৭ সাল থেকে সরকারের সঙ্গে কথা হচ্ছে। আসলে মানুষ তো এটা চায়। সরকার তাদের ক্ষতিপূরণ দিতে চায় না। মানুষের জমিতে প্রতিবছর পলি ফেলে ফেলে ভরা হবে আর তাকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে না- তা তো হয় না, তার তো রুটি-রুজি থাকে না।
“সরকারের দিকে পাল্টা যু্ক্তি হচ্ছে- পুরো গ্রামেই পলি ফেলে ভরাট করা হবে, সবাই তো জমির মালিক না, জমির মালিক না যারা, তাদের কীভাবে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। এই জায়গাতে আপাতত বিষয়টা আটকে আছে। তবে আমি আশা করি, আমি গিয়ে সবার সঙ্গে কথা বলে একটা সমাধানে পৌঁছাতে পারব। এটা আমরা অগ্রাধীকার ধরেই করব।”